Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আকুতি মিনতি কাকুতি সব বিফলে

আনোয়ার হাকিম
১৬ মার্চ ২০২৪ ১৭:০৯

আমরা যা বলি তা করি না। করবো না জেনেও বলি। পারবো না জেনেও বলি। অঙ্গীকার করি। প্রতিশ্রুতিও দেই। এতে আমাদের যেন কোন দায় নেই। কেউ কিছু বলে না। বললে একটা কিছু বলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। যদি চুকে না যায় তা হলে তীব্রভাবে অস্বীকারের পথ তো খোলাই আছে। বেশি ঝামেলা হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে কিছু মাসল আর মানি লাগবে। আর লাগবে মিডিয়া। আর তাতেও কাজ না হলে অপেক্ষার চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই এ দেশে।

বিজ্ঞাপন

দেশে এখন নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান। কোনটা থুয়ে কোনটাকে সারাবে এরকম লেজে গোবরে অবস্থা। প্রতিদিনই নানা কিছিমের ঘটনা ঘটছে। মন্ত্রীরা পাবলিককে নানা বিষয়ে অহরহ দাওয়াই দিচ্ছেন। এই যেমন ইফতারে খেজুরের পরিবর্তে বরই খেতে বলেছেন। পাবলিক বেজায় গোস্বা করেছে তার এই বক্তব্যে। সেই ভিডিও এখন ভাইরাল। মন্ত্রী মহোদয় বলছেন তিনি এভাবে বলেন নি। মিডিয়া বলছে এই দেখুন তার প্রমাণ।

দ্রব্যমূল্য সবসময়ই মগডালে বসে থাকে। বানরের মত তা মানুষের নাগালের বাইরে থাকতে পছন্দ করে। প্রায় সময়ই তা লাফ দেয়। পাবলিক যত শোরগোল করে বানরের আনন্দ তত বাড়ে আর তার লাফ তত উঁচু হয়। সিন্ডিকেট তাদের তৈরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খেলে থাকে। পাবলিক তাদের অস্তিত্ব টের পায়। তাদের ছায়া সমেত কায়াকেও হাতে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সরকারের লোকজনেরা তা দেখে না। বলে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব টের পেলে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রী মহোদয় বলেন এদের সনাক্ত করা কঠিন। তবে সরকার সজাগ। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

ব্যাংকের ভল্ট খালি করে নিচ্ছে কিছু লোক। হাজার কোটি টাকার লোন পাশ হয়ে যাচ্ছে কাগজ পত্রের বাধ্যবাধকতাকে শিথিল করে। তদন্তের নামে বজ্র আঁটুনি ফোসকা গেড়োর ফাঁক গলে। পানির মত অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংক মুখ থুবড়ে পড়ায় অন্য আরেকটি ব্যাংকের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে যাচ্ছে। সেই ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি ব্যাংকগুলোর পুঁজিও রয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়া এই ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন সরকারের সাবেক একজন মন্ত্রী ও ডাকসাইটে আমলা। এই নিয়ে কারো কোন উচ্চবাচ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কি করে, সংশ্লিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক কারা, তারা কি করেন, কি দেখেন, কি অনুমোদন দেন এগুলোর কোন তত্ত্বতালাশ নেই। দায়- দায়িত্ব নির্ধারণের কোন উদ্যোগ নেই। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এতদিনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে নয়টি ব্যাংক রেড জোনে আর উনত্রিশ ব্যাংক ইয়েলো জোনে আছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। পাবলিকের এতদিনের কথা বাসি হতেই এই ঘোষণা জনমনে গভীর শংকার উদ্রেক করছে বৈকি। ব্যাংক গুলোর পরিচালনা পর্ষদে কারা থাকেন তা পাবলিকের জানার কথা না। সরকার তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

দুর্নীতি সর্বব্যাপী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টরালেন্সের কথা বলা হয়ে থাকে। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো এগুলোর থোড়াই কেয়ার করে থাকে। পাবলিক প্রাত্যহিক সেবা নিতে গিয়ে টের পায় সেবা পেতে সেবাপ্রদানকারীর সেবা করাই প্রাথমিক ফরয কাজ। অথচ প্রতিটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ সিটিজেন চার্টার রয়েছে। সেখানে কি ধরণের সেবা দেওয়া হয়, সেবা পেতে কি কি কাগজ লাগবে, পদ্ধতি কি, ফি লাগবে কি লাগবে না, সময় কতদিন লাগবে, সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের পদবী, তার উপর নালিশ করার কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি অনেক কিছু লেখা আছে। আছে টাইম বাউন্ড সেবা প্রদানের বাধ্যবাধকতাও। অন লাইন সেবা পদ্ধতি পাবলিকের প্রথম পছন্দ। কোন কোন দপ্তর বেশ কিছু সেবা অনলাইনে প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। বেশিরভাগ দপ্তরে এই সেবা সহজীকরণ ব্যবস্থা থাকলেও এর নেপথ্য কারিগরদের কারণে হয় সার্ভার ডাউন থাকে, নয়ত অফলাইনে কাগজপত্র হার্ড কপি আকারে অফিসে জমা দেওয়ার নির্দেশনা থাকে। এসব সবার জানা। কর্তৃপক্ষও জানেন এসব ফাঁকফোকরের কথা। পাবলিকও জানে কিতাবের কথা সব সময় সত্য হয় না। নগদানগদির ব্যাপারই হলো আসল তরিকা। ফলতঃ আমাদের কোন কিছু পরিপূর্ণ ভাবে হয় না। সব কিছু আমরা গোঁজামিল দিয়ে, নাহয় আপোষরফা করে; নাহয় উপরের লোক ধরে নিষ্পত্তি করে নিচ্ছি। নিতে বাধ্য হচ্ছি। সিস্টেম আর স্বয়ংক্রিয় হয় না।

সরকারি দপ্তরের ঊর্ধতন কেউই প্রবলেমের কথা শুনতে নারাজ। অধীনস্থরা তা জানে। তাই ধামাচাপা দেওয়ার নতুন নতুন তরিকা বের করছে। মিডিয়া সরব হচ্ছে, পাবলিক গরম হচ্ছে। আর কর্তৃপক্ষ বলছে তদন্ত করে দেখছি, দেখা হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। পরমুহূর্তেই আরেকটি ইস্যু এসে চারিদিকে শোরগোল তুলে। পেছনের ঘটনা থিতিয়ে যায়। পাবলিক যা বোঝার বুঝে নিয়ে যার যার সাধ আর সাধ্যমত দফারফা করে নেয়।

প্রতি বছর ভবনে-ভবনে, মার্কেটে-মার্কেটে বিশেষত এই সময়ে আগুন লাগে। প্রাণহানি সহ ক্ষয়ক্ষতি হয় অপরিসীম। তখন ফায়ার সার্ভিস তার পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে মিডিয়ার সামনে আবির্ভূত হয়। রাজউক তাদের তোষাখানা থেকে পুরোনো কাগজপত্র বের করে গলায় ফাঁস দিতে হামলে পরে। সিটি কর্পোরেশন বেশ তৎপর হয়ে উঠে। যেন এ বিষয়ে তাদের কোন প্রিসিডেন্টস নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের রুটিন কাজ করে যায়। ম্যানেজার গ্রেফতার হয়, কর্মচারী জেল খেটে বের হয়ে অন্যত্র দাখিল হয়ে যায়। মালিক কপালের ফেরে দন্ড পায় বা পালিয়ে বেড়ায়। পরে সব কিছু আবার সেই আগের মতই কোথাও কোন তরঙ্গ ভঙ্গ নেই জাতীয় অবস্থা বিরাজ করে। মিডিয়া লাইভ টেলিকাস্ট করে, রাতে টক শো বসে। পরদিন কর্তাদের মিডিয়া কভারেজ বাড়ে। ক্ষতিগ্রস্তদের তাতে কি হয় জানি না। এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে কিশোর যুবক হচ্ছে আর তার নির্লিপ্ততা বাড়ছে। যুবক মধ্যবয়সী চোখে এগুলো অতি স্বাভাবিক জ্ঞানে মুচকি হেসে প্রসংগান্তর করছে। তার বোধে এগুলো আমাদের এক জনমের জখম জ্বালা ভিন্ন অন্য কিছু না। এ যেন যার যায়; তার দায়। আর যারা প্রৌঢ় তারা বার্ধক্যে এসেও একই নামতা আওড়াতে দেখে বলে উঠেন, ওল্ড ইজ গোল্ড। যারা ভুক্তভোগী তারাই কেবল জানেন আগুনে ছুঁলে কী হয়? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশী বিষে দংশেনি যারে?

ব্যাবসায়ীরা রাজনীতির সুবাতাস ভোগী, ককাসের পদাধিকারী। তাদের জোট স্টেনলেস স্টীলের মত সুদৃঢ়। তাতে টোকা দিলে আংগুল আহত হয়, কঠিন ঠনঠন আওয়াজ হয়। সেই আওয়াজ ইকো হয়ে কানে এসে ধাক্কা খেয়ে কেবলই যেন বলে, লাভ নেই, লাভ নেই। এভারেস্টে টোকা দিয়ে লাভ নেই। তাই দ্রব্যমূল্যের ত্যাদর বানর সময়ে-অসময়ে শাখায়-শাখায় লাফালাফি করে। আর নিচের পাবলিকের আকুতি, মিনতি ও কাকুতিতে দাঁত কেলিয়ে জ্বালা ধরে এমন হাসি উপহার দেয়। তাই, ঈদে, রমজানে ডিসকাউন্টের পরিবর্তে চলে পাবলিক কোপানোর প্রতিযোগিতা। দেখার কেউ নেই। শোনার কেউ নেই। বলার আছে কেউ কেউ।

রাজধানীর সব ভবনের নকশার অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ রাজউক। এই প্রতিষ্ঠান সম্মন্ধে পাবলিক পারসেপশন কিরূপ তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিছু দিন পর পর সংবাদ উদঘাটিত হয় হাজার হাজার নথী গায়েব। প্ল্যান পাসে হ্যাপা। পদে পদে ভোগান্তি। কিছুদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে, এর বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোটিপতি। মন্দ লোকেরা বলে অনেকের সম্পত্তির পরিমাণ শ’, হাজার কোটিও। একটা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এরূপ আর্থিক প্রাচুর্যতা নিয়ে জনগণের উষ্মা আছে কিন্তু এখন আর বিস্ময় নেই। উঁচু উঁচু ভবন আর মার্কেটের নকশা অনুমোদনের মালিক তারা। অকুপেন্সী সার্টিফিকেটও দেয় তারা। অথচ দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যায় অজস্র ফাঁকফোকর। তাদের কোন গাফিলতি আছে কিনা জানা যায় না। উপরন্তু তারা তখন ছড়ি হাতে নড়েচড়ে বসে। বুলডোজার নিয়ে কয়েকদিন দালানে ঠোকাঠুকির দৃশ্য চিত্রায়ণ করে। পরে কি হয় জানা যায় না। ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজন যেন দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার অভিযানে সীমাবদ্ধ। আর ঘটনার সরকারি তদন্ত কাজে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে স্বরাষ্ট্র আর ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্য। উদ্ধার অভিযান ভিন্ন আর কোন কাজ যেন তাদের নেই। সম্প্রতি ধানমন্ডির কাচ্চি ভাই অগ্নি কান্ডে জানা গেল যে, তারা নাকি ভবনের মালিককে ইতোপূর্বে তিন তিন বার নোটিশ করেছিলো বিপদজনক রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য বিষয়ে। তারপর? তারপর আর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেন? এর কোন উত্তর নেই। আছে নানা কথার মারপ্যাঁচ। সিটি কর্পোরেশন গুলো নগরের সকল সংস্থার কর্তৃত্ব চায়। অথচ এই সব রেস্তোরাঁর লাইসেন্স প্রদানের দায়িত্ব তাদের। একই ভবনে এত গুলো রেস্তোরাঁর অনুমতি কিভাবে দেওয়া হলো, কারা দিলো, কেন দিলো তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। দুর্ঘটনা ঘটার পর এখন রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। সব দোষ যেন ভবন মালিক নন্দ ঘোষের। তারা ধোয়া তুলশী পাতা। এখন হয়ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর দুর্নীতি দমন কমিশনও মাঠে নামবে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী এই ক্রস ফায়ারে পাবলিকের আহত নিহত হওয়ার আশংকা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কার কতটুকু লাভ হলো তা সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সংস্থাই ভালো বলতে পারবে। প্রতিটি সেবা দপ্তরে একই অবস্থা। ঘটনা ঘটে গেলে বের হয় নানা কথা, যা সিনেমার চিত্রকল্পকেও হার মানায়।

আমাদের সর্বাঙ্গে দংশনের চিহ্ন স্পষ্ট। অথচ তা প্রশমনে আমাদের কোন উদ্যোগ নেই, কোন দাওয়াই নেই। মাঝে মাঝে নাপা, প্যারাসিটামল জাতীয় যা দেওয়া হয় তা রোগের সাথে তামাশার নামান্তর। ভাবটা এমন যে, সমাজ পচে গেছে, দ্রুত পচনশীল এই সমাজকে ফরমালিন দিয়েও দুর্গন্ধ মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। তাই মাঝে মাঝে ন্যাপথলিন আর প্যারাসিটামল দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিকীকরণের সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়। সর্বাঙ্গ ব্যাথা নিয়ে আমরা কাতরাচ্ছি। অথচ উপশমকারী কর্তৃপক্ষের ভাব এমন যে, সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ওষুধ দেবো কোথা? নীল বিষে আকন্ঠ জর্জরিত আমাদের নিত্য শত আকুতি, মিনতিতে কেউ কর্ণপাত করছে না। যেন আমাদের কাকুতির পাঁচ পয়সার মূল্যও নেই তাদের কাছে।

দুর্বলের ‘আকুতি’ যেমন বেয়ারা খায়েশ। তেমনি ‘মিনতি’ মিসকিনের মজ্জাগত। আর ‘কাকুতি’ তাদের কৌশল। আমরা এভাবেই ভাবতে-দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আশাকরি সকল কর্তৃপক্ষ নিজেদের কর্মের ও দায়িত্বের রিভিউ করবেন। শতভাগ রিয়েক্টিভ না হয়ে পরিকল্পনা মত প্রোয়েক্টিভও হবেন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আকুতি মিনতি কাকুতি সব বিফলে আনোয়ার হাকিম মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর