Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বজ্রপাত আতঙ্ক নিরসনে প্রয়োজন গবেষণায় বিনিয়োগ

ড. মিহির কুমার রায়
৪ মে ২০২৪ ১৮:৪৭

সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তন ও জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। বিশেষত, দেশের প্রথম শ্রেনীর দৈনিক পত্রিকাসহ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। ‘বজ্রপাত’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি সাধারণ ইস্যু হলেও এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়াতে বজ্রপাতের প্রভাব প্রকট। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী কয়েকদিনে দেশের বেশ কিছু এলাকায় আগাম বজ্র্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও প্রতিবছর এ সময়গুলোতে কাল বৈশাখীর ছোবলে বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাছপালা কেটে ফেলা, বাতাসে ধূলিকণা বেড়ে যাওয়া এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বেড়েছে বজ্রপাত। তবে আমাদের দেশে বজ্রপাতের মূল কারণ─দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। এর কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে তাল, নারিকেল, সুপারি ও বট বৃক্ষের মত বড় গাছের অভাব, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদনদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়া, গাছপালা ধ্বংসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাতের হার বাড়ার অন্যতম কারণ। আবার আবহাওয়াবীদগণ বলছেন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, বজ্রঝর ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি যেহেতু পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত তাই গবেষণা, গবেষক ও জাতীয় নীতি নির্ধারণীতে তার প্রভাব নিয়ে তেমন কোন খবরাখবর পাওয়া যায় না। এই কারণে যে গবেষনা বিষয়টি সবসময় একটি অনাগ্রধিাকারের বিষয় যা জাতীয় পরিকল্পনা কিংবা জাতীয় বাজেটেই হোক। তারপরও সারা পৃথিবীব্যাপী কিংবা বাংলাদেশে কিছু কিছু গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্ণয়ের গবেষনায় দেখা যায় যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় বজ্রপাত হয়ে থাকে। গবেষণায় এটাও বলা হয় যে, বর্তমানে বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার বাংলাদেশে। নাসার জিআইএসএস-এর গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুন বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ।

তার মতে, বায়ু দূষণের সাথে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন, বাতাসে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলোর পরিমাণ, তাপ শোষন ও সাময়িক সংরক্ষনকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সংগে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সর্ম্পক রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি বাঙালী এক গবেষক উল্লেখ করেছেন, দেশের উচ্চশীল গাছপালা কিংবা বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাত ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এই ফল দেয়া হয়েছে। কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়─বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড়শবার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা, উত্তর ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসাবে বছরে এই সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার।

বিশ্বের হিসাব যাই থাক বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে গিয়ে যে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে তা রোধে কোন ব্যবস্থা নেই। সচেতনতাও গড়ে তোলা হয়নি। বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রানহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করলেও এর কারণ অনুসন্ধান কিংবা প্রতিকারের কী উপায় হতে পারে সে বিষয় দেশের আবহাওয়াবিদরা বা দুর্যোগ বিজ্ঞানীরা সে সস্পর্কে কোন তথ্য উপাত্ত দিতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে যাদের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার পরিমাণ কিংবা গুনগত ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। এ ছাড়াও আাবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করার মত গবেষক কিংবা বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশে সরকারী পর্যায়ে থেকেও না থাকার মত এ অবস্থায় রয়েছে।

এ ব্যাপারে দু’একজন গবেষকের সাথে আলাপ আলোচনায় জানা যায়, একধারে অত্যাধুনিক গবেষণাগারের স্বল্পতা অপরদিকে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ─যা আবহাওয়া গবেষণার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আরও উত্কণ্ঠার বিষয় হলো─বাংলাদেশে এত বেশি মৃত্যুহার হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোনো কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্ল্যেখযোগ্য সরকারি কোনো কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় আমাদের বেশকিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ নিয়ে অনেক গবেষকের মধ্যে অসন্তুষ্টিও রয়েছে। তারপরও কোন সমস্যা যদি ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন সকলই সজাগ হয় কী করা যায় এবং বিষয়টি আসলে এত সহজ নয়। আমরা আমাদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখন কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছি এবং প্রবাদ আছে ’জলেকুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ তার সাথে আরও একটি যোগ হয়েছে ’আকাশে বজ্রপাত’ এখন মানুষ যাবে কোথায়। এই পরিস্থিতির মোকাবেলায় সরকার কী ভাবছে বা কী আয়োজন তা নিয়ে জনমনে কিছুটা আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে দুর্যোগ, ত্রাণ ও পূনর্বাসন ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয় বলছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতে দেশের সবকটি জেলায় তাল বীজ বপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে বলছে এরই মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ তালবীজ রোপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকৃতিতে কার্বনডাই অক্সাইউ নিঃসরণ ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বজ্রপাতকে তরান্বিত করছে। আবার বিভিন্ন গবেষকরা বলছেন, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার সংগে বায়ু মন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে─যা প্রমাণিত এবং প্রাকৃতির এক ভয়াবহ পরিনাম যে বজ্রপাতে কয়েক মিলি সেকেন্ডে তাপমাত্রা সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বিগত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমান ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে এবং বাতাসে ধূলিকনার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মনে করা হলেও এলাকা ভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। তাহলে ঢাকা শহরে দেশের সবচাইতে বজ্রপাতপ্রবন এলাকা হওয়ার কথা থাকলেও তা বৈদ্যুতিক তাদের বেরাজালের কারণে বুঝা যায় না সত্যি কিন্তু বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি যেমন বাল্ব, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, ওভেন, এয়ারকুলার ইত্যাদি মূলধন যন্ত্রপাতির ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। এই ক্ষতি আবার সাধারণ ভোক্তাদের মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলে─যা তাদের সাংসারিক বাজেট বহির্ভূত।

একজন আবহাওয়াবিদ জানান, গ্রীষ্ম মৌসুম বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ অতিক্রম করে পরবর্তী মৌসুমগুলোতে শীতের আগে পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই গরম বাতাসে জলীয়বাষ্প উর্ধমুখী হয়ে মেঘের ভেতরে যায়। এই জলীয়বাস্প যত বেশি হবে মেঘের উষ্ণায়ণ ক্ষমতাও অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে জ্যামিতিক হারে মেঘের সৃষ্টি হবে। বাতাসের এই প্রক্রিয়া উপর ও নিচে দুইভাবে চলতে থাকে। আপ ড্রাফ হলো মেঘের উপরের স্থর এবং ড্রাউন ড্রাফ মেঘের মধ্যম ও নিচের স্তর। এই মেঘই বজ্রমেঘ। এই দুই মেঘের মধ্যে বৈদ্যুতিক পজিটিভ ও নেগেটিভ বিকিরণে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যালান্স (ভারসাম্য) আনার চেষ্টা হয়। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ একত্রিত হয়ে বিদ্যুত সঞ্চালন শুর হলে বজ্রপাত হতে থাকে। এই বিদ্যুত সঞ্চালনে বাতাসের তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসে পরিণত হয়। মেঘের অভ্যন্তরের নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস সম্প্রসারিত হয়ে ভয়াবহ কম্পনে গর্জে ওঠে মেঘ। শব্দের গতিবেগের চেয়ে আলোর গতিবেগ বেশি হওয়ায় আলোর ঝলক আগে দৃষ্টিতে আসে। পরে প্রচন্ড শব্দ অনুভূত হয়।

এখন কথা হলো বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে এর ব্যাপকতা জনজীবনকে ভাবিয়ে তুলছে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এখন তত্ত্ব উপাত্ত সংগ্রহ কিংবা ডাটাবেইস সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ খুবই তৎপর। সরাকারি পর্যায়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিও, গণমাধ্যম কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় যে, বিগত পাঁচ বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং ২০১১ সালে পর থেকে এর প্রবণতা ক্রমাগত ভাবেই বেড়ে চলছে যেমন ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন ও ২০১৭ সালে ২৬২ আর ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালে মে পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু ও চার শতাধিক আহত হওয়ায় খবর রয়েছে─যা গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠে, পুকুরের পারে ও হাওরে বেশী সংগঠিত হচ্ছে। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমসহ একাধিক তথ্যমতে, বজ্রপাতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এত বেশি মৃত্যুহারের জন্য মানুষের অসচেতনাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকগণ। তারা বলেছেন, বজ্রপাত সম্পর্কে এদেশের প্রান্তিক ও নিরক্ষর জনসাধারণের সঠিক ধারণা না থাকার দরুন মৃত্যুহার বেশি। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ও এদেশের লোকজন খোলা মাঠে কাজ করে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়।

বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২৩৬ জন বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করছে। দেশের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মার্চ থেকে জুন মাসে এবং সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনাও এই সময়ে ঘটে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য এবং দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বজ্রপাতের প্রবণতাও এখানে অনেক বেশি। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণের গরম আর আদ্র বাতাস এবং উত্তরের ঠান্ডা বাতাসের সংমিশ্রণই বজ্রপাতের উল্লেখযোগ্য কারণ। আবহাওয়াবিদদের মতে, দেশের উত্তর অঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং গ্রীষ্মকালে যেসব এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেসব এলাকার মেঘ থেকেই বজ্রপাতের সূত্রপাত ঘটে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যু ব্যক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর এ ঘটনা দেশব্যাপী বেশ কিছুদিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত বছর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দিনাজপুরে ফুটবল খেলতে গিয়ে চারজনসহ জেলায় মোট সাত জন বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে। প্রাচীনকালে বড় বড় গাছপালা ছিল, ফলে ঘন ঘন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটলেও গাছের জন্য মানুষের প্রাণ রক্ষা পেত। কিন্তু বর্তমানে বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় খুব সহজেই মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে বজ্রপাত। এখন তাল গাছকে বজ্রপাতের উপশম হিসাবে কাজে কেন বাছাই করা হলো তা অনেকেরই মনে প্রশ্ন এবং কৃষিও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এম এ ফারুক অনেক আগেই বলেছেন, তাল গাছ একটি বহুজীবি উদ্ভিদ যার জীবন কাল নব্বই থেকে একশত বছর, ভূমি সংরক্ষনের সহায়ক সব জমিতে আইলে জম্মায়, মাটির মূল গভীরে বিধায় ফসল ক্ষতিকারক নয়, কম বৃষ্টিতে অধিক তাপমাত্রায় ও তীব্র বায়ু প্রবাহ সহ্য করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু বীজ বপনের পর বজ্রপাতের ঝুকি হ্রাসের উপযোগী করতে ১৪ থেকে ১৬ বছরের অধিক সময় লাগবে। তবে এই পরিকল্পনার সাথে সুপারি গাছও বিবেচনায় আনা যায় যা দ্রুত বর্ধনশীল ৫০-৬০ ফুট উচুতে হয় এবং তাল গাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপন করা যায় ইত্যাদি। এই ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুফল পাওয়া গেছে।

স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসাবে বজ্রপাতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়:
এক. দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো সনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। বর্তমানে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যে সকল তথ্য পাই─তা থেকে দেখা যায় যে দেশের ১৪টি জেলা বজ্রপাতের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে। তারমধ্যে সুনামগঞ্জের নাম সর্বাগ্রে রয়েছে। তাই এলাকার মানুষকে এই বার্তাটি দেয়ার দায়িত্ব কার? অবশ্যই সরকারের। তবে স্থানীয়ভাবে কর্মরত সামাজিক সংগঠনগুলোর দায়িত্বও কম নয়। যেহেতু মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই বজ্রপাতের প্রকোপ খুবি বেশি তাই বিভিন্নভাবে প্রচারনা, সতর্কীকরণ, সামাজিক সভা ও মাইকিং করা যেতে পারে। যে সকল বিষয় এতে স্থান পাবে তা হলো বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া, উচু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুটি থেকে দূরে থাকা, বাড়ির জানালা থেকে দূরে থাকা, ধাতব বস্তু স্বর্শ না করা, বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, গাড়ির ভেতরে না থাকা, পানি থেকে দুরে থাকা, বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে নিচু হযে বসা, রাবারের জুতো ব্যবহার করা, বজ্রপাতজনিত আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

দুই. বাংলাদেশে বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা মতে, ‘প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়।’ উপরন্তু এ সময়ে কালবৈশাখী হয়। বছরে দেড় শর মতো লোকের মৃত্যুর খবর বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ‘পাঁচ শতাধিক’ বলে আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলে থাকে। বজ্রপাত-ভয়াবহতার এমন প্রেক্ষাপটে টেকসই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাসচেতনতা, বনায়ন, নির্মাণশিল্প, বিদ্যুৎ ও টেলিকম অবকাঠামোর সমন্বিত ও ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোর ওপর নজর দেওয়ার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি। ভাসমান শ্রম কিংবা ধান কাটার মতো উন্মুক্ত কাজে নিয়োজিত পেশাদার শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি ভাবনার দাবি রাখে।

তিন. মাঠে-ঘাটে কিংবা জলাধারে মংস্য শিকারের সময় বেশী মানুষ দূর্ঘটনায় পতিত হয়। বিশেষত হাওরে এসব জায়গায মুঠোফোনের টাওয়ার লাইটেনিং এরষ্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝঁকি কমানো যায়─যা কোম্পানীগুলো তাদের দায়িত্বের অংশ হিসাবে করতে পারে। কারণ গত কয়েক বছরে প্রায় চার হজার নারী পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিপূরনের পাশাপাশি সু-চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, বাংলাদেশে এত বেশি মৃত্যুহার হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণাও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোনো কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্ল্যেখযোগ্য সরকারি কোনো কার্যক্রম না থাকায় প্রতিবছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় আমাদের বেশকিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বজ্রপাতের সময় দালান বা পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। তাছাড়াও বজ্রপাত নিরোধক বৃক্ষায়ণ, নার্সারিভিত্তিক বনায়নের, উঁচু শহুরে দালানে বজ্রনরোধক টাওয়ার স্থাপন, টেকসই আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেকসই বৈদ্যুতিক অবকাঠামো, টেলিকমের পরিবেশবান্ধব টাওয়ার নীতিমালা ও সার্বিক নগর বনায়ন এর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় বজ্রপাত আতঙ্ক নিরসনে প্রয়োজন গবেষণায় বিনিয়োগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর