আমরা আসলেই বেশ বদলে গেছি
২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৪
ফাতেমা তুজ জোহরার কন্ঠে একটা গান আজ থেকে পচিশ তিরিশ বছর আগে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। গানের কথা ছিলো, ‘তুমি বেশ বদলে গেছো, পুরোনো সৈকতে আর পানসি ভেড়াও না’। বাস্তবিকই তাই। আমরা আজ অনেক অনেক বদলে গেছি। এখন আর পুরোনো পথে হাঁটি না। হাঁটলেও ফায়দা নিতে চেষ্টা করি। ফায়দার সম্ভাবনা না থাকলে নির্মমভাবে তাকে এড়িয়ে চলি, পরিহার করি। পারলে ধূলিস্যাৎ করে স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলি।
কথা দিয়ে কথা না রাখা বাঙ্গালির এক ধরণের বিশেষ ক্যারিশমা। এ নিয়ে সুনীল আক্ষেপ করে বিলাপ করলেও কেউ তার কথা শুনে নি। সবাই তাকে শুধু প্রবোধই দিয়ে গেছে। সেই রোগ এখন আরো প্রকট হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভঙ্গ করা এখন আর আলাদা অর্থ বহন করে না। রাজনীতিবিদরা আমাদের শিখিয়েছেন কথা কিভাবে দিতে হয়, কি ভাবে টুয়িস্ট করতে হয়। আর সময়ান্তরে তা কিভাবে ডিলিট করে দিতে হয়। সরকারি কর্তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিশ্রুত সেবা-সাহায্য এত সহজে লভ্য হওয়ার না। আমাদের সমাজ জীবনের সর্বত্র আজ কথা দিয়ে কথা না রাখার প্রতিযোগিতা চলছে। কথা কেন বলি, সেই কথা রাখা যাবে কি যাবে না, এর এখতিয়ার আমাদের আছে কিনা, থাকলেও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আসলেই তা আদৌ দেওয়া সম্ভব কিনা তা খতিয়েও দেখি না। কথা দিয়ে কথা রাখতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা তা নিয়েও আমরা গা করিনা। উপরন্তু তা নিয়ে গলাবাজি করতেও ছাড়ি না। আমরা ক্রমান্বয়ে বিস্মৃতিপরায়ন জাতি হিসেবে পরিগনিত হচ্ছি। এতেও আমাদের কোন মন্দলাগা ভাব নেই। নীতি-নৈতিকতার কথা তো পরের বিষয়। রাজনীতিবিদদের এই ভেল্কিবাজি দেখে, হতাশ পাবলিক এখন কথা দেওয়া মানে ‘কথার কথা’ মানে ‘বাজে কথা’, মানে ‘উটকো কথা’ হিসেবেই ধরে নিয়েছে। যারা কথা দেন তারাও জানেন কথা রাখার ন্যুনতম কোন দায়বদ্ধতা তাদের নেই। তাই, তারা ফ্রি স্টাইলে কথা বিতরণ করেই যাচ্ছেন আর প্রতিশ্রুতির রং-বেরংরে মূলা দেখিয়েই যাচ্ছেন। যারা সেই কথা শুনে আশায় বুক বাধেন তাদের কপালে কেবল শূন্যই জোটে না, বেগাড় প্রতীক্ষার অসহনীয় যাতনাকালও তাদেরকে পার করতে হয়। তাই, কথা দেওয়া আর কথা না রাখার বিষয় এখন তেমন বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন করে না। অথচ কি ধর্মে কি সামাজিক প্রথায় কি চক্ষুলজ্জায় কি পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদেই আমাদেরকে কথা ও কাজের মধ্যে সমরূপতা বজায় রাখা দরকার। অথচ আমরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে অকাতরে কথা দিয়ে যাচ্ছি। রাখার দায়িত্ব লাভালাভের উপর। ব্যাক্তি, দল ও গোষ্ঠীর অভিরুচি, দয়া-অনুকম্পা আর ইচ্ছা-অনিচ্ছার খায়েসের উপর।
আমানতের খেয়ানত করা এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখে সরকার আর ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা রেখে, তাদের বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণায় বিশ্বাস করে। গ্রাহকের সেই টাকা রাতারাতি কতিপয় রক্ষকসহ আরো কতিপয় রাক্ষসের সহায়তায় রাতারাতি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে কয়েক দিন হৈ চৈ হয়। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সরব হয়। রাতের টক শো-তে কেউ কেউ গলার রগ ফুলিয়ে ফেলেন। পরে আর কিছু হয় না। এখন নতুন অলংকার হিসেবে গ্রাহককে বলা হচ্ছে অন্য একটা শক্তিশালী ব্যাংকের সাথে আইসিইউ-তে থাকা তাদের ব্যাংকের সহমরণ যাত্রার কথা। গ্রাহকের এত এত টাকা গেল কই – এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় না। সময়ে সময়ে হঠাৎ কিছু তথাকথিত অপরিহার্য ‘হলুদ’ বুদ্ধিজীবির আবির্ভাব ঘটে মঞ্চে। তারা ভুজুং ভাজুং কিসব যেন বলেন। আর গ্রাহকই বা কি যেন বুঝে! না বুঝেই বা উপায় কি?
দায়িত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন না করাও আমাদের মজ্জাগত অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। দায়িত্ব পালনের চেয়ে দায়িত্বের চেয়ার রক্ষা করাই যেন জরুরি হয়ে পড়েছে এখন । তাই, আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মত হিজ মাস্টার্স ভয়েস সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। এতে বেশুমার লাভ। ঝুঁকিমুক্ত আয়েসি ও বিলাসী জীবন যাপনের জন্য আর কি চাই?
দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন এখন কিতাবে পাওয়া যায়। বাস্তবে হচ্ছে উল্টো চর্চা। চারিদিকে যাদেরকে দেখবেন অতিশয় ধড়িবাজ, দোর্দ-প্রতাপশালী ও ভয়ানক প্রকৃৃতির তারা তত বেশি সুরক্ষা বলয়ে থেকে দায়মুক্তি নিয়ে বসে আছে। আর যারা নীতি-নৈতিকতায় সমৃদ্ধ, সুবিবেচনা যাদের অলংকার এবং কথা ও কাজে যারা বরাবর তারা তত পশ্চাতে জবুথবু, হয় ভীত নাহয় গুটিয়ে নেওয়া শামুক বিশেষ হয়ে বসে আছে। তাদের কন্ঠে রা নেই। চোখের জ্যোতি ক্ষীণ। কানে তুলো দেওয়া। বিপরীতে সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্জনেরা। তাদের পৃষ্ঠপোষকের অভাব নেই। হিতাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। তাদের আওয়াজ বড় চড়া, চক্ষু বড় বেশি রক্তিম, শিরার রক্তে আগুনের হল্কা বড় বেশি দাপাদাপি করে। সুবিবেচনাবোধ বলে এদের কাছে কিছু নেই। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। এদের কাছ থেকে বিনিময় ছাড়া সহানুভূতি প্রাপ্তির আশা অলীক কল্পনা মাত্র। এদের আছে সবল উপরস্থ, আছে মাত্রারিক্ত ক্ষমতা, রয়েছে অসীম অর্থের সাপ্লাই লাইন। আর আছে করিৎকর্মা কিছু প্রভুভক্ত সারমেয়।
সীমা লংঘন করার সংস্কৃতি আমাদের কাছে শৌর্যবীর্য প্রদর্শনের আরেক ক্যারিশমা বিশেষ । সমাজের সর্বক্ষেত্রে যোগ্যদেরকে স্থানচ্যুত করে অযোগ্যরা আসন আলোকিত করে বসে আছে। জায়গামত যথোপযুক্ত কেউ নেই। বাস্তবেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের কোথাও ট্রাক স্ট্যান্ডের জন্য নির্ধারিত স্থানে ট্রাক থাকেনা। বাস স্ট্যান্ডে বাস থাকে না। থাকলেও সামনের রাস্তার দুই পাশ দখল করে রাখে। রিক্সা স্ট্যান্ডে রিক্সা থাকে না। নো পার্কিং জোনে গাড়ী পার্কিং অতি স্বাভাবিক। পথ পাশের দোকান তার নির্ধারিত চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নিজের মনে করে সামনের ফুটপাত দখল করে রাখে। তা না হলে অন্তত পক্ষে দোকানের ছাউনি রাস্তার উপর পর্যন্ত টেনে দিয়ে পরিসীমা বাড়ায়।
আমাদের মাত্রা জ্ঞানের বড়ই অভাব। কোথায়, কখন কীরূপ আচরণ করতে হবে তা আমাদের জানা নেই। জানা থাকলেও খেয়াল থাকেনা। খেয়াল থাকলেও তোয়াক্কা করি না। ফেসবুক আর টক শো আমাদের এই মাত্রা জ্ঞানের অভাবকে আরো চাউর করে দিয়েছে। টক শো-তে বসে শিক্ষিত নামধারীরা যে ভঙ্গীতে আর উঁচু গলায় পরস্পরের শ্লীলতাহানি করেন তা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। রাজনীতিবিদরা একে অপরকে যে ভাষায় পচান নিম্ন শ্রেণীর লোকেরাও সেরকম করে কিনা সন্দেহ। আজকাল ফেসবুকে এসে লোকজন নিজেদের বেডরুম, কিচেন, ডাইনিং, টয়লেটকেও সর্বসাধারণের দ্রষ্টব্য হিসেবে মেলে ধরছেন। লাইক, ভিউ, কমেন্টস আর নিজেদেরকে সেলিব্রেটি পর্যায়ে উন্নীত করার মানসে। নিন্দুকেরা বলে এতে ডলারের প্রভাবও আছে। প্রাইভেসি বলে এখন আমাদের আর কিছু থাকছে না।
আজকাল কেউ নীতিকথা বললে পাবলিক তাকে হয় ফন্দিবাজ ভাবে নয়ত অচল মাল জ্ঞান করে। কেউ সত্য কথা বললে তার মাথার স্ক্রু ঢিলা বলে পরিহাস করে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে টাইট দিতেও ছাড়ে না। ভালো লোক বলে যার সুনাম সর্বজনবিদিত তার ভোগান্তি পদে পদে। সে তার পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে দারুণ ভাবে উপেক্ষিত ও পরিত্যাজ্য। জ্ঞানের কথা বললে মানুষ এখন গোস্যা করে। ক্ষিপ্ত হয়ে নেংটা করে ছাড়ে। কখনো কখনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করে।
এদেশে এখন অর্ধশিক্ষিতদের বেজায় দাপট। এরা আমাদের মডেল, সেলিব্রেটি, টিকটকার, ইউটিউবার, ভøগার ও নিম্নমানের ইনফ্লুয়েনসার। পাবলিক এদের কথা শোনে। এদের জন্য জান কোরবান করতেও দ্বিধা করে না। এদের জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করতেও তাদের কলিজায় এতটুকু টান পড়ে না। অন্যদিকে শিক্ষিতরা দ্বিধাবিভক্ত। একদল সবার অলক্ষ্যে শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আরেক দল প্রভুর কীর্তনে সারাক্ষণ পেরেশান। তাতে লাভ বেশি। নগদে ও উপঢৌকনে। পদকের লোভ, হাই প্রোফাইলে লেফট- রাইটের সুযোগ কে হাত ছাড়া করতে চায়?
কোথাও কোন সেবা নির্বিঘ্নে পাওয়ার উপায় নেই। সবাই তা জানে। সত্য জ্ঞানে তা মেনেও নিয়েছে। সেবা যারা দেন তারা সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করেন। তাদেরও এর বাইরে গিয়ে উদ্যোগী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বেশি পাকামো করলে ভাগাড়ে সমূলে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।
এর বাইরে যারা আছে তারা অগণিত জনসাধারণ। তারা উপেক্ষাযোগ্য। এরা লাইনে দাঁড়ায় আর ভাবে এই বুঝি তার সময় এলো। অমনি পেছন দরোজা দিয়ে সেবা শেষ হয়ে যায়। দিন শেষে মুখ কালো করে ফিরে আসে। এরা ওদের কথা শুনে আর মনে করে এই বুঝি কথা দিয়ে কেউ কথা রাখতে চলেছে। পরক্ষণেই আশাভঙ্গ হয়। এরা অন্যের কথায় স্বপ্ন দেখে। তাই, অহরহ স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আবার নতুন আশায় স্বপ্নের জাল বুনে। এরা হতচ্ছারা। এদের অনেকেই কেতাদুরস্তদেরকে ত্রাতা হিসেবে মেনে পিছু পিছু ঘুরে। দিন শেষে আগামীর প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাড়ী ফিরে। কেউ কেউ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কিছুমিছু পায়।
মোটকথা আমরা আসলেই বদলে গেছি। স্বভাব-চরিত্রে, আচার-আচরণে, ক্রিয়া-কর্মে। সভ্যতা-ভব্যতায়, নীতি-নৈতিকতায়। আমাদের এই বদলে যাওয়া গিরগিরটির রঙ বদলের মত, চোখ উল্টে দেওয়া অতি নিকটজনের মত। আমাদের কোন চক্ষুলজ্জা নেই, অনুতাপ-অনুশোচনাও নেই। পাছে লোকে কি বলবে জাতীয় কোন বোধও নেই। বরং আছে কেউকেটা হওয়ার তৃপ্তিবোধ। আছে প্রভাবশালীর তকমা পাওয়ার উদগ্র বাসনা। আমরা আসলেই ভেতর-বাইর থেকে ভীষণভাবে বদলে গেছি। আমরা গানের কথার মত আর পুরোনো সৈকতে পানসি ভিড়াতে চাই না। তার পরিবর্তে নতুন নতুন সৈকত তৈরি করে সেখানে নোঙ্গর ফেলতে অভিলাষী। এ অবস্থা থেকে ইউটার্ণ কবে, কীভাবে হবে জানা নেই। সুদিনের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই