Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংক ঋণ অর্থনীতিকে কি সঙ্কটে নিয়েছে?

ড. মিহির কুমার রায়
২২ মার্চ ২০২৪ ১৯:১২

চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সরকার বড় অংকের রাজস্ব ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বিগত ছয় মাসের রাজস্ব আদায়ের চলমান ধারা পর্যবেক্ষণে এ অর্থবছর শেষে ৮২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হতে পারে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আর অর্থনীতির নানাবিদ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কঠোর ও অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের মেয়াদের প্রথম বছরকেই সেরা সময় মনে করছে সংস্থাটি। সংস্থাটি বলছে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গেলে অর্থবছরের বাকি সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দরকার হবে ৫৪ শতাংশ যা প্রায় অসম্ভব। কারণ গত ৬ মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১৩ শতাংশ যদিও এ অর্থবছরে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ। এ বছর রাজস্ব আহরণ নিয়ে খুব চাপের মধ্যে আছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বিগত তিন অর্থবছরের তুলনায় মোট বাজেটের অনুপাতে আদায় হার কম। এনবিআর কর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রথম ৬ মাসে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা আদায় হয়। এটি মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এনবিআরবহির্ভূত কর বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬ মাসে ৩ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা মাত্র আদায় করতে পেরেছে এনবিআর। আদায় কম প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের পর্যালোচনায় বলা হয়, এমনিতে ডলার সংকটে এলসি খোলার জটিলতা পণ্য আমদানি খাতকে সংকুচিত করেছে। অপরদিকে বিগত কয়েক মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলছে রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর। অবরোধসহ নানা কর্মসূচির কারণে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে এসব খাত থেকে কমেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়। যে কারণে রাজস্ব আদায় ভালো থাকলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে আসে। আগামী বছর এমন একটা সময় বাজেট প্রণয়ন হতে যাচ্ছে যখন সামষ্টিক অর্থনীতি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাজেট বাস্তবায়নে নিম্ন ও শ্লথ গতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স নিচের দিকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিশেষ করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সূচক যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। বরং চরমভাবে চাপের মুখে পড়েছে। এর কারণ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দুটোই।সিপিডির মতে, রাজস্ব আহরণে ধীরগতি, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এর ফলে আমরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে। সেই স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করাটাই হবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য। এজন্য সরকারের মেয়াদের প্রথম বছরেই সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী বছর প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় জোর দেয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞাপন

অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ ছিল ১২০ কোটি টাকা বেশি। তবে আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এখন ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকে সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। এর আগে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ বেশি ছিল ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে ব্যাংক ঋণের দিকে কিছুটা ঝুঁকছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ঘাটতি ৪০ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। আবার সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ না বেড়ে জানুয়ারি পর্যন্ত উল্টো ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা কমেছে। এর মধ্যে আবার ডলারের উচ্চদরের কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের খরচ অনেক বেড়েছে। আবার আশানুরূপ বিদেশি ঋণও আসছে না। ফলে অতি প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে সরকারকে কিছু ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত নেওয়া ঋণ চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে মোট ৪৫ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিশোধ করেছে ৩৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এতে করে নিট ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকে সরকারের ঋণ স্থিতি কমে ৪ লাখ ৪ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে অনেক প্রকল্পে কাটছাঁট করা হচ্ছে।

সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ, নতুন গাড়ি বা স্থায়ী সম্পদ কেনার ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য সার এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের ৪২ হাজার কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংককে ২৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিচ্ছে। এই বন্ড না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে দিলে তাতে মূল্যস্ফীতি অনেক বাড়ত। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে সরকারের এ ঋণ মূল্যস্ফীতিতে অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে তেমন না। তবে ঋণ নেওয়া বাড়তে থাকলে বেসরকারি খাত বাধাগ্রস্থ হবে। আবার মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি সুদে ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বিল বন্ডের সুদ আয়ের বিপরীতে কোনো কর না কাটায় এখানে আকৃষ্ট হচ্ছেন অনেকে। তবে এতে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ ব্যয় প্রায় ৬০ দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠেছে। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। আর ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়ে ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে উঠেছে। গত বছরের একই মাসে গড় সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। ট্রেজারি বিলের সুদহার বৃদ্ধির ফলে সরকারের পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়েও সুদহার বাড়ছে। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থায় চলতি মাসের সুদহার উঠেছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এখন ব্যাংকারা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।এখানে উল্লেখ্য যে সরকারের ৬ শতাংশ আমানতকারীর জন্য ৯ শতাংশ ঋণ গ্রহীতার জন্য সুদের হার প্রবর্তনের পেছনে বেশ কিছু সদিচ্ছা ছিল। যেমন- ব্যাংক মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা কমানো, . ক্ষুদ্র ও সাধারণ ঋণগ্রহীতাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া, . বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ঋণহার ও আমানত হারের মধ্যে স্প্রেড কমিয়ে ব্যাংক মালিকদের মুনাফায় কিছুটা লাগাম টানা। আর ২০২০ সালে দেশের মূল্যস্ফীতিও ৫ বা ৬ ভাগের বেশি ছিল না। কিন্তু প্রথমে করোনা এবং তার পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চাপে ফেলে। অভ্যন্তরীণ কারণ ছাড়াও বৈশ্বিক অস্থিরতা, যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ঊর্ধ্বমূল্য, পণ্যের জোগান কমে যাওয়া ও দাম বৃদ্ধি দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে। বিশ্বের অনেক দেশ বেশ আগে থেকে সুদহার বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। সাধারণভাবে একটা নীতির প্রভাব পড়তে ৬ থেকে ৯ মাস, কখনও এক বছর লাগে। তবে এর পাশাপাশি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর সরকারকে নজর দিতে হবে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, যা এখন আমাদের দেশে দুই ডিজিট ছুঁইছুঁই। তবে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি যে শুধু বাংলাদেশে বিদ্যমান, তা কিন্তু নয়। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে শুরুতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রা সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ নীতি সুদহার (রেপো) বাড়িয়ে বাজারে অর্থের জোগান কমানো। স্বাভাবিকভাবেই নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ঋণ ব্যয় বেশি হয়ে পড়ে এবং বাজারে টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি কমে যায়। আবার টাকা যখন সস্তাা হয়ে যায়, তখন ব্যক্তিগত ঋণ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে ৪টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা জানায় : মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, . ব্যাংকের তারল্যের জোগান বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো এবং ডলার সংকট মোকাবিলাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো। পরবর্তীকালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের নিম্নমুখী প্রবণতার ফলে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও আমাদের দেশে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।

এখন প্রশ্ন হলো রাজস্ব ঘাটতি ও অধিক হারে ব্যাংক ঋন নির্ভরতা দুটিই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর । এতে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের উপর প্রভাব ফেলে যার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি জড়িত যা উন্নয়নের নিয়ামক। তাই অর্থনীতির স্বাস্থ্য মজবুত করার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ থাকতে হবে। ট্যারিফ রেট, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ৬ শতাংশের কাছাকাছির বিপরীতে বাংলাদেশে প্রায় ৩ গুণের বেশি, বাজারে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করের সীমা ঠিক রেখে করের আওতা বাড়াতে হবে। তা হলেই সঙ্কট অনেকাংশে নিরসন হবে ।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংক ঋণ অর্থনীতিকে কি সঙ্কটে নিয়েছে?

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর