Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কখনো নিরবতা অপরাধ

আনোয়ার হাকিম
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৬

আমাদের সমাজে একটা কথা খুব বেশি প্রচলিত, ‘নিরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ’। সম্পাদিত কোন অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তর সম্পৃক্ততার লক্ষ্মণ হিসেবে এটি বিবেচিত হয়ে থাকে। এটা সাধারণ অনুমান। তাই বলে নিরব থাকলেই যে কেউ অপরাধী বলে গন্য হবে তাও ঠিক না। আজকাল নিরব থাকার প্রেক্ষিত, নেপথ্য কারণ ও প্রায়োগিক কৌশল বিবেচনায় নিতে হয়।

আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রাম ও মফস্বলের বিয়েতে বিয়ের কনে বিদায়ের সময় কেঁদে কুটে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের ইজাব কবুলের সময় কবুল বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরব থাকে বা অস্ফুট স্বরে কি বলে তা শ্রুতিগ্রাহ্য হয় না। এরূপ নিরবতাকে আমরা বিয়ের পক্ষে সম্মতি হিসেবে ধরে নিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করে থাকি। ইজাব কবুলের সময় নিরব থাকা আর তার কিছু পরেই অঝোর ধারায় ক্রন্দন কি এক অর্থ বহন করে?

বিজ্ঞাপন

আজকাল আমাদের সমাজে দুর্বলের উপর সবলের সাড়াশী আধিপত্য এতই প্রবল ও গভীর যে নিরব থাকা ছাড়া জান-মাল-ইজ্জত রক্ষা করা কঠিন। আবার দুর্বলের পক্ষে নিরবতা বজায় রাখাই নিজেকে রক্ষা করার মোক্ষম হাতিয়ার। নিরবতা প্রতিপক্ষকে জব্দ করার প্রকৃৃষ্ট উপায়ও। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে বলে আরেকটি প্রবচন চালু আছে। অতএব নিরবতা তথা নিরব থাকার একাধিক যুক্তিগ্রাহ্য অর্থও থাকতে পারে।

আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪(১) (ণ) ধারায় অপরাধের সংজ্ঞায় কোন কিছু ‘করা’ বা ‘করা থেকে বিরত’ থাকাকে অপরাধ বলে গন্য করা হয়ে থাকে। সে অর্থে নিরবতা একধরণের অপরাধ। আবার নিরবতা মোহনীয়, নান্দনিক ও নৈসর্গিক সুখের অনুভূতি দিতে পারে। নিরবতা সরবতার চেয়েও শক্তিশালী। তাই, রবীবাবু গুনগুনিয়ে গেছেন, “অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি”। নিরবতা ক্ষতিকরও। একতরফা প্রেমে বা অব্যক্ত প্রেমে বেদনা বিধুরতার খোঁচা আজীবন রক্তাক্ত করে। আসলে নিরবতার ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই দিকই সমান ধারালো। নিরবতা প্রতিপক্ষকে কোন রূপ আঁচ-অনুমান করার সুযোগ দেয় না। বুদ্ধিমানদের কাছে নিরবতা কখনো কখনো পরম পাওয়া। একান্তে প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নেওয়া যায়, ভাবনার রাজ্যে তলিয়ে যাওয়া যায়। নিরবতা কখনো রস উদগীরণ করে থাকে। প্রেমে-বিরহে অভিমানে-বিষাদে-অপ্রাপ্তিতে নিরবতা আমাদেরকে উদ্বেলিত করে, পর্যুদস্ত করে, উদ্দীপিতও করে থাকে। পৃথিবীর অনেক সৃজনশীল সাহিত্যের সৃষ্টি নির্জনতা তথা নিরবতা থেকে, নির্বাসন থেকে। আবার নিজেকে রক্তাক্ত-ক্ষত-বিক্ষত ও হণন করার ক্ষেত্রেও নিরবতার বিষবাষ্প অনুঘটকের কাজ করে থাকে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য নিরবতার নামে গরুর রচনা লেখা না।

বিজ্ঞাপন

আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিরবতা যে এক ধরনের জঘন্য অপরাধ তা আজ অতি বাস্তব সত্য। আসুন তাই নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। আমাদের সমাজ জীবন নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বলা চলে আমরাই আগ বাড়িয়ে নাকে দড়ি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে তাকে বাঁকে বাঁকে ঘুরাচ্ছি। এখানে ডামাডোল আছে, মৌজ-মাস্তি আছে। ক্রীতদাসের হাসি আছে, প্রগতির গান আছে, যথেচ্ছাচারের সার্টিফিকেট আছে। এখানে অনিয়মের অনুমোদন আছে, চোরের মা-র বড় গলা আছে। সেরের উপর সোয়া সেরও আছে। প্রভুর জন্য সারাক্ষণ যেমন ভজন-কীর্তন আছে তেমনি ভাগাভাগির যোগসাজশ আছে। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানির স্টেজ শো যেমন চলছে তেমনি রাতের অন্ধকারে পাশা খেলার রতিসুখও সমান তালে মিলছে। এখানে দুর্বৃত্তপনা যেমন আছে, তেমনি লোক দেখানো পীর-দরবেশ-সাধু-সন্নাসীর সুবচনও আছে। এখানে বাণিজ্যের পসরা যেমন থরে থরে শোভাবর্ধণ করে রাখে নিকেতনসমূহ তেমনি সিন্ডিকেটের ক্যারিশমায় কৃত্রিম সংকট ও মূল্যস্ফূরণও খেলা করে।

এখানে কতিপয় ধুরন্ধর মিলে ঘটা করে ব্যাংক স্থাপনের আয়োজন করে। তাতে গ্রাহকের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানারূপ আবহাওয়া তৈরি করে। সময় সুযোগ মত তারা গ্রাহকের টাকা গায়েব করে তেপান্তরে-দেশান্তরে স্থানান্তরের পথ-ঘাটও প্রশস্ত করে থাকে।। এখানে প্রেম যেমন ঋতুর চেয়েও দ্রুত গতিসম্পন্ন তেমনি ব্রেক-আপও অহরহ, এই আছে এই নেই। যখন-তখন, খেয়াল-খুশিমত। পরকীয়া এখানে চির বসন্তের আমেজ নিয়ে থাকে। বিয়ে তাই পরকীয়ার সমান্তরাল এক অতি উজ্জ্বল বিষাদ। এখানে নিয়মের চেয়ে অনিয়ম অতি ফলপ্রদ। শৃঙ্খলার চেয়ে ঘোলা পানির চর্চা এখানে ব্যাপক জনপ্রিয়। এখানে অযোগ্যদের আস্ফালন বেশি, কদরও তদ্রুপ। তাই যোগ্যদের লজ্জাবনত চিত্ত সারাক্ষণ অন্তরালে গুমওে মরে।

এখানে কোরাস আছে, উচ্চকণ্ঠ আছে, পরস্পর গালাগালি-পিন্ডিচটকানি আছে। এখানে একমুখী আনন্দ প্রবাহ সতত বহমান। এখানে পদাসীন যারা তারা প্রবল প্রতাপশালী ও প্রতিহিংসা পরায়ণ। মেধার চেয়ে এখানে চেতনার বুদবুদ বেশি। ঘাটের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে আঘাটের জৌলুষে আজ চারিদিক চমকিত। এখানে দু:খ চাপা থাকে, ভাসে শুধু কোথাও কোন কষ্ট নেই জাতীয় হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি। এখানে প্রতিনিয়ত অঘটন ঘটে। তার জন্য ধামাচাপার প্রলেপ দেওয়া একটা ভার্সনও প্রস্তুত থাকে। প্রকৃৃত ঘটনা তাই ছাই চাপা পড়ে থাকে। বিচারের নামে বাছবিচার এখানে খুব পয়মন্ত প্রিভিলেজ। এখানে যাদের আছে অনেক তাদেরকে নিয়েই সমাজ মাতামাতি করে। আর যাদের কিছু নেই তাদের জন্য আছে করুণা আর ভাতার কার্ডের জন্য ধর্ণা। যারা শিক্ষিত তাদের কাছে সেই শিক্ষা আজ দশ মনি বোঝা স্বরূপ। যাদের মু-ুতে জৈব সারের প্রাবল্য, সমাজ তাদের কাছে ছবক নিতে বাধ্য। অফিসে যারা রক্ষকপ্রতীম তারাই বুভুক্ষু ভক্ষকের মত ভয়ানক আগ্রাসী। যারা বুদ্ধি এদিক ওদিক করে খায়, যারা প্রতিনিয়ত অনুকূলে ছাতা ধরতে অভ্যস্ত তারা কখনো পদক আশ্রয়ী, কখনো প্রভুর কীর্তনে ব্যস্ত। তারা, হয় শীতনিদ্রায় ঘুমন্ত নয়ত মৌসুমী বায়ুতে উচ্চকিত। নেতার চারপাশ যারা আলোকিত করে রাখে তারা আজ আঙ্গুর ফুলে কলা গাছ। অথবা অলৌকিক বাবার স্পর্শে আলাদীনের চেরাগ সহ বিশাল বশংবদ দৈত্যের মালিক। এই যে এতসব আয়োজন, এত রঙ্গ-বিরঙ্গ-তরঙ্গ এর বাইরে কোন প্রবাহ নেই। সর্বত্র বসন্ত বাতাস। কোথাও কোন বিরুদ্ধ ¯্রােত নেই, সরব বিবেক নেই। সবাই বধির, কানা ও কালা। সবাই অসম্ভব রকম নিরব। আপন ভুবনে বিভোর যেন। যেন পাশের দেবালয় পুড়লেও কিছু যায় আসেনা, তার ডেরা তো এখনো অক্ষত।

বিরাজিত এই নিরবতার মানে কি? স্বার্থান্ধতা নাকি আত্মনিমগ্নতা? নাকি হারিকিরির অনুশীলন? ধর্মে নিরবতা, নিমগ্নতা প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে বাধা দেওয়ার কঠোর অনুশাসনও আছে। অর্থাৎ নিরব না থেকে সরব হতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজ জীবনে নিরবতার এরূপ চর্চা জঘন্যতম অপরাধ। আবারো আইনের ভাষায় ফিরে যাই। কোন কিছু ‘করা’ বা ‘করা থেকে বিরত’ থাকা যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাদের এরূপ নিরবতা কোন পর্যায়ে পড়ে? অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি? আগতকালের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই মিলবে। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম কখনো নিরবতা অপরাধ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর