শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলন
১৭ মে ২০২৪ ০৯:৪৫
দিনটি ছিল ১৭ মে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, রবিবার। হঠাৎ করেই যেন কেঁপে উঠলো বাংলাদেশ । জেগে উঠলো ঘুমন্ত বাঙালী, জাতির জনকের খুনী সামরিক শাসকের শিকলে বন্দী লাখো বঙ্গশার্দুল যেন আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়াল! কারণ , আজ যে আপন আলেয় ফিরছেন জাতির জনকের কন্যা,বঙ্গবন্ধু তনয়া!
পাকিস্তানের কনডেম সেল থেকে “সোনার বাংলা” গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ভূমিতে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে সে স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাঙালিকে দ্বিতীয়বার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস নথিভুক্ত করতে হলো।
আপনজন চিরতরে হারিয়ে গেছে, সামনে চলার বিস্তীর্ণ পথ কণ্টকময়, আঁধারে ছেয়ে গেছে স্বাধীন স্বদেশ – তাতে কি! সব ভয়, সংশয়, আশঙ্কা ভুলে, রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দেশে এসেছিলেন বঙ্গকন্যা; পুনর্জন্ম হয় বাংলাদেশের। ১৯৮১ সালের ১১ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি।” তিনি এ-ও বলেছিলেন, “জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।”শেখ হাসিনার দেশে ফেরা ঠেকাতে সকল প্রকার অপকৌশল ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল তৎকালীন সামরিক জান্তা সরকার। সব বাধা উপেক্ষা করে সেদিন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সারথি হয়ে।মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭০৭ বোয়িং থেকে দেশের মাটিতে পা রাখলেন শেখ হাসিনা।
সেদিন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর এলাকাজুড়ে লাখো জনতার ঢল নেমেছিল। আকাশ-বাতাসে একসঙ্গে প্রকম্পিত হলো ‘জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু’ , “’মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব” , “হাসিনা তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই” ।
সাদা-কালো ডোরাকাটা শাড়ি পরা তরুণী ক্রন্দনরত মায়ার চোখে তাকিয়ে দেখলেন লাখো চেনা মুখের ভিড়ে শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা ,ছোট ভাই রাসেল আরও অনেক প্রিয়জন। প্রকৃতিও যেন কেঁদে উঠলো হুহু করে। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড প্রকোপ আছড়ে পড়েছিল নগরে।
চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। এরই মাঝে ট্রাকে ও রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান, “পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।”যেন বজ্র নিনাদ হয়ে বাজছিলো।
লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বললেন, “বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।”
শেখ হাসিনা এক বৃহৎ শূন্যতার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। এখানে তার ঘর নেই, ঘরের আপনজনও কেউ নেই ; তাই দেশের প্রতিটি ঘর হয়ে উঠলো তার ঘর, সারা দেশের মানুষ তার আপনজন হয়ে উঠল। বাংলার ফিনিক্স পাখি লাখো মানুষের সামনে দাবী নিয়ে বলেছিলেন, “আমার আর হারানোর কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।”
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন টানা ছয় বছর দেশের মানুষ আশার আলো হাতড়ে খুঁজেছে।অসহায় -রিক্ত, হতাশায় নিমজ্জিত বাঙালীকে যখন আশা দেয়ার মতো কেউ ছিল না, ঠিক তখনই ভরসাস্থল হয়ে জাতির পিতা হারানোর ক্ষত পূরণে আসলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক পথচলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা সামনে থেকে নেতৃত্বে দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, একসময়ের মঙ্গা কবলিত, দুর্ভিক্ষ জর্জরিত বাংলাদেশ আজকে সারা বিশ্বে একটি আত্মমর্যাদাশীল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পাদন এবং রায় কার্যকর করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে এই দীর্ঘ ৪৩ বছরের পথচলায় নিজ আলোয় আলোকিত যাত্রার জয়রথ ছুটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে আজ বাংলাদেশের শেখ হাসিনা।
লেখক: সভাপতি, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ
সারাবাংলা/এসবিডিই