Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রসঙ্গ লালন: কে এই মহাকবি

সাদিয়া হুমায়রা
৬ মে ২০২৪ ১৯:২৬

দিন কয়েক আগে ফকির লালন শাহ্ এর গানের দুই লাইন ফেসবুক স্টোরিতে শেয়ার করে গ্রেফতার হয়েছেন এক যুবক। পরবর্তীতে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। অভিযোগ সেই পুরনো- ধর্মানুভূতিতে আঘাত। এই অভিযোগে বাউলকূল শিরোমণি লালন সাঁইজি জীবদ্দশাতেও বারবার আক্রান্ত হয়েছেন, আক্রমণ পিছু ছাড়েনি তার মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও। কদিন পরপরই আমরা খবর পাই, বাউলদের মারধোর করা হয়েছে, তাদের চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে কিংবা তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে লালনের ভাস্কর্যের ওপরও হামলা চালিয়েছিল সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু মুসলমানরাই সাধারণত বাউল নির্যাতন করে থাকে, তবে লালনের সময়কালে অবিভক্ত ভারতে গোড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বাউলদের প্রতি আক্রোশ-বিদ্বেষ পোষণ করতো। লালনের লালন হওয়ার পথে যাত্রার শুরুই হয়েছিল মুসলমানের হাতে অন্নজল গ্রহণ করে জাত খুঁইয়ে, সমাজচ্যুত হয়ে। ফকির লালন শাহ তাই মনে বড় খেদ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন,
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’
জাত-পাত-ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে হানাহানি, ভেদাভেদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল লালনের। একই সঙ্গে খুঁজে বেরিয়েছেন সহজ মানুষকেও। কিন্তু সাধনার মূলে ঠাঁই দিয়েছেন মানুষকে। লিখেছেন কয়েকটি শব্দে মানবতার মহাকাব্য,
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’
লালনের গানে, তার সৃষ্টি সুর, ছন্দ, উপমায় এক গভীর দর্শনের ছাপ খুঁজে পেয়ে তাই বাংলার আরেক দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন, “কে এই নিরক্ষর মহাকবি?” এই নিরক্ষর মহাকবির জীবনবোধ দেখে আমরাও কবিগুরুর মতোই প্রতিদিন বিস্মিত হই।

বিজ্ঞাপন

যদিও লালন বা বাউল সম্প্রদায় উগ্র ধর্মবাদীদেরই আক্রমণের শিকার হয়েছেন বারবার, বাউলরা কিন্তু নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী নন। লালনের দর্শনে বারবার “দয়াময়”, ” সহজ মানুষ”, “মনের মানুষ” এর সঙ্গে মিলিত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। লালনের এই সহজ মানুষ কিংবা মনের মানুষ আর কেউ নন, তিনি সমাজের প্রচলিত ধর্মগুলোর ঈশ্বর, যাকে পরিবর্তিত রূপে, পরিবর্তিত উপায়ে প্রাপ্তির জন্য সাধনা করেন বাউলরা। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও মূলত সকল প্রকার শাস্ত্রাচার ও জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করে ভিন্নধর্মী দেহবাদী অধ্যান্ত সাধনা বা মিথুনাত্মক যোগসাধনা করার কারণে বাউলরা সমাজের গোঁড়া ধর্মবাদীদের নিকট ধিকৃত এবং নিন্দিত।

আধুনিক যুগে সেক্যুলারিজম একটি বহুল পরিচিত শব্দ। একুশ শতকেও আমরা বাংলাদেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি, জনপরিসে সেক্যুলারিজম চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন এক বাউল সাধক গানে গানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে গেছেন। নিরীশ্বরবাদের মতো লালনের মতাদর্শে বিশ্বাসের অনুপস্থিতি না থাকলেও তিনি প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলোকে খন্ডন করেছেন, ধর্মের বিভিন্ন রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং আচার সর্বস্ব ধর্মে অনাস্থা জ্ঞাপন করে সর্বধর্ম সমন্বয়ের রূপরেখা তৈরি করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।’

লালনের ধর্মমতের সঙ্গে বাংলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের চর্যাপদ রচয়িতা বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সুফিবাদী দর্শনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। পরমাত্মা এবং মানবাত্মার মিলনে মানব মহানির্বাণ, মোক্ষ বা ফানা প্রাপ্ত হয় যা উপরিউক্ত দর্শনের মতো লালন দর্শনেও উপস্থিত৷ বৌদ্ধ সহজিয়া এবং বৈষ্ণব সহজিয়াগণের মতো লালনও দেহতত্ত্ব অনুসারী সাধক ছিলেন যিনি মানবদেহকেই পরমের আবাসস্থল বলে বিশ্বাস করতেন। লালন মানুষ ভজনা করতেন আর এই মানুষের জন্ম যে প্রক্রিয়ায় হয়, নারী-পুরুষের সে মিলনকে লালন দেহজ অভিজ্ঞতা থেকে অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় উত্তরণের সাধনার কথা বলে গেছেন তত্ত্বকথায় তার গানের মাধ্যমে। এই সাধনার বলেই পাওয়া যাবে পরমাত্মাকে, মিশে যাওয়া যাবে তার সঙ্গে। লালনের সাধনার উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক তাই তাকে ভাববাদী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু লালনের পরকালীন সুখ-সুবিধা লাভ কিংবা বেহেশত-দোযখের প্রতি আসক্তি নেই এবং তার সাধন মার্গ মানবদেহ, তার সাধনকেন্দ্র মানুষ। তাই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষক তাকে বস্তুবাদী বলেও চিহ্নিত করেন।

লালনের ধর্মমত যাই হোক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রে সকল ধর্মের সহাবস্থান স্বীকৃত। আর লালনকে কেবল তার ধর্ম বা ঈশ্বরকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। লালনের গানে যে মানবের জয়জয়কার তাকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে প্রথমত মানুষ হয়ে ওঠার আহবানে দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার রুখে দাড়ানোকে দেখতে হবে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে তার আকুতি ও জ্ঞানের রাজ্যে তার অবদানকে বিবেচনা করতে হবে।

একজন মহান সৃষ্টিশীল মানুষ অবশ্যই সমাজের অনাচার, অবিচার আর বৈষম্যে ব্যথিত হবেন। তার সৃষ্টিতে ধ্বণিত হবে সমাজ পরিবর্তনের প্রচণ্ড লিপ্সা। যুগযন্ত্রণা ধারণ করবে তার লেখা কবিতা, গান কিংবা তার আঁকা ছবি। ফরাসি বিপ্লবের বৌদ্ধিক ভিত্তি তৈরিতে জঁ-জাক রুশো, ভলতেয়ারদের অবদান অনস্বীকার্য৷ ইউরোপীয় রেনেসাঁ ম্যাকিয়াভেলি, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলোর মতো চিত্রশিল্পী, লেখক প্রভৃতির দ্বারা উপকৃত ও সঞ্চালিত হয়েছে যারা নিজেদের দর্শন ও জ্ঞানের মাধ্যনে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। মানবতার উত্থান ও প্রচার ছিল সে সমাজ পরিবর্তনের মূলকথা। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন এবং মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের মাধ্যমে লালনও মহান চিন্তক ও দার্শনিক হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হন। তৎকালীন সমাজে জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদের বিরুদ্ধচারণের মাধ্যমে যুগযন্ত্রণা ধারণ করে তার গানও।

লালন যে সময়ে বেঁচে ছিলেন, আঠারো শতকের শেষার্ধ এবং উনিশ শতকজুড়ে, সে সময়টাতে পরাধীন ভারতেও সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন দানা বাধছিল এবং ধীরে ধীরে মানবতা ও জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী রূপ লাভ করছিল। কিন্তু তা ছিল মূলত নগরকেন্দ্রিক বা আরো স্পষ্টভাবে বললে কলকাতাকেন্দ্রিক। এর বাইরে থেকে গেল বিশাল সংখ্যক গ্রামবাংলার অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। কিন্তু তাদের জীবনে জাত-পাত কিংবা হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের কোনো কমতি ছিল না। এই নিম্নবর্গের মানুষগুলোর সামনে সহজ লোকজ ভাষায়, গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন পরিচিত জীবনের উপমা ব্যবহার করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের কথা বলে গেছেন সাঁইজি। লালনের এই আহবান আজও গ্রাম বাংলার সহজসরল মানুষকে আন্দোলিত করে, কাঁপিয়ে দেয় নগরবাসীর কঠোর হৃদয়কেও। সে কারণে লালনকে নিম্নবর্গের মানুষের উজ্জ্বলতম সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কখনো স্কুল-কলেজে না পড়া, নিরক্ষর এক প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বাউল সাধক কীভাবে নিজ চেতনাজাত গানের মাধ্যমে চর্চা করেন উচ্চমার্গীয় দর্শনের। লোকজ শব্দ-উপমায় রচিত লালনের গানগুলোতে দেখি পশ্চিমের সক্রেটিক কোয়েশ্চেনিং এর উদাহরণ।

পাশ্চাত্য দর্শনের ভিত্তিমূল স্রষ্টা গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস জ্ঞানচর্চা বা দর্শনচর্চার জন্য ক্রমাগত প্রশ্ন করতেন। সক্রেটিসের এই প্রশ্ন করার মাধ্যমে চিন্তার সত্যতা নির্ণয়ের প্রক্রিয়াটি সক্রেটিক কোয়েশ্চেনিং নামে খ্যাত। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, চিন্তাশীল প্রশ্ন করার সুশৃঙ্খল অনুশীলন পণ্ডিত বা ছাত্রকে বিভিন্ন ধারণা পরীক্ষা করতে এবং সেই ধারণাগুলোর বৈধতা নিরূপনে সক্ষম করে তোলে। লালনও তার গানে বারবার প্রশ্ন করেছেন। এর কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে,
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’
‘মিলন হবে কত দিনে….
আমার মনের মানুষের সনে,’
‘লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে’
‘এমন মানবজনম আর কী হবে’
কিংবা
‘কে বানাইলো এমন রঙ মহলখানা’

মানবের আজন্ম জিজ্ঞাসা- আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন লালন ফকির তার সহস্র গানে, সুর ও ছন্দে। এই উদ্দেশ্য খুঁজতে গিয়ে তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন তার চেতনালোক ও সমাজবীক্ষা উৎসারিত জ্ঞানের। যে জ্ঞান সবকিছু ছাপিয়ে মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক জীবন দর্শন মানুষের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে মানবমনে আশার সঞ্চার করে। তাই লালন ও তার সৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। একজন বাউল, কবি, গীতিকার বা দার্শনিক হিসেবে লালন ও তার কাজের সমালোচনা অবশ্যই থাকবে কিন্তু তাকে এবং তার সৃষ্টিকে উপেক্ষা করা হলে বাঙালি সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে।

লেখক: কবি ও সমালোচক

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রসঙ্গ লালন: কে এই মহাকবি মুক্তমত সাদিয়া হুমায়রা

বিজ্ঞাপন

আদানি গ্রুপের নতুন সংকট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

আরো

সম্পর্কিত খবর