বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস
১৭ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৭
গোপালগঞ্জের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছায়া সুনিবিড় ছোট্ট একটি গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। গ্রামটির কোল বেয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতী নদী। এই গ্রামেই ১৯২০-র ১৭ মার্চ জন্মেছিল এক শিশু। ছোটবেলায় বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন খোকা বলে। ছোট্ট গ্রামের এ ছোট্ট খোকা একদিন হলেন বাঙালির বড় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য নামটি রেখেছিলেন তাঁর মাতামহ। আর শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু; এবং সব শেষে জাতির জনক—স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি। কথায় বলে, সকাল বলে দেয় সারা দিনের কথা। পেছন ফিরে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না শিশু খোকা কেন ও কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। শিশুটির বেড়ে ওঠা জীবনের অনেক ঘটনা ছিল যা বলে দিয়েছিল এই খোকা আর দশটি সাধারণ খোকার মতো নয়; এই খোকা ব্যতিক্রমী খোকা ছিল। কালক্রমে এই ব্যতিক্রমী খোকা হয়েছিল বাঙালির ব্যতিক্রমী নেতা।
কিশোর খোকা জীবন শুরুর দিকে একটি ঘটনা। ১৯৩৮ সাল। খোকা তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। সঙ্গে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তাঁরা ফিরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের পথ আটকে দাঁড়ালেন এই কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই বিস্মিত, কিছুটা বিব্রতও। প্রধানশিক্ষক হতভম্ব ও ক্রুদ্ধ। কিন্তু কেন এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের পথ আটকানো? কোনো দ্বিধা বা জড়তা ছাড়াই এই কিশোর দাবি করলেন যে, স্কুল ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে; তা মেরামতের ব্যবস্থা না করে মন্ত্রী দু’জন যেতে পারবেন না। কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ শেরে বাংলা জানতে চাইলেন, ছাত্রাবাস মেরামত করতে কত টাকা লাগবে? হিসেবটা আগেই করা ছিল বলেই ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন: বারো শ টাকা। টাকা তাত্ক্ষণিক বরাদ্দ হলো, ছাত্রাবাসটিরও মেরামত হলো। একজন কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তার জন্য তা সম্ভব হয়েছিল, স্কুল প্রশাসনের কোনো ভূমিকার জন্য নয়। নেতৃত্ব হঠাত্ গজিয়ে ওঠে না; নেতৃত্ব জীবনের শুরু থেকে সাধনার ফসল।এর কিছুদিন পর ঘটল আরো একটি ঘটনা। সেবার টুঙ্গিপাড়ায় ফসল ভালো হয়নি। দরিদ্র কৃষকের ঘরে হাহাকার। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিশোর শেখ মুজিব এমন ক’জন কৃষককে বাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন। তিনি ধানভরতি গোলা থেকে তাদের প্রত্যেককে ধান দিলেন। উল্লেখ্য, তিনি তা করেছিলেন বাবার অনুপস্থিতিতে এবং মাকে না জানিয়ে। পরে বাবার বকা খেয়ে তার দৃঢ় উত্তর ছিল: গরিবেরও পেট আছে, তাদেরও খিদে আছে। আমাদের অনেক আছে, তা থেকে কিছু দিয়েছি মাত্র। সেদিন ছেলের মানবিকতায় মুগ্ধ বাবা আর বকেননি। আজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাওয়া বঙ্গবন্ধুর জীবন শুরু হয়েছিল এভাবে।
শিশু-কিশোর খোকা কালক্রমে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হলেন তখনো শিশু-কিশোরদের ভোলেননি।বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তাই সংগত কারণে জাতীয় শিশু দিবসও।বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোরদের বড় ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শৈশবে বা কৈশোরে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, বাঁধনহারা আনন্দে দিন কাটিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা যাতে হেসেখেলে মুক্তচিন্তায় মুক্ত মনে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ পায় সে কথা তিনি ভাবতেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ। কিন্তু তিনি সেদিন আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন না করে শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। ’৭১-এর ১৭ মার্চ তিনি একজন বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনই কী। আর মৃত্যুদিন বা কী?’ অবশ্য আমরা তার জন্ম-মৃত্যুদিন পালন করি বিবেকী দায়বদ্ধতা থেকে।
বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল ছিল তার নয়নমণি ও বাংলাদেশের সব শিশুদের প্রতীক। এ প্রসঙ্গে জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্য লক্ষণীয়: ‘রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধুর কলিজার টুকরা। তিনি রাসেলকে এ দেশের সমস্ত শিশুর মডেল হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতার কাছে বড় আদরের। এখানে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। আমাদের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটাকে ভালো করে গড়তে হলে এই শিশুদের সঠিকভাবে গড়তে হবে। ওদের তাজা রক্তে দেশপ্রেম ঢুকাতে হবে। ওদের ভালোমতো গড়তে পারলেই আমি সার্থক।’ কথাগুলো বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি তখনকার, ভাষ্য ড. ওয়াজেদ মিয়ার।বঙ্গবন্ধুৃ বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল একজন, তাঁর হাসিও ছিল শিশুর মতো; আর তাই সারা পৃথিবীর ভালোবাসা তাঁর জন্য। রোকনুজ্জামান দাদাভাইয়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৬৩-র শীতকালে ঢাকা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আয়োজিত দশদিনব্যাপী এক শিশুমেলার কথা। এই মেলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) বলেছিলেন: ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’ অন্যদিকে, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ছিলেন মুজিব ভাই। এই সম্বোধন তিনি পছন্দ করতেন। এর ফলে বয়সের ব্যবধান ঘুচে যেত; তিনি হয়ে উঠতেন সবার একান্ত আপন, যেন আত্মার আত্মীয়। এসব গুণের জন্য তিনি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু; এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক—বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।
১৯৭২-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধা’য় যান এবং বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট চারটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এক. শিশু কল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশু কল্যাণ অধিদপ্তর । দুই. শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। উল্লেখ্য, এ দুটো প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সবসময়ই ছিল। তিন. শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩-এ ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। চার. ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ। ১৯২০-র ১৭ মার্চ যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল সে আজীবন ছিল শিশুর মতো সরল। ঘাতক চক্রের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর এ সারল্যকে কাজে লাগিয়েছিল।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই