Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেল, ডাক, বিমান— এই তিনকে বাঁচান

আনোয়ার হাকিম
১৩ মে ২০২৪ ১৪:১৮

আমাদের কোথায় যেন আত্মঘাতীর জীবানু লুকায়িত থাকে। সময় ও সুযোগ পেলেই তা ফাল মেরে উঠে। নিজ স্বার্থ পাগলেও ভালো বুঝে এটা যেমন সত্য তেমনি দেশ ভালো না থাকলে ব্যাক্তির জীবনও যে ফ্যাকাসে হয়ে যায় তা আমরা মুখে বলি কিন্তু কার্যত অনুশীলন করিনা। বরং করি উল্টো। আত্মঘাতী এ জীবানু নিয়ে আমরা কতটা সুখে আছি বা সামাজিক ভাবে, জাতিগতভাবে কতটা সম্মানজনক অবস্থানে আছি তা এক বারের জন্যও ভেবে দেখি না। নিজেরটুকু হলেই হলো এমন ধ্যান-জ্ঞানে বিভোর থাকি। এতে কতটা সুখ আছে জানি না, তবে আত্মবিনাশী জাতি হিসেবে আমাদের এরূপ অগ্রযাত্রা সুশোভিত হচ্ছে না কিছুতেই।

বিজ্ঞাপন

ব্রিটিশ আমলে পণ্যের অবাধ প্রবাহের জন্য ও জন চলাচলের নিমিত্ত এদেশে রেলের গোড়া পত্তন হয়। গ্রাম-গ্রামান্তররে বুক চিড়ে বহমান সমান্তরাল রেল লাইন ও তার উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা রেলের পরিসেবা ছিলো জনবান্ধব। রেলকে ঘিরে তৎকালে এ অঞ্চলে জীবনযাত্রার অভূতপূর্ব বাঁক পরিবর্তন হয়েছিলো। কর্মের সংস্থান থেকে শুরু করে সুলভে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে রেল হয়ে উঠেছিলো এক অপরিহার্য জনবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম। রেলস্টেশনকে ঘিরে কর্মচাঞ্চল্য ছিলো দেখার মত। তাই গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রেলের উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়।

বিজ্ঞাপন

কালে কালে রেলের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় রেল স্টেশন গুলো দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে। ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগির মান ও জৌলুসে প্রভূত উন্নতি যোগ হয়েছে। রেল লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে। রেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্ত:নগর সংযোগ সহজতর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়েছে। একই রুটে যাতায়াতে একাধিক ট্রেন-সুবিধা এখন জনগণের যাতায়াতকে করেছে আয়াসসাধ্য। সম্প্রতি কক্সবাজার গামী আধুনিক ট্রেনের যাত্রার মধ্য দিয়ে পর্যটন শহর কক্সবাজারের জৌলুস যে আরো বিচ্ছুরিত হবে তা বলাই বাহুল্য। এখন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত অনায়াসে যাতায়াত করা যাচ্ছে। গত বছরেই পদ্মার উপর দিয়ে ট্রেন গেলো ফরিদপুরের ভাঙ্গা অবধি। এখন তা যশোর পর্যন্ত চালুকরণের ট্রায়াল চলছে। এতকাল তা ছিলো স্বপ্নের মত অধরা। অথচ আজ তা অতি বাস্তব। ট্রেনের সিগন্যাল ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। লোকো মাস্টারদের স্মার্ট লুক আশা জাগাচ্ছে। অনলাইন সেবায় রেলকে আনা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও রেল নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে রেলের এতসব কর্মযজ্ঞের বিপরীতে কিছু ঘটনা ও দীর্ঘকালীন অব্যবস্থাপনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। ইদানীং ঘন ঘন ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি লাইনচ্যুত হচ্ছে। ট্রেন কেন উপুর্যুপরি লাইন থেকে পড়ে যাচ্ছে তার উপর কোন গভীর অনুসন্ধানী ফলাফল পাবলিক জানে না। ভয়াবহ প্রকৃতির দূর্ঘটনা হলে, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে নিচের সারির কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর চিরচেনা তদন্ত কমিটি হয়। এরপর আর কি হয় কেউ কিছু জানে না। উপুর্যুপরি এরূপ ঘটনার কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না হওয়ায় ট্রেনে ট্রেনে কলিউশন হচ্ছে, লাইন থেকে ট্রেন পড়ে যাছে। রেল গেটে দূর্ঘটনা ও মৃত্যু এখন নিত্যকার সংবাদ শিরোণাম।

বহু আগে থেকেই রেলের কায়কারবার ছিলো ঢিলেঢালা গোছের। দশটার ট্রেন কয়টায় আসবে তা ছিলো বিরাট জিজ্ঞাস্য। এর কোন সদুত্তর পাওয়া যেত না। যদিও অনেক আগে ঢাউস টাইপের টাইম টেবল নামে একটা বই ছিলো। আগের মত পুস্তকাকারে টাইম টেবিল না থাকলেও সহনীয় মাত্রার বিলম্ব নিয়ে রেল এখন মোটামুটি চলছে। আগের মত পুস্তকাকারে টাইমটেবিল প্রকাশিত না হলেও রেল সংক্রান্ত নানা তথ্য রেলের ওয়েব পেইজ ও এ্যাপস থেকে পাওয়া যাচ্ছে। রেলের বগীর মান উন্নত হয়েছে। এতে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে। তবে দামী দামী বগীর বেহাল দশা ক্রমশঃ বাড়ছে। অবৈধ যাত্রীর প্রবণতা কমে আসছে। কিন্তু স্ট্যান্ডিং যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলন্ত ট্রেনে টিকেট চেকিং বেড়েছে। তাতে রেলের রাজস্ব আয় বেড়েছে কিনা জানা যায় না। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও বেড়েছে। তাতে রেলকে ঘিরে অপরাধের সংখ্যা কমেছে কিনা জানা নেই। রেল যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধান ও আনন্দদায়ক ভ্রমনে এদের দায়িত্ব অপরিসীম। টিকেট নিয়ে তেলেসমাতি কায়কারবার হচ্ছে। আর রেলের লোকসানের ফিরিস্তি স্ফীত হচ্ছে। অন লাইন, অফ লাইন কোন কিছুতেই যেন টিকেট কালোবাজারী রোধ করা যাচ্ছে না। স্টেশনের মাইক দিয়ে যাত্রী সাধারণের উদ্দেশ্যে যা বলা হয় তা শ্রƒতির পক্ষে দুর্বোধ্য। অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ যেন রেলের সাথে ইনবিল্ট। বারোয়ারি লোকের আনাগোনা, পাগল-ছাগলের উৎপাত ও টোকাই-কুলি- বারবণিতাদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি অপরাধজনক কাজের উর্বর ক্ষেত্র এই রেল স্টেশন। বহু চড়াই- উতরাই পেরিয়ে রেল আজকের বাহ্যিক স্মার্ট লুক নিয়েছে সত্য কিন্তু রেলের প্রতিবন্ধিতা কাটেনি।

রেলে এখন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী আছে, রেলপথ বিভাগ নামে স্বতন্ত্র একটা বিভাগ রয়েছে। কর্মকর্তাদের পদ-পদবী আরো জৌলুশপূর্ণ হয়েছে। লোকো ওয়ার্কশপের কর্মক্ষমতা ও তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেরামত কার্য এখন সহজেই করা যাচ্ছে। এরপরেও রেলের লোকশান মেনে নিতে কষ্ট হয়। এর ঢিলেঢালা ভাব মনকে বেদনাহত করে। এক শ্রেণির লোকের কারণে রেলের দুরাবস্থা দেখে মনের যাতনা আরো বাড়ে। দুর্ঘটনা ঘটার পর রেলের বিলম্বিত উদ্ধারতৎপরতা সাধারণ্যে বিরূপ ধারণার জন্ম দিচ্ছে। মোট কথা অপার সম্ভাবনার রেল নিয়ে মানুষের স্বপ্ন আছে কিন্তু অভিজ্ঞতা তিক্ত।

রেলকে নিয়ে আমাদের অনেক করণীয়ও আছে। রেলের টিকেট নিয়ে তুঘলকি কান্ডকারখানা হলেও কিছুতেই কাংখিত মানের সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝেমধ্যে রেলের দুষ্টচক্রকে সনাক্ত করে ব্যবস্থা নিলেও তা সুদূরপ্রসারী কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা ভেতর থেকে সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে বাইরে থেকে যতই ব্যবস্থা নেওয়া হোক তা হবে অতি সাময়িক ও প্রতীকী। মনে হচ্ছে কারা যেন রেলকে ক্রেন দিয়ে পেছন দিক থেকে টেনে ধরে রাখছে। রেলকে টেনে তুলতে পারে এমন নেতৃত্ব দরকার। এটা সরকারের তরফ থেকে আবার রেলের ভেতর থেকেও হতে হবে। কারিগরি, বানিজ্যিক ও প্রমোশনাল সব সেক্টরেই কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। কেবল দরকার উদ্যোগ গ্রহণ, যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করণ, যোগ্য লোককে উপযুক্ত জায়গায় নিয়োগ ও পদায়ন এবং কঠোর ভাবে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। রেলের অপচয় এক বিরাট সমস্যা। এটাকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রায়ই রেলের কালো বিড়াল থলে থেকে বেড়িয়ে পড়ে। তাতে কারো কোন বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে শুনি নি। শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদ মন্ত্রী ছাড়া।

রেলকে হতে হবে জনগনের কাছে আস্থার প্রতীক। সড়কে যাতায়াতকারী যানবাহন রেলের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। অথচ রেল যেন এদের কাছে তাদের শক্ত ডানা মেলে ধরতে পারছে না। নিন্দুকেরা হয়ত বলবেন রেল নিজেই তা চাচ্ছে না। কারণ কি? কঠিন এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। রেল হতে পারে পণ্য পরিবহনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় আয়েসি মাধ্যম। ছাত্র-যুবকদের কাছে হতে পারে প্রথম পছন্দের ভ্রমণ সাথী। প্রয়োজনে রেলের স্বল্প জোন বা অঞ্চল ভেঙ্গে এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে একে নিবিড় তদারকিতে আনা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ, বিশেষত কারিগরি প্রশিক্ষণের উপর আরো জোর দিতে হবে। অনর্থক বিদেশ ভ্রমনের পরিবর্তে উপযুক্তদের নিবিড় ও যথাযথ বিদেশ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। লোকোশেডগুলো আরো কার্যকরী ও বহুমুখী করা যেতে পারে। ট্রেনের ক্যান্টিন নিয়ে প্রায়ই অনেক কথা শোনা যায়। এর মান, মূল্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সর্বোচ্চ মানের করতে পারলে যাত্রী সাধারণের অনেক উপকার হবে। রেল সেবা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

রেলকে নিয়ে আমাদের আবেগের বিরাট একটা জায়গা রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ তা মাথায় রেখে প্রতিদানে উদ্বুদ্ধ হবেন এই আশা। রেলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো স্মার্ট করা যেতে পারে। রেলের বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তা আরো সুরক্ষিত করা যেতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে অনায়াসেই একে দৃষ্টিনন্দন করা যেতে পারে। রেলের নিচের স্তরের কর্মচারীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিক মাথায় রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রণোদনা ও অন্যান্য সুবিধে দিয়ে তাদেরকে কঠিন জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। লোকো মাস্টার, গার্ড ও টেকনিক্যাল লোকদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করে আকর্ষণীয়, চৌকস ও সেবা মনস্ক এক কর্মী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশের প্রেক্ষাপটে ও নিজ গুরুত্বের কারণে রেল খুব সহজেই তার পেখম মেলে ধরতে পারে।

আমাদের আরেকটা আবেগের জায়গা হলো ডাক বিভাগ, ডাকবাক্স, ডাকপিয়ন। প্রযুক্তির দাপটে চিঠি লেখালেখি ও চালাচালির কাজটাও এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির কব্জায়। অথচ এই চিঠির সাথে আমাদের নষ্টালজিক একটা গভীরতম আবেগ জড়িয়ে আছে। পার্শেল আদান-প্রদান ও টাকা প্রেরণ- গ্রহণের সাথেও পোস্টাফিসের সম্পর্ক জড়িয়ে ছিলো। তাছাড়া শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সবার কাছে বিশেষ বিশেষ দিবসে শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের মাধ্যমও ছিল এই পোস্ট অফিস। তাই, আমাদের আটপৌরে জীবনে পোস্টাফিস ছিল এক অপার বিস্ময়। পোস্টম্যানকে মনে হত অতি আপনজন। মনে হত শান্ত, স্থিতধি, ভাবগম্ভীর একজন অতি সুখী মানুষ। রবীবাবু ও তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার কল্যাণে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের বদৌলতে ডাকহরকরা ও পোস্টমাস্টার আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। লাল কালো রংয়ের সেই পোস্টবক্স এখন আর তেমন দৃশ্যমান হয় না। অথচ একসময় এর স্পর্শধন্য হয়নি এমন বাঙ্গালী ছিলো বলে মনে হয় না।

ডাক বিভাগ কোনদিনই জৌলুশপূর্ণ ছিলো না। ভংগুর বা নিতান্ত সাদামাটা ঘরে তার কার্যক্রম চলত। পরে অবশ্য তা দালানেও উন্নীত হয়েছিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর দায়িত্বহীনতার কারণে তা টিকে থাকার পথ টুকুও খুঁজে বের করতে পারেনি। গ্রামীন ক্ষুদ্র সঞ্চয় সৃষ্টিতে পোস্টাফিস ছিলো অকৃত্রিম বন্ধু। কালে কালে বৈশ্বিক ঢেউ ধাক্কা দেওয়ায় আর চাকচিক্যময় প্রাইভেট বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী গড়ে উঠায় আটপৌরে পোস্টাফিস পরিত্যক্তা নারীর মত জৌলুশহীন হয়ে পড়েছে। যারা পোস্টাফিসের সাথে এতকালের মধুর প্রেমে ব্রেক আপ কষেছেন তারা মোটেই কর্তৃপক্ষীয় সুবিবেচনা প্রয়োগ করেন নি বা করতে পারেন নি। পোস্টাফিসকে পরিত্যক্ত না করে এতে প্রয়োজনীয় রিফু কর্ম করে আধুনিকা হিসেবে গড়ে তোলা যেত। গ্রামান্তরে ছড়িয়ে থাকা সরকারের এত বড় একটা নেটওয়ার্ক সুবিধাকে আমরা কোনরূপ স্টাডি না করেই কেন পায়ে ঠেলে অজানা এক উদ্দেশ্যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জানা নেই। পোস্টাফিসের মাধ্যমে পার্সেল লেনাদেনা হত, মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা আদান প্রদান করা হত। সেই একচ্ছত্র জায়গাটা হঠাৎই একদিন দখল করে নিলো প্রাইভেট কুরিয়ার ও মানি ট্রান্সফার এজেন্ট। তারা এখন দারুণ প্রতাপে দাপিয়ে বেরাচ্ছে এই বিশাল খাত। আমরা কেন ছেড়ে দিলাম? এই প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই। তবে নানা সমীকরণ যে ছিলো তা নিশ্চিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই কাঠামোকে আমরা অবজ্ঞা করে পরিত্যক্ত করলাম। অথচ এটিই হতে পারত আমাদের গ্রামীন পরিসেবা-কাঠামোর অন্যতম হাব। অতি সম্প্রতি আইসিটি মন্ত্রী নতুন করে এই কথাই বলছেন। তার এই বক্তব্যের রূপরেখা এখনো স্পষ্ট না হলেও আশার উদ্রেককারী।

বিমান একসময় ছিলো অভিজাত শ্রেণীর যাতায়াত মাধ্যম। কালে কালে প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষের মোবিলিটি দেশের ভেতরে বা বাইরে অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই, বাহন হিসেবে বিমান এখন আর মোটেই বিলাসী মাধ্যম না। সৃষ্টির শুরু থেকেই বাংলাদেশ বিমান সমস্যাক্রান্ত। এর উপর লাভের মুখ দেখতে না পারা, এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতি, সুশাসনের অনুপস্থিতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ বিমান কোনকালেই দেশের মানুষের কাছে প্রথম পছন্দ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ এর বক্ষ জুড়ে লাল সাদার আঁচড়, টেল এন্ডে লাল বলাকার উড়ন্ত ছবি দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এর ভেতরকার কাহিনী নিয়মিতই নেট দুনিয়ায় এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে সচিত্র প্রচার করা হচ্ছে। লোকসান দেওয়া যেন বিমানের সহজাত অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। লাগাতার এরূপ ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তার কর্তৃপক্ষও যেন এক প্রকার দায়মুক্তি পেয়ে গেছে।

বিমানের টিকেট ব্যবস্থাপনা এখনো কোন মানেই স্বস্তিকর করা যায় নি। টিকেট পাওয়া যায় না অথচ উড়ন্ত প্ল্যানের ভেতরকার ছবিতে দেখা যায় উল্লেখযোগ্য সীট ফাঁকা। বিমানের টিকেটের দাম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তার নিজেরও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকা দরকার। সম্প্রতি বিমানের কোন এক ফ্লাইটের অভ্যন্তরীণ একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে অন বোর্ড কেবিন ক্রুরা মশা মারার র্যাকেট হাতে মশার সাথে রীতিমত যুদ্ধ করছেন। সেই দৃশ্য হতাশার ও বেদনার। বিমানের কেনাকাটায় কমতি নেই। যদিও সেসব নিয়েও অনেক কথা আছে। সেটা দেখার যথাযথ কর্তৃপক্ষ আছেন। তারাই দেখবেন।

সিডিউল বিপর্যয়, কি অভ্যন্তরীণ কি আন্তর্জাতিক, বিমানের জন্য যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ উন্নত মানের বড় পরিসরের বিমান ক্রয়ে আমরা পিছিয়ে নেই। পাইলট নিয়োগে অনিয়মের কথা, অযোগ্যদের নিয়োগের কথা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা নেই। থাকলেও লিটমাস পেপারে টেস্ট করে কে দেখবে? বিমানের খাবার মান নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। পাইলটদের খামখেয়ালীপনা নিয়েও কথা উঠে। বিমানের বাণিজ্যিক রূট নিয়েও কথা আছে। পৃথিবীর সব দেশে ফ্লাইট পরিচালনা করার মত সাধ আমাদের থাকতে পারে কিন্তু সাধ্য নেই এটাই চূড়ান্ত কথা। রূট ব্যবস্থাপনাও যথাযথ কিনা তাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মোটকথা সম্ভাবনার ও গৌরবের এই জাতীয় এয়ারলাইন্সে বাহ্যিক চাকচিক্য থাকলেও এর ভেতরকার সেবা সাহায্যের রূপ মোটেই স্বস্তিকর নয়।

বিমানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পদের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে যেন উল্লফন গতিতে বাড়ছেই। সোনা চোরাচালানের ক্যারিয়ার হিসেবেও বিমান ব্যবহৃত হচ্ছে। বিমানের টয়লেট বা বিভিন্ন স্থান যেন সোনার খনি। এগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিমানের এক শ্রেনীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি সংশ্লিষ্ট থাকে। বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কি পরিমান নেওয়া হয়েছে জানা নেই। ফৌজদারী আইনের আওতায় কাউকে নেওয়া হয়েছে কিনা তাও খুব একটা শোনা যায় না। চাকচিক্যের মোড়কে, আর বজ্র আঁটুনি ফসকা গেঁড়ো জাতীয় সিকিউরিটির নামে বিমান এখন আদুরে শ্বেত হস্তিতে পরিণত হয়েছে। যার সুষ্ঠু বিকাশে নানারূপ করণীয় আছে বৈকি!

আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো তার দায়িত্ব অনুযায়ী কাংখিত মানের সেবা-সহায়তা প্রদান করতে পারছে না। নানারূপ সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর ভেতরকার লোকদের দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্জন তোষণ ও অপরাধজনক শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পাবলিক পারসেপশন সুখকর না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি সেবামূলক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা-সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে এখনই সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাববার। নইলে দুর্নীতির আরো বিস্তার হবে। সেবা সহায়তা সাধারণের স্বাভাবিক সুলভ প্রাপ্যতার বাইরেই থেকে যাবে।

আমাদের প্রাত্যহিক ব্যাক্তিক, অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক ক্ষেত্রে রেল বিরাট একটা জায়গা দখল করে আছে। একে কালো বিড়ালের থাবা মুক্ত করে জনবান্ধব পরিবহন ও সেবা মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। লুপ্তপ্রায় ডাক বিভাগকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে এর ভেতরগত ধান খেকো মেঠো ইঁদুর নির্মূল করে সরকারি পরিসেবার হাব হিসেবে দাঁড়া করাতে হবে। আর ক্রমাগত লোকসানে কার্যত মুখ থুবড়ে পরার উপক্রম হওয়া আদুরে শ্বেত হস্তীকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনে আতর গোলাপ ছিটিয়ে নতুন উদ্যমে যাত্রারম্ভ করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ব্যর্থতায় এর বিকল্পমূল্য কিন্তু অনেক চড়া হবে। এসবে ঘন্টা বাধার দায়িত্ব কার তা নিয়ে ঠ্যালা-ধাক্কা করে লাভ নেই। সরকার ইচ্ছা পোষণ করবে, আর দপ্তর-বিভাগ তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করবে- এরকম সমঝোতা সময়ের দাবী। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম মুক্তমত রেল-ডাক-বিমান— এই তিনকে বাঁচান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর