ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২০
প্রতিবছর চাঁদের হিসাবে ঈদ আসে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র আগাম প্রস্তুুতিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। সেই সাথে চারিদিকে সাজ সাজ রব উঠে। যে যার দায়িত্ব পালনে উঠে পড়ে লেগে যায়। সবই ঠিক আছে শুধু ছেলেবেলার ঈদানন্দের সেই জমাট বাধা উত্তেজনাটা আর তেমনটি নেই।
তখন আটপৌরে জীবন ছিল। সবারই একটা ছিমছাম প্রত্যাশা ছিল। ডামাডোল ছিল, হৈ- চৈ ছিল। মারামারি, রাগারাগি, ভুল বুঝাবুঝি ছিল। মান-অভিমান ছিল। বায়না, আবদার সবই ছিল। তখন একজনের ইচ্ছে পূরণে অনেকেই মুখিয়ে থাকত। নিজে থেকে উপলব্ধি করত অপরের শখের ব্যারোমিটার। তখন এত জৌলুস ছিল না। তবে হৃদ্যতা ছিল অফুরান। পরিবার ছিল সকল মুসিবতের সেফ গার্ড। একের দুঃখ ভাগাভাগি করে নিত সবাই। পাশে এসে দাঁড়াত কোন রকম ভান-ভণিতা ছাড়াই। আনন্দে পুরো পরিবার উদ্বেলিত হত।
উৎসবে সবাইকে হাস্যোজ্জ্বল রাখতে পরিবার প্রধানদের, সিনিয়রদের নিরলস প্রচেষ্টা ছিলো। নতুন জামা বানানো বা কেনা থেকে শুরু করে জুতো-মুজো, গেঞ্জী, লেস-ফিতা-আলতা-লিপিস্টিক, আতর-সুগন্ধি ইত্যাদির লিস্ট যেন ছিল মুখস্থ। সেমাই ছাড়া ঈদ কল্পনাও করা যেত না। পোলাওয়ের সাথে কোরমা ছিল মানিক জোড়ের মত। আজকাল ঈদের খাদ্য তালিকায় অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে কিন্তু কোরমা আর তেমন দেখা যায় না। আব্বা-আম্মা’র পেরেশানী টের পেতাম না। তাহলে কি মধ্যবিত্ত পরিবার প্রধানের টেনশন হত না? নিশ্চয়ই হত। কিন্তু তারা তা বুঝতে দিতেন না।
ঈদের এক গাদা রকমারি রান্না করতে করতে আম্মার মুখে কখনো ক্লান্তি বা অস্বস্তি ভাব দেখি নি। তারও কি ক্লান্তি লাগত না? নিশ্চয়ই লাগত। কিন্তু সেই ক্লান্তি ভুলে যেতেন পরিবারের সবার মুখের অগ্রীম হাসি অনুমান করে। সকাল, দুপুর, রাত্রি, মধ্য রাত অবধি রান্না ঘর আর সবার দেখভাল করে। তখন তার আর নিজেকে দেখভাল করার সময় থাকত না। তখন সময়টাই ছিল অন্যরকম। পিঠাপিঠি ভাইবোনের উৎপাত ছিল, ঠোকাঠুকি ছিল, মারামারিও ছিল। আবার গলায় গলায় ভাব ছিল। তখন এত কিছু প্যাচগোজ ছিল না। সব কিছু ছিল সোজাসাপ্টা।
ঈদের গরু কেনার আনন্দ ছিল বিশ্বকাপ জয়ের মত। সেই গরু এনে তাকে ঘাস,ভূষি, ভাতের মাড় খাওয়ানো থেকে আরম্ভ করে সিসি ক্যামেরার মত সারাক্ষণ নিরীক্ষণ করতে করতেই আমাদের দিন গড়িয়ে যেত। বন্ধুরা আসত গরু দেখতে। আমরাও যেতাম। আমাদেরটাই সেরা এমন বোধ ছিল। প্রকাশও ছিল সেরকম। আব্বা,আম্মা, বয়ষ্কজনেরা বলতেন কোরবানীর পশু নিয়ে এমন কথা বলতে নেই। সবারটাই সেরা। আল্লাহ যেন সবার কোরবানীই কবুল করে নেন। এরকম ভাবে নীতি আর ধর্মীয় শিক্ষার ভ্রাম্যমাণ পাঠ হয়ে যেত আমাদের। বিকেলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাড়ী ঘুড়ে ঘুড়ে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম। আংকেল-আন্টিরা তাদের বাসায় না গেলে গুনে গুনে জিজ্ঞেস করতেন, ওরা কেন এলোনা? আব্বা-আম্মাও খোঁজ করে তাগিদ করে নিয়ে আসতেন বন্ধুদের। তখন এত টেলিফোন ছিল না। যে যার কর্তব্য মনে করে এসে কুশলাদি বিনিময় করে যেত।
সমবয়সীরা দল বেধে পাড়া বেড়াতাম। সিনিয়রা বড় রাস্তার মোড়ে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দ করত। আমরা দূর থেকে দেখতাম। কাছে যাওয়ার সাহস ছিল না। জুনিয়ররাও দলবদ্ধ হয়ে যাতায়াত করত। তাদের দেখে আমরাও সিনিয়রের ভাব ধরতাম। এভাবেই আদবের প্রাথমিক ব্যবহারিক শিক্ষা হয়ে যেত। মুরুব্বীদের দেখে পা ছুঁয়ে সালাম না করা পর্যন্ত শান্তি ছিল না। পাছে বেয়াদবি বলে গণ্য হয়। কিন্তু বড় হয়ে জেনেছি মাথা নিচু না করে, পা না ছুঁয়ে, হাত তুলে মুখে উচ্চারণ করে সালাম দেওয়াই শুদ্ধ। সালামের সাথে সালামীও ছিল। এটা অনেকটা নেশাও ছিল। আবার চাহিদা যৎসামান্য থাকায় এক দুইজনের কাছ থেকে পেলেই সেই টাকা দিয়ে হাওয়াই মিঠাই, মালাই আইসক্রিম কিনে খেতাম। পয়সায় টান পড়লে ভাগাভাগি করে খেয়েছি।
সেদিন পড়াশোনার চাপ থাকত না। সবার মেজাজই থাকত ফুরফুরে। আনন্দ আর খাওয়া-দাওয়া, নতুন জামা পড়া আর দেখিয়ে বেড়ানোই ছিল মুখ্য কাজ। এতেই সুখ, এতেই আনন্দ। দিনটা যে কত দ্রুত চলে যেত তা টেরই পেতাম না। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাযের সময় মন খারাপ হয়ে যেত। পরিবারের কঠিন আদেশ ছিল আযানের পর আর বাইরে থাকা যাবে না। রাতে আত্মীয়রা আসত, প্রতিবেশীরা আসত। বাসাময় আবার আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠত। আমরাও যেতাম। কখনো আব্বার সাথে, কখনো আম্মার আঁচল ধরে। আবার কখনো একাই। যেদিকেই তাকাতাম আনন্দ আর আনন্দ। সবার মুখে হাসি আর হাসি। এরিমধ্যে গরীবদের দান-খয়রাত চলত সমান তালে। তাদের জন্যও থাকত বরাদ্দ।
নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবী আর টুপি পড়ে, আতর-সুগন্ধি লাগিয়ে সবাই পায়ে হেঁটে দল বেধে নামায পড়তে যেতাম ঈদগাহে। যাওয়ার সময় আব্বার হাতে অনেক খুচরো টাকা দেখতাম। ভিক্ষুক থেকে শুরু করে যত হতদরিদ্রের দেখা মিলত রাস্তার দু’পাশে। তাদের হাতে গুঁজে দিতেন। কখনো আমাদের হাত দিয়ে দিতেন। আমরাও দানের আনন্দে উৎফুল্ল হতাম। দানের এই বাল্যশিক্ষা তখন থেকেই মননে-মগজে গেঁথে গিয়েছিল। নামায শেষে পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার সাথে কোলাকুলি করার আনন্দ ছিল স্বর্গসুখের মত। ঈদের নামাযের নিয়ম বড় খিটমিটে লাগত। আব্বা বলতেন তাঁকে অনুসরণ করতে। আমরাও তাই করতাম। তবু ভুল হয়ে যেত। তাকবীরের কমবেশি হয়ে যেত। তাতে কি?
রোজার ঈদ শেষে বিষন্নতা ভুলে যেতাম কোরবানী ঈদের কথা ভেবে। আর কোরবাণী ঈদের আনন্দের তো শেষ নেই। আস্ত গরুর মাংস আছে না? সকালে ঘুম থেকে উঠে চালের আটার রুটি দিয়ে কোরবাণীর ঝুরি মাংসের স্বাদই আলাদা। কোন দিন ঢিলা খিচুড়ির সাথে।
দুই ঈদেই রেডিওতে বাজত সেই বিখ্যাত গান, ‘রমজানের ঐ দিনের শেষে এলো খুশির ঈদ’। গানের সাথে প্রানটাও নেচে উঠত প্রশান্তিতে। আব্বার সরকারি চাকরি থাকায় কখনো কখনো কর্মস্থলেই করতে হত ঈদ। সেটাও ছিল অন্যরকম আনন্দের। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি আর আব্বার কলিগদের সাথে ঈদের আনন্দ শেয়ার করার মধ্যে থাকত নতুনত্ব। বিশেষতঃ এলাকাভেদে খাওয়া-দাওয়া ও আতিথেয়তার ধরণে থাকত বৈচিত্র্য। সেটাও উপভোগ করতাম। সুমধুর সেই সব স্মৃতি-সুখ আজো অম্লান হয়ে আছে মনের গহীনে। ভীষণ শক্তপোক্ত হয়ে থাকা এই সব স্মৃতি ডিলিট করা যায়না মেমোরি থেকে। তাই, আজকালকার ঈদের সাথে তুলনায় যাবোনা কখনোই। থাকনা মনের কুঠুরীতে পাটপাট করে সাজিয়ে রাখা আমাদের সেই ঈদের স্মৃতিগুলো। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ বলে কথা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই