Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্ন্যাক্সের প্যান্ডোরা বক্স কাহিনী

আনোয়ার হাকিম
৯ মে ২০২৪ ১৫:৫২

‘হাতে নেওয়া’ আর ‘হাতে রাখা’ এই দুই কর্মের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে মনে হয়। কাউকে হাতে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কোশেশ করতে হয়। কাউকে কিছুমিছু দিয়ে বা ভারি কিছু ধরিয়ে দিয়ে হাতে নেওয়া যায়। কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে সবুরে মেওয়া ফলার কথা বলে হাতে নেওয়া যায়। কিন্তু হাতে রাখা চাট্টিখানি কথা না।

হাতে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক নবায়ন করতে হয়। তা নগদায়নের ভিত্তিতে বা প্রলোভনের মূলা ঝুলিয়ে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে করতে হয়। মানুষ একসময় খুব অনুগত হোমোসেপিয়েন্স ছিলো। ইনফ্লেশনের যুগে চারিদিকে মান অবনমনের মত মানুষের আনুগত্যপ্রিয়তাও আদার্স ফ্যাক্টরের উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছে। আজকাল কেউ কারো অধীনতা পছন্দ করে না। এই সর্বনাশের মূলে রয়েছে রবি বাবুর কবিতা, “আমরা সবাই রাজা, আমাদের রাজার রাজত্বে”। তাই, কাউকে হাতে রাখা চাট্টিখানি কথা না। এর জন্য প্রয়োজন হাতে নেওয়া লোকদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করা, প্রতিনিয়ত তাদের দেখভাল করা, বিপদে-আপদে তাদের পাশে ফেভিকল গ্লু-র মত লেগে থাকা, প্রতিপক্ষ যাতে তাকে ভিড়িয়ে নিতে না পারে তার জন্য সার্বক্ষণিক প্রহরার ব্যবস্থা করা, হাতে রাখা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো হলো হাতে রাখার শর্ট রেঞ্জ উইপেন। আর যারা অতিশয় পল্টিবাজ বা অস্থির মতি বা পরিযায়ী পাখীর মত এক ভুবন থেকে আরেক ভুবনে ঘুরে বেড়াতে অভিলাষী বা স্বভাবে যারা মধুমক্ষিকারূপী, হাতে রাখার জন্য তাদের উপর কখনো কখনো লং ডিস্ট্যান্ট উইপেন প্রয়োগ করতে হয় বৈকি। তারও অনেক তরিকা আছে। কাউকে হাতে নেওয়ার প্রাইমারি ইনভেস্টমেন্ট একটু বেশি হলেও কাউকে কাউকে হাতে রাখার রেকারিং খরচের সমষ্টিও কিন্তু কম না।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেলো তত্ত্বকথা। এবার বাস্তবে আসি। কিছু ব্যাংকের সাথে অন্য কিছু ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। এরিমধ্যে লাল বাত্তি জ্বালিয়ে, সাইরেন বাজিয়ে পদ্মা ব্যাংক সফল ভাবেই এক্সিম ব্যাংকের সাথে একীকৃত হওয়ার কাজটি বেশ দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে ফেলেছে। দায়গ্রহণকারী ও ভারমুক্ত ব্যাংকের অধিকর্তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হাস্যোজ্জ্বল মুখের ফটোস্যুট কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বুঝা না গেলেও কিছু একটা সমঝোতা স্মারক যে সম্পন্ন হয়েছে তা বুঝা গেছে। এই পাইপ লাইনে আরো কিছু ব্যাংক ছিলো। সবাই পার্টনার ভাগাভাগি প্রায় করেই নিয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎই কি থেকে যেন কি হলো? একীকরণের এই কাজটি আপাতত বন্ধ রয়েছে। কারা কখন কোন আলোয় আলোকিত হয়ে কার ঘরে কীরূপ বাত্তি জ্বালাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিমিক্রি করে তা আম পাবলিকের পক্ষে বলা যেমন মুশকিল তেমনি আন্দাজ করাও ততোধিক কঠিন। এগুলো বড়দের খেলা। দাবার গুটি দিয়ে সাপ লুডু খেলার মত বেশ জটিল।

ব্যাংক নিয়ে বেশ অনেক দিন আগে থেকেই কথাবার্তা ফিসফাস হচ্ছিলো, পরে তা ক্রমেই প্রকট হচ্ছিলো আর এখন তো দৃশ্যমানই। হাজার হাজার টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ কিছু আগে থেকে জানে না, বুঝে না, অনুমান করে না, সন্দেহের চোখেও দেখে না। পরিচালকরা নিয়মিত বৈঠক করেন, পারিতোষিক নেন, প্রকল্প অথবা ঋণ প্রস্তাব পর্যালোচনা করেন, অনুমোদন দেন। কেন দেন, কি বিবেচনায় দেন, কি দেখে দেন – তারাই ভালো জানেন। তাদের আদৌ কোন জবাবদিহিতা আছে কি নেই তাও বোঝা যায় না। বড় কথা এত কিছুর পরেও তাদের নিয়ে কোন কথা উঠে না। তারা যে এ নিয়ে দৌড়ের উপর থাকেন তাও দৃশ্যমান হয় না।

বিজ্ঞাপন

ব্যাংক এখন প্রভাবশালী প্রভুদের জরুরি রক্ত দানকারীর ভূমিকা পালন করছে। সাধারণ পাবলিকের পক্ষে একাউন্ট ওপেন করা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ টাইপের ঝক্কির বিষয় হলেও হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন, ক্যাশ আউট, বিদেশে পাচার ইত্যাদি এখন নিমিষের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানি লন্ডারিং নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তর কাজ করছে। অথচ তাদের দূরবীনে ধরা পড়ছে না কিছুই। কেন পড়ে না তা জানার উপায় নেই। হয়ত অতি গোপনীয় ও স্পর্শকাতর বিষয় বলেই পাবলিক জানতে পারে না।

কথায় ফিরে আসি। অতি সম্প্রতি একটি ব্যাংক অপর একটি উদ্ধারকারী ব্যাংকের সাথে গাঁটছড়া বাধতে ব্যর্থ হয়ে নিজেরাই নিজের পায়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রেও তাদের প্রেরণাদানকারী ব্যাক্তি হলেন রবি বাবু। তিনি নিজে গেয়ে গেছেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে রে, একলা চলো রে”। তিনি শুধু নিজে গেয়েই ক্ষান্ত হননি, অন্যদের মগজেও ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন গানের মর্মকথা। তাই, সেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রবি বাবুর প্রদর্শিত একলা চলো গানে উজ্জীবিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যাক্ত করার উদ্দেশ্যে আয়োজন করে সংবাদ সম্মেলনের। যথারীতি তা নির্ধারিত দিন ও সময়ে অনুষ্ঠিতও হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে, সংবাদ সম্মেলনে সেই ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহোদয় সাদা বাংলায় সোজাসাপ্টা ঘোষণাই দিয়ে বসলেন যে, আগের মত আগামীতে আর লুটপাট হবে না, তারা হতে দেবেন না। এক বছরের মধ্যে ব্যাংক আবার ঘুরে দাঁড়াবে, ব্লা-ব্লা- ব্লা। সংবাদ সম্মেলন সফল ভাবে শেষ হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাই বেজায় খুশি। তাই, সম্মেলন শেষে তাদের ঘোষিত এই মধুর বচন অভ্যাগত প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কর্মীদের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে তারা সংবাদ কর্মীদের মাঝে স্ন্যাক্স বক্স পরিবেশন করে। বাঙ্গালি অতিথি পরায়ণ জাতি। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে অন্যত্র। স্ন্যাক্স বক্সে স্ন্যাক্স নেই। পরিবর্তে যা আছে তা দেখে সাংবাদিকরা বেজায় মন খারাপ করেছে। কিন্তু কেন? কারণ, স্ন্যাক্স বক্সে স্ন্যাক্স ছিলো না, ছিলো কড়কড়ে টাকা, যা গলাধকরণের উপযোগী ছিলো না। সেখানে রাখা ছিলো জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা মাত্র। এতেই সাংবাদিকরা নাকি বেজায় অপমান বোধ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এহেন কর্ম কি পূর্ব নজীর হিসেবে করা হয়েছিলো? সাংবাদিকরা কি মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় ক্ষেপেছেন? এর সঠিক উত্তর জানা যায় নি। জানি তা জানাও যাবে না কখনো। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি না জেনে, না বুঝে, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই নাদান শিশুর মত এহেন ডাইরেক্ট তরিকার আশ্রয় নিয়েছে? তাও আবার সাংবাদিকদের সাথে? সাংবাদিকরা কি টাকার পরিবর্তে স্ন্যাক্সই প্রত্যাশা করেছিলেন? নাকি ওপেন এন্ড ডাইরেক্ট এপ্রোচে লজ্জাবোধ করেছেন? নাকি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে স্ন্যাক্সের বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রতিস্থাপিত পাঁচ হাজার টাকা যথেষ্ট ও মানানসই নয় বিধায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন? সত্য প্রকাশে নির্ভিক সাংবাদিকরা এতে যে সত্যিই অপমানিত ও হতাশ হয়েছেন তা তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ঢং থেকেই বোঝা গেছে।

বলছিলাম, হাতে নেওয়া ও হাতে রাখা সবসময় এক অর্থ বহন করে না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এতকাল হাতে রেখে রেখে যে ভাবে যা করেছেন তা এখন আর হাতে রাখার পক্ষে অনুকূল তরিকা হিসেবে কাজ করছে না। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলন কি এরূপ বার্তাই দিলো?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম মুক্তমত স্ন্যাক্সের প্যান্ডোরা বক্স কাহিনী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর