নারী যেন মানুষ নয়,নারীর সঙ্গে যা খুশি তাই করা যায়। এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে কিনা মা-বোন-প্রিয়তমার সম্মানের দিকে কারো এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই! নারী মানে দুর্বল, নারী মানে এতটাই সহজলভ্য যে, এখন জন্মদিনের উপহার হিসেবেও তাকে গছিয়ে দেওয়া যায়।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কতটা নিচে নামলে তবে পশুর সঙ্গে আমাদের চরিত্রগত আর কোনো ফারাক থাকবে না। প্রাণী হিসেবে আমরা এখন উদ্বাহু হয়ে ভোগের নৃত্য করছি। সেখানে পছন্দের সামগ্রী হিসেবে বেশ বিকোচ্ছে আমাদের নারীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক পত্রিকার পাতায় আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিষয়টি বার বার চোখে পড়ছে সেটি হলো ‘ধর্ষণ’। তিন অক্ষরের ছোট এই শব্দের ছায়া এতই কুৎসিত যা ব্যাখ্যা করতে গেলেও ভ্রুকুঞ্চন অনিবার্য। ভোগবাদী সমাজে নারীমুক্তির স্লোগানের আড়ালে নারীর অবস্থান আসলে কোথায়? গত কয়েক মাসে ধর্ষণের সংবাদ গুলো বিশ্লেষণে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যি ভয়াবহ। এক একটি ধর্ষণ ঘটনা পুরো জাতিকেই লজ্জার কাঁটাতারে বিদ্ধ করছে।
প্রতিদিনই আমাদের দেশের কোথায়ও না কোথায়ও মেয়ে শিশু, কিশোরী ও যুবতী নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা বা হত্যার চেষ্টা চলছে। যে সব ধর্ষিতা কিশোরী বা যুবতী নারী প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে তাদের জীবনে নেমে আসছে অমানিশা। পরিবার ও সমাজ তাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। অথচ তাদের কোনোই অপরাধ নেই। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের স্বীকার নারীরা আত্মগ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টা পিতামাতাকেও জানাতে ভয় পায়। ফলে ধর্ষকরা পার পেয়ে গিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় এবং তারা বারংবার মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করতে প্রলুব্ধ হয়।
আমরা বর্তমানে দাবি করছি- সমাজ এগিয়েছে, আধুনিকতা এসেছে। সমাজের কতিপয় মানুষের কর্মকাণ্ডে সমাজ ক্রমেই কলুষিত হয়ে উঠছে। এমনকি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও শিশুদের ওপর ধর্ষণ ও সহিংসতার মাত্রা লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী ও শিশু চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। সহিংসতার শিকার হয়েও তারা তা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে নানাভাবে নির্যাতিত-নিগৃহীত হচ্ছে নারী। পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লালসা ও স্বার্থের বলি হচ্ছে শিশুরাও। বর্তমানে পরিবারের সদস্য,বন্ধু,প্রেমিক,শিক্ষক,কর্মস্থলের সহকর্মী ও গৃহকর্তা-কর্ত্রী, কারো কাছেই যেন নিরাপদ নয় নারী-শিশু। নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠিন আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আইনের শাসনের অকার্যকারিতা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি কারণে আজও নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের দেশে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলেই সমাজের অঙুলি থাকে নারীর দিকেই। ফলে ধর্ষিতার ঠাঁই মেলে না সমাজ বা পরিবারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনো ভাবেই মেনে নেয় না তাকে। অথচ মেয়েটির কোনো অপরাধই নেই। ফলে ধর্ষিতা নারী চরম দুর্ভোগে পড়ে হয় আত্মহননের পথ বেছে নেয়, নয়ত বিপথগামী হতে বাধ্য হয়। এছাড়া রয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা ও উদাসীনতা। অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে আড়াল করতে আইনি জটিলতাকে দায়ী করা হয়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখান দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের উৎসব চলছে। সমাজের প্রত্যেক নারী, শিশু,কিশোরী বালিকা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে যে কোন জায়গায় যে কোন সময়।
জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৪৩১ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭১ জন। এ ছাড়া ২৩ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯৩৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মোট ১ হাজার ৩৫১ জন কন্যা এবং ১ হাজার ৫৮৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়, যার মধ্যে ৬৩৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুই জন ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ৪৩১ জন কন্যা ও ২০৮ জন নারী। এ সময় ৬৯ জন কন্যাসহ মোট ১৪০ জন নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২৫ জন কন্যা ও আট জন নারীসহ মোট ৩৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একই সময় ৯ জন কন্যাসহ মোট ১৪ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ৬৮ জন কন্যাসহ ৯৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। গত বছর যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪৯ জন এর মধ্যে ১০৩ জন কন্যা ও ৪৬ জন নারী। গত এক বছরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৯৩ জন। এর মধ্যে ৮৪ জন কন্যা ও ৬ জন নারী। এদের মধ্যে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে আট জন কন্যা ও এক জন নারী। এ সময় বিভিন্ন কারণে ৮৭ জন কন্যাসহ মোট ৪৯৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১৯ জন। এর মধ্যে কন্যা ছয় জন ও ১৬ জন নারী। এ সময় ৭৪ জন কন্যাসহ মোট ২৬৬ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
একই সময় ১০২ জন কন্যাসহ ২৭৯ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন কন্যাসহ ৩৮ জন আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হয়েছে। এছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তিন জন কন্যাসহ ছয় জন। গেল বছর নারী ও কন্যা পাচারের শিকার হয়েছে মোট ১৩ জন। এর মধ্যে কন্যা ১০ জন ও তিন জন নারী। এ সময় অ্যাসিড দগ্ধের ঘটনা ঘটেছে আটটি এতে কন্যা চার জন ও চার জন নারী আহত হয়। একই সময় ৩৪ জনের অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ২০ জনের অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে আট জন কন্যা অগ্নিদগ্ধ হয় এবং এক জন কন্যার অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। গেল বছর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২২ জন। এর মধ্যে ৫২ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে ছয় জন কন্যাসহ ৪৬ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ২৩১ জন। এর মধ্যে ৮৩ জন কন্যা।
গেল এক বছরে পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩২ জন। এ সময় ১৮ জন কন্যাসহ ২৫ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আট জন গৃহকর্মীর হত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং চার জন গৃহকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ১১৫ জন কন্যাসহ ১৩২ জন অপহরণের শিকার হয়েছে।
এভাবে নারী নির্যাতন,ধর্ষণ,খুন এর মধ্যে দিয়েই পার হচ্ছে একটির পর একটি নারী দিবস। এর শেষ কোথায়? যেকোনো মূল্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে গড়া এই স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো মা-বোন-প্রিয়তমার আর্তচিৎকার শুনতে চাই না। চাই না আর কোনো মা-বোন-প্রিয়তমার আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠুক কারো বুক কিংবা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সৌন্দর্যে ভরা এই বাংলার আকাশ-বাতাস।
লেখক: সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী