খাদ্যে ভেজাল: প্রতিকার এবং শেষ কোথায়?
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৮
চারদিকে ভেজাল আর ভেজাল। জল-স্থল, হাট-বাজার, গ্রামে-গঞ্জ- কোথায় নেই ভেজাল! ভেজালে নিমজ্জিত হয়ে আছে গোটা দেশ এবং আমাদের কাল। এখন সবাই যেন ভেজালাতঙ্কিত। ভেজালের ভিড়ে আসল নির্বাসিত। ঘর হতে দু’পা বাইরে যান, কিছু কিনে আনবেন বা কিছু খাবেন তো বড় বড় চোখ করে দেখছেন; কিন্তু কণ্ঠস্বরে অসহায় মৃদু আওয়াজ- আসল হবে তো ভাই? সন্দেহ যেন থেকেই যাচ্ছে। অথচ টাকা দিচ্ছেন আসল, জিনিসটা নকল। নকল বা দেখতে হুবহু একটা জিনিস হয়তো আপনাকে সরাসরি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে না বা বড় ক্ষতি করছে না। কিন্তু নকল বা ভেজাল খাবার কিন্তু কাউকে কখনও ছেড়ে যাচ্ছে না। ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যের মাধ্যমে নানা অনিরাময় ও অসংক্রামক রোগবালাই সন্তর্পণে আপনার মধ্যে বাসা বাঁধছে। জানা যায়, শিল্পের প্রয়োজনের চেয়ে কয়েকশ গুণ অতিরিক্ত ফরমালিন আমদানি হচ্ছে। মাছ-মাংস, ফল-জল, চাল-ডাল, পানীয়, সবজিতে নিত্য ভেজাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে ক’দিন সুস্থ থাকা সম্ভব? এমন পরিস্থিতিতে এখানে বাহ্যিকভাবে সুষম খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেও কি আদৌ বাঁচা সম্ভব? এখানে দুর্ভাগ্য, ভেজাল খাবারের ফলে অসুস্থ হয়ে তাৎক্ষণিক উপশম পাওয়ার জন্য যে ওষুধ সেবন করবেন, তাতেও যদি ভেজাল থাকে তবে কী? আমাদের সবারই প্রশ্ন- এর প্রতিকার এবং শেষ কোথায়?
মানুষের নৈতিক বিপন্নতার অনেকগুলো উপসর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে খাদ্যপণ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা। হ্যাঁ, এখানে সচেতনভাবে বিপন্নতা শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে আজ খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার মাত্রা ও মাত্রিকতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মানুষের নৈতিকতা আর অবনমন পর্যায়ে নেই, এটি এখন বিপন্নতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি অধিদপ্তরসমূহের অভিযান কিংবা গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সূত্রে খাদ্যদূষণের যে নিত্যকার ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তাতে মানুষ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয়। বস্তুত, সমাজ ও মানুষের মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধপ্রবণতা বাসা বেঁধেছে। তারকাখচিত রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে গ্রামের একেবারে সাধারণ খাবারের দোকানেও ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। নামিদামি খাদ্যপণ্য উত্পাদক প্রতিষ্ঠান থেকে বিএসটিআইয়ের নিবন্ধনহীন অবৈধ কারখানা—সবাই প্রায় একই ধরনের অপরাধে জড়িত। কারো হলুদের গুঁড়ায় হলুদ নেই তো কারো লবণে আয়োডিন। কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ সয়াবিন তেল রিপ্রোডিউস করছে তো, কেউ নষ্ট খেজুর নতুন মোড়কে বাজারজাত করছে। বাদ যাচ্ছে কী কাঁচা মাছ, দুধ কিংবা সবজি?
মুরগির মাংস ও মাছে এন্টিবায়োটিক, হলুদ ও লবণে সিসা, মুড়িতে হাইড্রোজ, মিষ্টিতে কাপড়ের রং, শাকসবজি-ফলমূলে ফরমালিনসহ শত শত প্রাণঘাতী পন্থা আমাদের সামগ্রিক খাদ্যব্যবস্থাকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ কারণে ক্যানসার, লিভার সিরোসিসসহ নানা রকম অসংক্রামক রোগে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত, যার মূল কারণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খাদ্যগ্রহণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন (২০২৩) তথ্য মতে, দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে এবং কমেছে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু। এই পরিস্থিতির পেছনে ভেজাল খাদ্যেরও দায় অনেক। এটা তো গেল স্বাস্থ্যগত দিক। এটার আর্থিক দিক যদি নিরূপণ করা হয়, তবে সেটি হবে ভয়াবহ। যারা দেশের ভেতরে চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের আর্থিক ব্যয়ের তথ্য পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর সর্বশেষ (২০২১ সাল) তথ্যমতে, বিদেশে চিকিৎসাগ্রহণ করতে যাওয়া রোগীর পরিবারের বছরে ব্যয় হচ্ছে ৪০০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
যে কোনো অপরাধ প্রশমনে সরকারের দায়িত্ব থাকে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা। আর সমাজ ও নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। পাশাপাশি ভেজাল খাদ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সচেতনভাবে ও সামাজিকভাবে বর্জন করা। কারণ জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা ছাড়া শুধু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও তৎপরতায় এই বিপুল-বিস্তৃত মরণঘাতী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ নামে একটি আইন রয়েছে। সেই আইনে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার, তেজস্ক্রিয়, ভারী ধাতু ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ উত্পাদন, আমদানি, বিপণনসহ নিম্নমানের খাদ্য উত্পাদন, খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার, শিল্পকারখানায় ব্যবহূত তেল, বর্জ্য, ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য ইত্যাদি খাদ্য স্থাপনায় রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ, বৃদ্ধি প্রবর্ধক, কীটনাশক, বালাইনাশক বা ওষুধের অবশিষ্টাংশ, অণুজীব ইত্যাদির ব্যবহার, বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, ব্যাবহারিক খাদ্য, স্বত্বাধিকারী খাদ্য ইত্যাদি খাদ্য মোড়কীকরণ ও লেবেলিং, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য উত্পাদন, বিক্রয়, রোগাক্রান্ত বা পচা মত্স্য, মাংস, দুগ্ধ বিক্রয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলের পরিবেশনসেবা, ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত, নকল খাদ্য উত্পাদন, বিক্রয়, সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের নাম, ঠিকানা ও রসিদ বা চালান সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, অনিবন্ধিত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য উত্পাদন, বিক্রয় ইত্যাদি বিজ্ঞাপনে অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য, মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রস্তুত, মুদ্রণ বা প্রচারসংক্রান্ত বিধিনিষেধের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
পাশাপাশি এ আইনের ব্যত্যয় হলে শাস্তির বিধিবিধানও বিধৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, এই আইনের অধীন জারি করা পরোয়ানা তল্লাশি, গ্রেফতার ও আটকের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান প্রযোজ্য হয়। এখানে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থাও রয়েছে। ন্যূনতম ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে। আর অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অপরাধীকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে নিরাপদ খাদ্য আদালত। যদিও এই আইনের খসড়ায় প্রথমবার কেউ অপরাধ করলে সাত বছর এবং দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভেজাল প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর পন্থা অবলম্বনই শ্রেয় ছিল।
আমাদের দেশে যখন বড় বড় কোম্পানিগুলো খাদ্যদূষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যখন শোনা যায় নামিদামি ব্র্যান্ডের লবণে আয়োডিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, মেয়াদোত্তীর্ণ তেল পুনরায় বাজারজাত করা হচ্ছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শাস্তির কঠোর উদাহরণগুলো অনুসরণীয় বলে মনে হয়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে আইন ও সরকারি উদ্যোগ এবং তত্পরতার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও ভূমিকা খুবই প্রয়োজন। কারণ সমাজ একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ফলপ্রসূ কার্যকারিতা রয়েছে। খাদ্যদূষণের বিরুদ্ধে তাই সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আপনার আমার পাশে বা সামনে যদি এমন খাদ্যদূষণযজ্ঞ চলতে দেখা যায়, তাহলে সম্মিলিত প্রয়াসে সেই সব অপরাধীকে রুখতে হবে। আইনের হাতে সোপার্দ করতে হবে। সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে জড়িত ব্যক্তিদের। গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে আনতে হবে সেই সব চক্র ও অপতত্পরতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ জনহিতকর নানা প্রতিষ্ঠানকে খাদ্যদূষণবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে হবে।
জরুরী ভিত্তিতে ভেজাল রোধে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( পুলিশ), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে রুটিন মাফিক তদারকি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ফরমালিনসহ রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ভেজাল মিশ্রণ আমদানিকারক, বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের শনাক্ত করতে হবে। এসব পণ্যের বাজার মনিটরিং করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্য উত্পাদন, প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত মানুষদের মধ্যে এমন অপরাধপ্রবণতা কীভাবে এত প্রকট হলো, সে বিষয়ে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান ও সঠিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই অসৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের ভালোর পথে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি সুস্থ জাতি ও প্রজন্মের বিকাশে দূষণমুক্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা খুবই প্রয়োজন। সরকার ও তার সংস্থা সমূহ নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। জনগণকেও সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসেবে, খাদ্যদূষণমুক্ত বাজারব্যবস্থা নিশ্চিতের অংশীজন হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে । তবেই নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই