Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সরিষার তেল গবেষণায় সফল উদ্যোগ খাদ্যনিরাপত্তা সহায়ক

ড. মিহির কুমার রায়
১৮ মার্চ ২০২৪ ১৭:৫৭

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মধ্যে সরিষার তেলই প্রধান যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৬ শতাংশ। সয়াবিন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল বীজ ফসল, যা বছরে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার টন উৎপাদতি হয়। তবে এর পুরো পরিমান নিষ্কাশন ছাড়াই পোলট্রি ফিড হিসােেব ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, ভোজ্যতেল হিসাবে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডরে পরমিাণ ৩০ শতাংরে নিচে ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরমিাণ ৫০ শতাংশের ওপরে এবং ওমগো-৩ ও ওমগো-৬ এর অনুপাত ১:২ বদ্যিমান, যা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত। ভোজ্যতেল হিসাবে সরিষার তেলেরে চাহদিা বৃিদ্ধ, অনুকূল আবহাওয়া, সরিষা আবাদে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা কৃষক র্পযায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় চলতি র্অথবছরে সরিষার উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বৃিদ্ধর কারণ। ‘কয়েক বছর আগেও মানুষ সরিষা তেল খাওয়া ভুলে গিয়েছিল। এখন সবাই সরিষা তেল খাচ্ছে। কারণ সয়াবিনের চেয়ে সরিষার তেলের উপকারিতা অনেক বেশি। এখানে উল্লেখ্য যে তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ সিিষায় এবং কমবেশি সব জেলাতেই সরষিার চাষ হয়। ডিএই সূত্রে জানা যায়, দেেেশ গত ২০২১-২২ র্অথবছরে প্রায় ৬ লাখ হক্টের জমিতে সরিষা আবাদে উৎপাদিত সরিষার পরমিাণ ছলি ৭ দশমকি ৩৫ লাখ টন এবং গত ২০২২-২৩ র্অথবছররে সরষিার আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২ লাখ হেক্টর। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ‘তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’-এর আওতায় জুন ২০২৫ সালরে মধ্যে প্রত্যাশার অনুকূলে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ েেশীয় উৎপাদন দিয়ে মেটানো সম্ভব হেব। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তেল জাতীয় ফসল সরিষা চাষের আওতায় জমির পরমিাণ বৃিদ্ধসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে সাধারণত: আমন ধান চাষের পর জমি পতিত থাকবে। এর পর সেই জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়। তেলে উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন আমন ধানের পর জমি পতিত না রেখে স্বল্পমেয়াদি সরিষার আবাদ করা। এ জন্য দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে স্বল্প জীবনকালের (১০০ থেকে ১২০ দিন) অথচ উচ্চফলনশীল আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেগুলো মূল জমিতে চারা রোপণের মাত্র ৮০ থেকে ৯৫ দিনরে মধ্যেই ঘরে তোলা যায়। এর পর জমি পতিত না রেখে উন্নত জাতের সিিষা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে পরিপক্ষ¡ হওয়ায় পর একই জমিতে আবার বোরো ধান চাষ করে প্রচলিত দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেেশ প্রায় ২২ লাখ হক্টের জমি আমন-পততি-বোরো শস্য বিন্যাসরে অর্ন্তভুক্ত (সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। বাংলাদেেশ সরিষা বপন-পরর্বতী অগ্রহায়ণ (মধ্য নভেম্বর থেেক মধ্য ডিসেম্বের) মাসে নম্নিচাপ জনিত বৃিষ্টপাতের কারণে জমিতে সাময়িক জলাবদ্ধতায় দেশি জাতের সরষিা টরি-৭সহ অন্যান্য উচ্চফলনশীল জাত নষ্ট হলেও বারি সরিষা-১৮ ও বারি সরিষা-১৯ জাত পাঁচ দিন র্পযন্ত সাময়িক জলাবদ্ধতা/জলমগ্নতা-সহিষ্ণু হওয়ায় কৃষকরা ফসলহানি থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কাজেই উচ্চফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭সহ বারি সরিষা-১৮ জােের আবাদ নশ্চিতকরণ; শস্যবিন্যাসে উল্লেখিতি সরিষার জাতগুলোর অর্ন্তভুিক্তকরণসহ পতিত জমি ও চরাঞ্চলে সরিষার জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি দেশে রফতানিযোগ্য ভোজ্য সরিষা তেল নিয়ে গবেষণায় সফলতার আলো দেখছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান। ২০২৩ সালে নতুন নিবন্ধিত তার এই ক্যানোলা গ্রেডের সরিষার জাতটির নাম ‘এসএইউ ক্যানোলা-১’। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ইরোসিক এসিডের পরিমাণ ১ শতাংশেরও নিচে থাকা জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দেশের ভোজ্য সরিষা তেলে এই ক্ষতিকর ইরোসিক এসিড (৪০-৫০ শতাংশ) থাকায় বর্তমানে উন্নত দেশের বাজারে ভোজ্যতেল রফতানিযোগ্য করতে পারে না বাংলাদেশ। এই জাতের সরিষার চাষ বাড়লে এই সমস্যার সমাধান মিলবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।

এই জাতের সরিষার ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেখা গেছে নতুন নিবন্ধিত এসএইউ ক্যানোলা-১ জাতটির ইরোসিক এসিডের পরিমাণ ০.৭ শতাংশ। পাশাপাশি জাতটিতে উচ্চমাত্রার ওমেগা-৯ (৫১%), ওমেগা-৬ (৩১%) এবং ওমেগা-৩ (৭%) থাকায় এর সরিষার তেল অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও উপকারী। জানা গেছে, উক্ত গবেষক ২০১৮ সাল থেকে ক্রুসিফেরি পরিবারের ব্রাসিকা জুনসিয়া প্রজাতির ২৫টি জার্মপ¬াজম নিয়ে কাজ শুরু করেন। জুনসিয়া প্রজাতিটি টেট্রাপ¬য়েড। এ জাতের গাছগুলোর ভিগোরিটি, প্রতিকূলতা সহিষ্ণুতা ও জীবনকাল অপেক্ষাকৃত বেশি। গবেষক নতুন এই জাতটির ইনব্রিডিং এবং রিকারেন্ট সিলেকশন, সেলফিং এর মাধ্যমে অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখেই জীবনকাল ১০৫ দিনে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে রফতানিযোগ্যতার পাশাপাশি দেশের কৃষির শস্য বিন্যাসেও অধিকতর উপযোগিতার সৃষ্টি করেছে জাতটি। ইতোমধ্যে এসএইউ ক্যানোলা-১ এর ঈশ্বরদী, পাবনা, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, সিলেটে ট্রায়াল করে সফল হয়েছেন এই গবেষক। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলায় ফিল্ড ট্রায়ালে আছে ফসলটি । মাঠের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘১৩ শতাংশ জমিতে এসএইউ ক্যানোলা-১ চাষ করার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিনের ভেতরেই হারভেস্টও হবে। সরিষার দানার মান অনেক ভালো। এছাড়া নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বীজ বপণ করলে সাউ ক্যানোলা-১ চাষের পর কৃষক লেট বোরো ধানের চাষ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জাতের গাছের উচ্চতা ১৬২-১৭৫ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৪০-৪৫ দিনে ফুল এবং ১০৫ দিনে পড পরিপক্কতা লাভ করে। গাঢ় সবুজ ও কাটাযুক্ত অমসৃণ পাতার প্রতিটি গাছে শিটির সংখ্যা ৩০৫-৩৪০টি। হেক্টর প্রতি ১.৮ থেকে ২ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন হয়। এ জাতের সরিষার বীজে তেলের পরিমাণ ৩৮ শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, সাতক্ষীরা জেলার নগরহাটে বিনা সরিষা-৭, বিনা সরিষা-৮, বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা ১৮ ও এসএইউ ক্যানোলা-১ জাতগুলোর তূলনামূলক চাষের ক্ষেত্রে প্রায় ১০৩ দিন জীবনকালে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ২.১২ টন ফলন দিয়েছে জাতটি।ক্যানোলা গ্রেডের জাতটিতে বারি সরিষা ১৮ এর তুলনায় কম ইরোসিক এসিড থাকায় এর তেলের মান আরও ভালো হবে বলে আশা করছেন গবেষকরা। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত সরিষা তেল এর মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রফতানি শিল্পেও বড় অবদান রাখবে বলে আশাবাদী তারা।

এখন দেশে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়াতে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয় ২২২ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত বছর ১৩ হাজার ৯৭৯টি প্রদর্শনী করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে ৩ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল। তবে এবার প্রদর্শনীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ১৩ হাজার ৫৭৪ টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনীতে বীজ ও সার সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমাদের যে টার্গেট, সেই সঠিক ধারাতেই রয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩ বছরে ৪০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে আনার। প্রথম বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। দ্বিতীয় বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা আশা করি তাও পূরণ হবে। এ বছর তেলজাতীয় ফসলের আমদানি ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর আগামী বছরের মধ্যেই আমরা আমদানি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারব।তিনি আরও বলেন এখন শুধু তেলের চাহিদাই বিবেচনা করা হচ্ছে না, পুষ্টির কথাও বিবেচেনা করা হচ্ছে। যাতে সঠিক পুষ্টিটা কৃষকরা পায়। গ্রামে মাঠে গেলে এখন চারদিকে শুধু সরিষা। প্রকল্পের কারণে আমদানি ইতোমধ্যেই কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত বছর ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ আমদানি কমেছে। আশা করছি এ বছর ২৫ ভাগ আমদানি কমে আসবে। তথ্যমতে, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয ভাবে উৎপাদন হয মাত্র ৩ লাখ টন, যা চাহিদার ১২ শতাংশ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এর মধ্যে আবাদ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গতবারের চেয়ে এবার প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়েছে। সরিষার আবাদ বাড়াতে হেক্টর প্রতি সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্যে গতানুগতি জাতের পরিবর্তে বারি-১৪, বারি-১৭, বারি-১৮, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দুটি ধান ফসলের মাঝখানে সরিষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোপা আমনে স্বল্প জীবনকালের ধান ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-৮৭, বিনা ধান-৭ ও বিনা ধান-১৭ এগুলো রোপনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের। এরপর স্বল্পকালীন সরিষা বারি-১৪, বারি-১৭, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা রোপন করা হয়।আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ ভাগ স্থানীয়ভাবে মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কাজ করছে সরকার। গত বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এ বছর তা বাড়িয়ে ১২ লাখ বিঘাতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগী হয়েছে ১২ লাখ পরিবার। প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের সরিষা বীজ ও রাসায়নিক সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এবারও বীজ ও সার পাচ্ছেন কৃষকরা।পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বেশকিছু এলাকায় সরিষা কাটাও শুরু হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা সহজ ও অল্প খরচে চাষ করা যায়। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি একটি সুসংবাদ নি:সন্দেহে বলা যায়।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত সরিষার তেল গবেষণায় সফল উদ্যোগ খাদ্যনিরাপত্তা সহায়ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর