আমাদের নদী, আমাদের জীবন
১৪ মার্চ ২০২৪ ১৬:০৪
১৪ মার্চ, আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয়, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতোটুকু- এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর অস্তিত্ত্বের সাথে আমাদের অস্তিত্ত্ব জড়িয়ে আছে। অথচ নদীমাতৃক দেশে নদীর অস্তিত্ত্ব আজ সংকটে। মানুষের লোভ আর অসচেতনতার প্রভাবে প্রমত্তা নদীগুলো আজ মরতে বসেছে। আর এর প্রভাব পরছে আমাদের জলবায়ুতে। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকের নেই বর্জ্য শোধনাগার। সেই বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে। রাজধানী ঢাকার চার নদীতে প্রতিদিন ৬০ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য সরাসরি মিশছে। এসব বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল,ডাইং,প্রিন্টিং ও ওষুধ শিল্পকালকারখানা বর্জ্য। এর প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। শুকনো মৌসুমে অবস্থা আরো প্রকট হয়। অথচ নদীগুলো বর্জ্য ফেলার কোনো ভাগাড় হতে পারে না। নদী থাকবে নদীর স্বাভাবিক গতিতে। আর নদীকে ঘিরে কর্মচঞ্চল থাকবে অর্থনীতি। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু দখল থেমে থাকে না।
দেশের বহু নদীর তীর দখল করে প্রভাবশালীরা তাদের ব্যবসা, বহুতল ভবন বানিয়ে রেখেছে। বালি ফেলে ভরাট করতে করতে নদীর অস্তিত্ত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে। সেসব দখলকারীদের দখলকৃত স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে হবে। কারণ এসব নদ-নদীই দেশের প্রাণ। আর দেশের প্রাণ মানে দেশের মানুষের প্রাণ। মাদকের মত এসব দখলকারীদের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। কোনভাবেই এসব দখলকারী প্রভাবশালীদের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে নদী মুক্ত করতে হবে। নদীর সাথে আমাদের জীবনধারার সুখ দুঃখ জড়িত। আমরা ক্রমেই মরুভূমির দেশের বৈশিষ্ট্যে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সাম্প্রতিক আবহাওয়া পরিবর্তন সেদিকের ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের অভ্যন্তরে বহমান নদনদী ও খালসমূহ সুরক্ষায় কোন পরিকল্পনায় না থাকায় নদীর ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। নদ নদী খনন না করায় দেশের প্রধান নদীগুলোর অবস্থা মৃতপ্রায়। সেসব নদীর স্থলে এখন ফসলের আবাদ অথবা মাঠের পর মাঠ ধূ ধূ বালি। বর্ষায় যদিও নদীর অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়। নদীগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায়। তবে সেই অবস্থা খুব অল্প সময়ই থাকে। শুকনো মৌসুম শুরুতেই নদী যৌবন হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে এক যুগান্তকারী রায় দেয়। এতে বলা হয়, দেশের সব নদ-নদী এখন থেকে ‘জীবন্ত সত্তা’র অধিকার প্রাপ্য হবে। তবু নদীর অস্তিত্ত্ব আজ হুমকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে অনেক নদী। আরও নদী এখন মৃতপ্রায়। এভাবে একের পর এক নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের নদী বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নদী জরিপ করে নেডেকো রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ১৯৭৫ সাথে বিআইডব্লিউটিএ এর জরিপ থেকে দেশে ২৪ হাজার নৌপথের তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭৬ সাল থেকে বিভিন্ন নৌপথের নাব্যতা কমতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালে ২১৬ মাইল নৌপথ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে আরও ২১ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়। দেশে বর্তমানে সচল নৌপথের মধ্যে বারো থেকে তের ফুট গভীরতা সম্পন্ন প্রথম শ্রেণির নৌপথ রয়েছে মাত্র ৬৮৩ কিলোমিটার। সাত থেকে আট ফুট গভীরতার দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ রয়েছে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। পাঁচ থেকে ছয় ফুট গভীরতার তৃতীয় শ্রেণির নৌপথ রয়েছে এক হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার। নৌপথ রক্ষায় একটি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন।
নদ-নদী মানুষ ছাড়াও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহুু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল রয়েছে নদীতে। নদী তার আপন সৌন্দর্য হারানোর সাথে সাথে এসব প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল বিল্প্তু হচ্ছে। এসবকিছু প্রভাব ফেলছে জীববৈচিত্রে। একের পর এক নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এর সাথে জড়িত প্রত্যেকের জীবনধারণে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। যেসব নদী এখনও কোন রকমে মানুষের অত্যাচারের ফলেও টিকে রয়েছে সেসব পলি পরার ফলে তলদেশ ভরাট হয়ে আছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই দুকুল ভাসিয়ে সময়ে অসময়ে বন্যা হয়ে দুকুল ভাসিয়ে দিচ্ছে। আবার অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিনিয়তই সৃষ্টি হচ্ছে ভাঙণের। এসব ভাঙণে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় এসে দাড়াচ্ছে। দেশে বাড়ছে উদ্বাস্তু ও ভবঘুরে বেকার মানুষের সংখ্যা। মোটকথা নদীমাতৃক এই দেশে নদীর অস্তিত্বের সাথে আমাদের অস্তিত্ব ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এভাবে নদী যদি তার স্বাভাবিক গতিপথ হারায় তার বিরুপ প্রভার আমদের উপরই পরবে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই নদীগুলো টিকিয়ে রাখা জরুরী। নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের আরো কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। অন্তত যেসব নদনদী এখনো প্রবাহমান রয়েছে সেসব নদনদী রক্ষার উদ্যেগ কতৃপক্ষকে আশু নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি নদীগুলো এভাবে তাদের অস্তিত্ত হারাতে থাকে তাহলে অচিরেই পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্বকভাবে বিঘিœত হবে। যা আমাদের চিরায়ত জলবায়ুর বিরুদ্ধে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। আর এসব কারণেই দেশের নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থেকে দখলমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নদীকে দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্বও আমাদের। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে আমাদের নদী রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই