প্যারাডাইম শিফট─এখনই ভাবার সময়
২৪ মার্চ ২০২৪ ১৭:২৮
আমাদের জীবনে কখনো কখনো বাঁক পরিবর্তন হয়। জানা-অজানা কোন কারণে স্বাভাবিক গতিধারা কখনো বৃদ্ধি পায়, কখনো শ্লথ হয়ে পড়ে। হয়ত জবুথবু হয়ে পড়ে থাকে। নয়ত হতাশাজনিত মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এটা দৃষ্টভঙ্গিগত বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণেও হতে পারে। আর জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে শারিরীক, মানসিক পরিবর্তন হয়ে থাকে শৈশব থেকে বৃদ্ধাবস্থা অবধি। ভরা যৌবনে যে ছন্দ দেহমনে ঝড় তুলে প্রৌঢ়ত্বে তা স্থিরতা খুঁজে, বার্ধক্যে খুঁজে জীবনের শেষ স্টেশনের ঠিকানা। মানুষের জীবনের এই পরিবর্তন ভেতরগত প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি। এতে দোষের কিছু নেই। এটা অলংঘনীয়।
আমাদের এক প্রজন্মেই সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, প্রযুক্তিক ও প্রায়োগিক সব ক্ষেত্রেই ঝলমলে অগ্রগতি যেমন হয়েছে তেমনি ভেতরে ভেতরে অলক্ষ্যে তার খোলনলচেও পাল্টাচ্ছে ব্যাপক ভাবে। হেসে খেলে মৌজ মাস্তি করে জীবন গড়াচ্ছে। আমরা বেঘোরে ঘুরছি, ফিরছি, হাসছি, খাচ্ছি, দৌড়চ্ছি। হঠাৎ হঠাৎ কিছু ঘটনা চমকে দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে ভাবিয়ে তোলে, বিস্মিত করে, আহত করে। থমকে দাঁড়িয়ে কেবলই দেখি আর শুনি। আর আক্ষেপ করি এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাক্তিজীবনে এরূপ পরিবর্তন তবু সহনীয় কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে বিপরীত কিছু অনবরত ঘটতে থাকলে তাতে উদ্বেগের বিষয় আছে বৈকি! প্রজন্মান্তরে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারি ।
আমরা রক্ষণশীল সমাজ থেকে কেবল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। আমাদের কাছে এখনো ‘পরিবার’ বহুমাত্রিক ভ্যালু ক্যারি করে। পিতামাতা আমাদের কাছে নায়ক, ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড। কিন্তু সেই মনস্তত্ত্বেও আজকাল চিড় ধরেছে। স্বার্থের কারণে, উটকো ঝামেলা মনে হওয়ায় পিতৃ-মাতৃ হত্যার ঘটনা এখন আমাদের চাক্ষুষ হচ্ছে। দায়িত্ব এড়াতে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা বা চলে যেতে বাধ্য করার ঘটনা এখন মোটেই আশ্চর্যজনক কিছু না। পিতার লাশ সামনে রেখে জমি জমা ভাগবাটোয়ারা করার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। কতটা ক্ষুব্ধ না হলে বৃদ্ধা মা তার আপন দুই মেয়ের জামিনের বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে নিবেদন করে? আমরা এসব দেখে যাচ্ছি, কেউ গেলো গেলো বলে বুলি কপচাচ্ছি, কেউ স্বাভাবিক জ্ঞানে বিষয়টিকে আর দশ বিষয়ের সাথে মিশাল দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছি। ব্যাক্তির এরূপ আচরণ, সমাজের এরূপ নির্লিপ্ততা কয়েক বছর আগেও এতটা প্রকট ছিলো না।
আমাদের শিক্ষার শুরুই হত পরিবার থেকে। পাশাপাশি সমাজের কাছ থেকেও পাওয়া যেত অজস্র টিপস। ধর্মীয় শিক্ষা দিত নৈতিক ভিত্তি আর জীবনের সঠিক নির্দেশনা। শিক্ষক ছিলেন অভিভাবক তুল্য। ক্লাসের শিক্ষা আর বাইরের দীক্ষা মিলে মানব শিশু ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে বেড়ে উঠত। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, নদী-নালা বিধৌত গ্রাম ছিলো নির্মল বায়ুর অফুরন্ত উৎস। আধুনিকায়নের নামে, বৈশ্বিক প্রয়োজনে দৈশিক এসব উপাদানে সাধিত হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। শিক্ষা আজ স্মার্ট পোষাক পড়েছে, দীক্ষা কলাকৌশল রপ্ত করতে শিখেছে। শিক্ষক রক্ষকের আদল পাল্টে হয়েছে শোষক, ভক্ষক। প্রাইমারি থেকে ভার্সিটির কোথাও মেয়েরা শিক্ষকদের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের বাইরে থাকতে পারছে না। ভার্সিটি পর্যায়ে আজকাল প্রায়ই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের সতীসাধ্বী তকমা ভিন্ন অন্য কোন পরিচয় থাকতে পারে না। থাকলে সমাজ নির্ঘাত তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। মেয়েদের গলায় ফাঁস নেওয়া ছাড়া তখন আর কোন বিকল্প থাকে না। সমাজ ছি: ছি: বলে মুখ ফিরিয়ে নেবে, পরিবার ঘরছাড়া করবে, রাষ্ট্র কোন দায় নেবে না। স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই সরে যাবে। বিপুলা এ পৃথিবীতে তখন তার জন্য নিজেকে নি:শেষ করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। ভার্সিটির এরূপ লাগাতার কয়েকটি ঘটনা, অভিযোগের তদন্ত না হওয়া, উল্টো অভিযোগকারিনীকে ভীতি প্রদর্শন, উৎপীড়কদের সদম্ভ পদচারণা সব কিছুই এটা প্রমান করে যে ভার্সিটিতে কোন ছাত্রীই এখন আর নিরাপদ না। হয় সতীর্থ কর্তৃক নতুবা শিক্ষক কর্তৃক তারা যৌন হেনস্তার শিকার হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো এই যে, শিক্ষক যেখানে অভিভাবক ও রক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন সেখানে তিনিই এখন ভক্ষক ও ভিলেনের মত আচরণ করছেন। শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার উর্ধতনের কাছে নালিশ করে প্রতিকার তো মিলছেই না উপরন্তু নাজেহাল হতে হচ্ছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। প্রতি পদে পদে। নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায় হলো সংক্ষুব্ধ ছাত্রীকে একই শিক্ষক বা তার সহকর্মী বা উর্ধতনরা গাঁটছড়া বেধে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে শূন্য পর্যন্ত দিতে পিছপা হচ্ছে না। এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশাসনিক, একাডেমিক ও নৈতিক অবস্থা তাহলে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? পত্রিকান্তরে প্রকাশ ভার্সিটির শিক্ষকরা এখন নাকি গভীর রাতে ছাত্রীদের মোবাইলে নানান অশ্লীল প্রস্তাব সম্বলিত এস এম এস পাঠান, চ্যাট করেন। সবই নাকি ছাত্রীর দেখভাল করার জন্য। এই এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমের উদ্দেশ্য কি? বিস্ময়, হতাশা আমাদেরকে যুগপৎ লজ্জিত ও ভয়ার্ত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখন আর লুকোছাপার বিষয় না। নিয়োগ বাণিজ্য, অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ, ঠিকাদারি কাজে ছাত্রের সাথে অর্থ ভাগাভাগি আর সর্বোপরি দলবাজি, তেলবাজি এখন অতি স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি সম্প্রতি মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষক অস্ত্র সহ ক্লাসে উপস্থিত হয়ে ছাত্রের পায়ে গুলি করে এখন থানা-পুলিশ, কোর্টকাছারির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। এতদিন তার এই সব কর্ম চাপা থাকলেও এখন বেরিয়ে আসছে অনেক কিছু। এরূপ শিক্ষকের এরূপ আচরণের, সাহসের উৎপত্তি স্থল কোথায়? আরেক মেডিকেল ভার্সিটির উপাচার্যকে তার শেষ কর্মদিবসে তারই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবরুদ্ধ করে রেখে নানা অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে তাদের দাবী উত্থাপন করেছে। ঢাকার বাইরের আরেক ভার্সিটির নারী উপাচার্যের বিষয়েও শেষ দিন এন্তার অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ উঠেছে। আরেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অপ্রাপ্য অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ সামনে এলে তিনি তা ফেরত দিতে সম্মত হয়েছেন। এরকম প্রায়ই হচ্ছে। এসব কিসের ম্যাসেজ দেয়? এসব নিয়ে ভাবা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির হিসেব বেশ জটিল। অনেক এক্সটার্নাল আর ইন্টারনাল ফ্যাক্টরের উপর তা নির্ভরশীল। দ্রব্যমূল্য ভেলকি দেখাচ্ছে, সিন্ডিকেট আখের গোছাচ্ছে আর পাবলিক তার জীবনোপকরণ সংখ্যায় ও পরিমাণে কমাচ্ছে। একে ‘সহনশীল অর্থনীতি’ হিসেবে নতুন নামকরণ করা যেতে পারে। পাবলিকের আমানতে ব্যাংক হয়। সেই ব্যাংক যারা করে তারা নিজেদের পুঁজি বৃদ্ধি করে। তারল্য সংকট বাড়ে। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলেও অপর ব্যাংকের উপর ভর করে চলার সহজ নীতির নাম হলো মার্জার। এটা বিধিবদ্ধ হাতিয়ার সন্দেহ নাই। কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধানের কোন উদ্যোগ নেই। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে যারা থাকেন তাদের ভূমিকা কী─ তা কেউ প্রশ্ন করে না। গভীর সংকটে নিপতিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্ধারকারী জাহাজের মত যে ব্যবস্থা নেয় তা কতটা যৌক্তিক? ভল্টের টাকা নির্বিঘ্নে বের হয়ে যাচ্ছে, পাচারও হয়ে যাচ্ছে। তাহলে এদের দেখভাল করার দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কে? কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর নিজেই বলেছেন ৯ ব্যাংক লাল তালিকায় আর ২৯ ব্যাংক জন্ডিসে আক্রান্ত। সম্প্রতি একটি ব্যাংক অপর একটি ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়েছে। আরো গোটা দশেক নাকি হওয়ার অপেক্ষায়। পাবলিক উদ্বিগ্ন তাদের আমানত কখন কোন ভূতের আছরে খেয়ানত হয়ে যায়। তারা তাদের সঞ্চয় নিয়ে আশ্বস্ত থাকতে চায়। হাজার হাজার কোটি টাকা নির্বিঘ্নে পাচারের এই প্রবণতা কবে কি ভাবে শেষ হবে কে জানে? দান মেরে বড় লোক হওয়ার এই তরিকা এখন সবচেয়ে সহজ ও ফলদায়ক হিসেবে ক্রমেই সংক্রমিত হচ্ছে।
হাল আমলের মারাত্মক আরেক রোগের নাম ট্রান্সজেন্ডার। মনে হওয়া রোগ থেকে এর উৎপত্তি। পুরুষ আর পুরুষ হিসেবে থাকতে সন্তোষ বোধ করছে না। মনে মনে সে নিজেকে মেয়ে ভাবতে শুরু করেছে। পুরুষে পুরুষে আসক্তি ও বিয়ে, নারীতে নারীতে প্রেম ও বিয়ে এখন ট্রেন্ডিং হয়ে দেখা দিয়েছে। সমকামিতা আদর, কদর পেতে শুরু করেছে। লিঙ্গান্তর সময়ের ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে। হিজড়ার সাথে ট্রান্সজেন্ডারকে গুলিয়ে বিষয়টি একান্তই প্রাকৃৃতিক বিপর্যয়ের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করে সফট কর্ণার আদায়ের কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের কৌতুহলী-মন, ঔৎসুক্য-বিলাস এখন সমাজের নবতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এদের পেছনে কেউ সক্রিয় কিনা জানার উপায় নেই। এদের অনেকের কাছে এখন আইডল হচ্ছে “না পুরুষ না নারী”র আদল নেওয়া কোরিয়ার বিখ্যাত ব্যান্ড দল, বিটিএস।
ইদানীং আরেক উপদ্রব দেখা দিয়েছে। তা হলো বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা-র দ্বার পরিগ্রহণ। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে যার নাম সুগার ড্যাডি। শিক্ষিত তরুণীরা বুড়োতে নিজেদের নিশ্চিত ও স্বাধীন জীবন বেছে নিচ্ছে। বৃদ্ধরা অকাতরে তাদের সম্পদ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সঙ্গসুখ ভোগ করছে। এরিমধ্যে সমাজে এদের উঁচু গলাও শুনা যাচ্ছে।
আরেকটি রোগ এখন মার্কেটে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেটা হলো মডেল, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, সেলিব্রেটি, টিকটকার আর ইউটিউবার। দেশে এখন এরাই একেক প্লাটফর্মে একেকজন অসম্ভব জনপ্রিয় আইডল। এদের সামনে কোন শিক্ষক নেই, বুদ্ধিজীবী নেই, বিজ্ঞানী নেই, গবেষক-প্রশাসক নেই। শিল্পী-সাহিত্যিক নেই। এদের জন্য থাকে লক্ষ জনতার উত্তোলিত জোড়া হাত, মুখে থাকে রতি সুখের অর্গাজম। গাঁটের টাকা উড়িয়েও যেন প্রশান্তি, চিত্তসুখ, নয়নসুখ। রুচির দুর্ভিক্ষ বলে মন্তব্য ছুড়ে বিরুদ্ধ জোয়ারের প্রাবল্যে ভেসে যাওয়া এককালের প্রথিতযশা বর্তমানের ‘ঠিক ঠিক সার্টিফিকেট’ প্রদানকারীরা আজ শীত নিদ্রায়। কোনদিন জাগিবে কি তারা? জাগিবার তাগিদে? এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে হয়ত এদের নিয়ে এরূপ কিছুই লিখতেন।
সমাজের গতিপথ কোন স্থির জিনিস না। কিন্তু তার যাত্রা পথ যদি গন্তব্যকে অস্পষ্ট ও অজানা আশংকায় আতংকিত করে তুলে তাহলে তা জাতির জন্য অশনি সংকেত বৈকি। প্যারাডাইম শিফটের এই সব বিষয় ইতোমধ্যেই তার যাত্রা পথে অনেকটা অগ্রসর হয়ে গেছে। আমরা কি তা টের পাচ্ছি? এ নিয়ে এখনই ভাবা জরুরী হয়ে পড়েছে। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এজেডএস