বিশ্ব গাধা দিবসে গাধার রম্যকথা
৮ মে ২০২৪ ১৬:১৯
আজকাল দিবসের আতিশয্য এতই যে কখন কোন দিবস আসিলো আর নিরবে নিভৃতে চলিয়া গেলো ঠিকঠাক মত ঠাহর করা যায় না। বাঙ্গালী ইদানীং দিবস উদযাপনে মজিয়াসে। ছুতানাতা পাইলেই উৎসবের আমেজ লইতে পিছপা হয় না। দিবসের তালিকা ঘাটিতে গিয়ে দেখিলাম গাধাদের জন্যও দিবস নির্ধারিত আছে। উহা দেখিয়া আপন মনেই হাসিয়া উঠিলাম। গাধাও একটা প্রাণী তার জন্যও আবার দিবস! আজ ৮ মে বিশ্ব গাধা দিবস।
মানুষ যখন বোকার মত কাজ করিয়া বসে বা অন্ধভাবে কাউকে বা কোনো কিছুকে বিশ্বাস করিয়া নিশ্চিন্ত থাকে ও পরে অশ্ব ডিম্ব পাইয়া খেদোক্তি করে তখন নিজেকে গাধা বলিয়াই জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়া থাকে। এই স্বেচ্ছা জবানবন্দীতে এতটুকু লজ্জা পর্যন্ত বোধ করে না। আজকাল সৎ, সহজ-সরল ও শান্তশিষ্ট ল্যাজ বিশিষ্ট মানুষ মাত্রকেই গাধা বলিয়া সম্বোধন করা হইয়া থাকে।
ছোটবেলায় গাধা দেখা যাইত প্রচুর। ইদানীং তেমন দেখা যায় না। গাধারাও কি তবে মনুষ্য প্রবৃত্তি রপ্ত করিয়া ফেলিয়াছে? ইহা যে হইবার নয় তাহা বুঝিবার মত গাধারা আবার এতটা গাধাও নহে। গাধারা আকারে ঘোড়ার চাইতে খর্বাকৃতির। শৌর্যবীর্যে একেবারেই নিরীহ টাইপের। ঘিলুতে খাটো। ভারবাহী হিসাবে পারদর্শী ও বশংবদ প্রকৃতির। গাধা হইলেও তাহারা বেশ ভালো করিয়াই জানে যে, তাহাদের জন্য প্রভুদের বরাদ্দ যৎ সামান্য। নেক দৃষ্টি অনুপস্থিত। অথচ ডিউটি প্রচুর। তাহারা অত্যন্ত আটপৌরে জীবন যাপন করিয়া থাকে।
মাথায় প্রশ্ন জাগিয়া উঠিলো এই প্রকার চতুর্থ শ্রেণির প্রাণীও কী করিয়া দিবস কব্জা করিয়া লইলো? পত্রিকারন্তরে প্রকাশ, ২০১৮ সাল হইতে ইহার প্রচলন শুরু হইয়াছে। তবে ইহা তেমন জমিয়া উঠিতে পারে নাই। মরু প্রাণী লইয়া গবেষণা কর্মে নিয়োজিত বিজ্ঞানী আর্ক রাজিক ইহার প্রবক্তা। গাধাদের দেখিয়া ও নাড়াঘাটা করিয়া তাহার বোধ হইয়াছে যে, কাজের অনুপাতে, পরিশ্রমের অনুপাতে, শান্ত স্বভাবের তুলনায় ইহাদের সামাজিক ও আর্থিক মূল্যায়ন যথাযথভাবে হইতেছে না। বলাবাহুল্য, বিশ্বে গাধাদের সংখ্যায় চীন শীর্ষে অবস্থান করিতেছে। ইহাদের গতিবেগ সর্বোচ্চ ত্রিশ মাইল পর্যন্ত হইয়া থাকে। আর গড় আয়ু পঞ্চাশ হইতে চুয়ান্ন- পঞ্চান্ন বছর হইয়া থাকে। মূলত আধুনিক গাধাদের দুই উপ-প্রজাতি রহিয়াছে। উভয়ই আফ্রিকান বন্য গাধার উপ- প্রজাতি। সম্ভবত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে আজ গাধাদের অস্তিত্ব সংকটক দেখা দিয়াছে। ইহার পরেও প্রশ্ন থাকিয়া গেলো, এইরূপ এক প্রাণীর সহিত মনুষ্য প্রজাতির অনেককে উপমা দেওয়া হয় কেন?
সমাজে গাধাদের জন্য কাহারো সমবেদনা আছে বলিয়া মনে হয় না। ব্যস্ততার এই পৃথিবীতে গাধার দিকে দৃকপাত করিবার মত সময় কাহারো নাই। থাকিলেও উহা পন্ডশ্রম বিবেচনায় উপেক্ষিতই থাকিয়া যায়।
যাহা হোক, বাস্তবে ফিরিয়া আসি। ছোটবেলায় পরীক্ষার জন্য রচনা মুখস্থ করিতে হইত। সাধারণ ছাত্র মাত্রই গরুর রচনা মুখস্থ করিত। তবে ভালো ছাত্ররা ব্যাতিক্রমী রচনা লিখিত। এইরূপ হরেক রকম রচনার মধ্যে “একটি নদীর আত্মকথা”, “একটি বট গাছের আত্মকথা” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিলো।
ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন আব্বা মোস্তফা হারুন অনুদিত উর্দু সাহিত্যের প্রতিভাবান লেখক কৃষণ চন্দরের দুইখানা বই আনিয়া দিয়াছিলেন। ইহার একটি “আমি গাধা বলছি” আর অপরটি “ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ”। এই বই পড়িয়া উর্দু সাহিত্য গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করিতে লাগিলাম। এই প্রক্রিয়ায় মুন্সি প্রেমচাঁদ, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আব্বাস প্রমুখের সহিত পরিচয় হইয়া যায়। যত কিছুই পড়ি না কেন কৃষণ চন্দরের “আমি গাধা বলছি” বইটি মাথায় আজো কারণে-অকারণে কিলবিল করিতে থাকে।
সেই “আমি গাধা বলছি” পড়িয়া কখন যে নিজেই মস্ত গাধা হইয়া গিয়াছি তাহা ঠাহর করিতে পারি নাই। এখন মনে হইতেছে বাস্তবিকই আমি গাধার চরিত্র পরিগ্রহ করিয়াছি। আব্বা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। অসম্ভব সৎ হিসেবে ডিপার্টমেন্টে তাঁহার সুনাম ও কদর দুই-ই ছিলো। তাহার সাথে ছিলো ভোগান্তি। প্রতিবেশী ও পরিচিত লোকজন তাঁহাকে সামনাসামনি তারিফ করিত আর পেছনে পেছনে “আহারে বেচারা, গাধাই রহিয়া গেলো” টাইপের বক্রোক্তি যে করিত তাহা বিলক্ষণ টের পাইতাম। ইহাতে তাঁহার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ বা হতাশা জন্মিতে দেখি নাই।
আব্বার মফস্বলের চাকরি জীবনে আমরা থানায় থানায় ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি। গরুর গাড়ী, মহিষের গাড়ী চড়িয়াছি। নৌকা, লোকাল ট্রেন, মুড়ির টিন সদৃশ বাসে চড়িয়াছি। স্টীমারেও চড়িয়াছি। এই চক্করে পড়িয়া আমরাও গ্রামের স্কুলে পড়িয়া প্রায় অশিক্ষিত হিসাবে বড় হইতেছি বলিয়া শুভাকাংক্ষীরা আব্বাকে ভর্ৎসনা করিত। গাধা বলিয়া সমবেদনা জানাইত।
কালে কালে আমরাও গাধা বিশেষণে বড় হইয়াছি। আমাদের কাপড়ে বৈচিত্র্য কম ছিলো। বিলাসিতা তো দূরের কথা স্বাচ্ছন্দ্য টিকাইয়া রাখিতেই আমাদের অবস্থা কাহিল হইয়া যাইত। এই এই করিয়া গাধার শিক্ষা জীবন শেষ হইলো। বলা বাহুল্য হইবেনা যে, মাস্টার্স ফাইনাল দেওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্বাবধানে গঠিত ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটির পরীক্ষায় রাস্ট্রায়াত্ত একটি ব্যাংকে তাহার প্রথম শ্রেণীর চাকুরীও হইয়া গেলো। ইহাতেও তাহার গাধাত্ব ঘুচিলো না। স্বজনেরা বলিতে চাহিলো গাধাদের নজর এইরুপ নিম্নগামীই হইয়া থাকে। গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে। ম্লেচ্ছ’ ম্লেচ্ছ-ই থাকিয়া গেলো। ইহাদের কথা শুনিতে শুনিতে হঠাৎই একদিন নিজ জেলা সদরে পোস্টিং হইয়া গেলো। ভাবিলাম এইবার বুঝি শহুরে জীবন যাপনের মাধ্যমে গাধাত্ব ঘুচিবে। ভাবিলে কি হইবে? গাধাত্ব পিছু ছাড়িবার নয়। ছাড়েও নাই। সকলেই বলিতে লাগিলো গাধারাই কেবল নিজ শহরে চাকরি করিয়া থাকে। ইহাতে না আছে মান, না থাকে কদর। বিস্মিত না হইয়া ভাবিলাম গাধাত্ব এমন এক তকমা যাহা ছুঁ মন্তর ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে ঘুচানো সম্ভব না। তাই গাধার জীবন- যাপনকেই শিরোধার্য সাব্যস্ত হইলো।
আব্বা তখনো বাঁচিয়া ছিলেন। তিনি কি বুঝিয়াছিলেন জানিনা। একদিন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একখানা ফরম আনিয়া উহা ফটোকপি করিয়া প্রথম পছন্দক্রম হিসাবে প্রশাসন ক্যাডার নিজ হাতে লিখিয়া বাকী ঊনিশটি পছন্দ আমার উপর ছাড়িয়া দিলেন। আশপাশের লোকেরা ভাবিলো এইবার গাধার বিপর্যয় অনিবার্য। গাধা কী করিয়া জাতে উঠিবে? আমি ব্যাংকের চাকুরী করি, বন্ধু- বান্ধব লইয়া ঘুরিয়া, আড্ডা মারিয়া বেড়াই। আর রাতের খাবার খাইয়া দশটার বিটিভি’র ইংরেজি নিউজ দেখিয়া-শুনিয়া বিসিএস পড়িতে বসি। অধিক রাত জাগরণের অভ্যাস আমার কোনকালেই ছিলো না। বারোটা বাজার আগেই ক্লান্তিতে চোখ বুঁজিয়া আসিত। এই সময়ে আবার আমাদের পৈত্রিক বাড়ী ভাঙ্গাচোরা করা শুরু হইলো। না করিয়াও উপায় ছিলো না। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বসত ভিটায় শরীকরা বাড়ী নির্মানে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলো। তাই আমরা ডেরা টাইপ দেড় খোপের আধাপাকা দালান উঠাইয়া কোন রকমে দিন গুজার করিতে থাকিলাম। এই কর্মযজ্ঞ যখন পূর্ণ্যোদ্যমে চলিতে থাকিলো আমার বিসিএস পরীক্ষাও ততই লাফাইয়া লাফাইয়া নিকটবর্তী হইতে থাকিলো। কি আছে জীবনে পণ করিয়া যাহা হইবার তাহাই হইবে ভাবিয়া নিজেকে প্রবোধ দিয়া আদাজল খাইয়া লাগিয়া পড়িলাম। সে এক দীর্ঘ ধৈর্য্যের কাহিনী। অবশেষে হঠাৎ একদিন ছোট ভাই ঢাকা হইতে জানাইলো যে আমার ভাগ্যের শিকা ছিড়িয়াছে। আমি প্রশাসনের কর্তা হিসাবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হইয়াছি। আব্বা-আম্মা, নিকটাত্মীয়রা আনন্দে উদ্বেলিত হইলেন। অন্যরা তবদা মারিয়া গেল। তাহাদের দশা সাময়িক শকের মত হইলো। ইহাদের বিস্ময় গাধা কি তবে মানুষ হইতে চলিলো?
ইহার পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হইয়াছে। গাধার আর উন্নতি হয়নাই। উন্নতি যাহা হইয়াছে তাহা বয়সের। সঙ্গত কারণেই এখন আর আগের সেই উদ্দামতা নাই। চোখের সেই জ্যোতিও অনেকটাই ক্ষীণ। তথাপি গাদা নিজের মর্যাদাকে ‘চিনির বলদ’ পর্যায়ে উন্নীত করিতে পারে নাই। হঠাৎই মনে হইলো গাধা তো গাধা-ই। বলদের কদর আছে। জাতে উঁচু। দেখিতে নয়ন সুখ। বছরব্যাপী তাহার মার্কেট ভ্যালু আছে। আর গাধার আকার-আকৃতি কাহারো চোখে পড়িবার মত বিশেষ কিছু না। বুদ্ধি তো কোন কালেই ছিলো না। তাই গাধা নামকরণ যথার্থই হইয়াছে। গাধার সহিত চিনির কৌলিন্যগত সংঘাত বরাবরের। তবে মালামাল ভর্তি বস্তা পিঠস্থ করিবার যোগসূত্র রহিয়াছে। ঘোড়াকে লইয়া মনিবেরা বড়াই করিয়া থাকে। রেসের ময়দানে ইহাদের বিপরীতে বিপুল অর্থ লাগাইতেও কুন্ঠা বোধ করে না। ইহার জন্য ছোলা দানা সহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্য বরাদ্দ থাকে। বলদের মনিবদেরও খানদানী গৃহস্থের গরিমা থাকে। অথচ গাধাকে লইয়া কেহ উচ্চবাচ্য করে বলিয়া শুনি নাই। করিলে তো গাধা প্রমোশন পাইত। কদর বাড়িত। নির্বোধের তকমা দূরীভূত হইত। প্রবাদে আছে পাগলও নিজের বুঝ বুঝে। কিন্তু সময় থাকিতে গাধা তাহাও বুঝিতে পারে নাই।
যাহা হোক, এই এই করিয়া গাধার কর্মাবসান হইয়াছে। গাধা এখন অবসরভাতার জোরে বরাবরের মত জৌলুসহীন জীবন যাপন করিতেছে। কিন্তু গাধার উপমা ঝারিয়া ফেলিতে পাওে নাই। এখনো তাহাকে শুনিতে হইতেছে, গাধা গাধা-ই থাকিয়া গেলো। ঘোড়া হইতে পারিলো না। হইলে ঘোড়ার মত হর্স পাওয়ার জুটিত। দেহ-কাঠামো আরো সুঠাম হইত। চেহারা-ছবি আরো চিকচিক করিত। কন্ঠ আরো বলিষ্ঠ হইত। আচার-আচরণে ওদ্ধত্য প্রকাশ পাইত। লোকে কদর-কুর্নিশ করিত। রি-সেল ভ্যাল্যুও থাকিত। তাহা হইলে, গাধা দিবস উদযাপনে গাধাদের কী শ্রীবৃদ্ধি হইলো?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই