বাজেট ২০২৪-২৫: অর্থমন্ত্রীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
২৪ মে ২০২৪ ১৯:৪৮
ভূমিকা
আসছে ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এখন পুরোদমে চলছে বাজেট তৈরির কাজ। আগামী বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ কোটি টাকার আশপাশে। আগামী বাজেটের আকার জিডিপির ১৪ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে রাখা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির পরিধি অনুযায়ী আকার আরও বড় হওয়া দরকার। সেটি করতে গেলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর ওই ঘাটতি মেটাতে আরও ঋণ করতে হবে। নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিকীসহ অন্যান্য পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ হিসেবে বাড়ানো হয়েছে সুদহার। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্ত অর্থনীতির অনুসারী না, কল্যাণকর অর্থনীতির অনুসারী। আসন্ন বাজেটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলন ঘটবে। সরকারের আরও কিছু বিষয় আছে, সেগুলো মাথায় রেখে বাজেট করা হবে। বাজেটে কী হচ্ছে, না হচ্ছে এসব বিষয় সাধারণ মানুষ জানতে চায় না। তারা চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসুক। আগামী বাজেটে এ বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বাজেটে যা করার আছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে নজর দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর সাহসি কাজেট
কূটনীতিকের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০১ সালে আবুল হাসান মাহমুদ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী ২০১৯ সাল থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে পাঁচ বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেছেন। আমরা আবুল হাসান মাহমুদ আলী উত্তর বঙ্গের মানুষ । অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পাকিস্তানের কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মতো কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্তগুলো সারা বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
আগামী অর্থবছর অন্যান্য অর্থবছরগুলোর মতো নয়। নতুন বাজেটে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমন্বয় ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে আগে থেকে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই। পাশাপাশি আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির থাবা। এ অবস্থায় সাধারণ চিন্তা করে বাজেট তৈরি করলে সেটি থেকে ভালো ফল আসবে না। তাই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সতর্কতামূলক বাজেটের বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকেই । এবার নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। তাই উন্নয়নের সঙ্গে রাজেনৈতিক প্রতিশ্্রুতিও আছে। কিন্তু অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নাজুক। এছাড়া দীর্ঘসময় ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। আছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। আর্থিক খাত দুর্দশাগ্রস্ত। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুর্বল। পাশাপাশি বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে যে টিম রয়েছে সেটিও একেবারেই নতুন। তাদের প্রথম বাজেট তৈরির অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট হওয়ায় নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্্রুতি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। অন্যদিকে অর্থনীতির যে অবস্থা এতে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরির সুযোগ নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে বর্তমানে আইএমএফের একটি কর্মসূচি চলছে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটসংক্রান্ত অঙ্গীকার আছে। আইএমএফ বলছে, বাজেট ‘নিউট্রালিটি’। অর্থাৎ বাজেটের ঘাটতি যে জায়গায় আছে সেখানেই রাখতে হবে। সেটি আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে জিডিপির ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশের মধ্যে বাজেট ঘাটতি রাখতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ কি কি
বিজয় অর্জনের ৫৩ বছরে এসে ২০২৪ সালে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অর্জনগুলো নিয়ে আমাদের আনন্দের বার্তা থাকলেও বিদায়ি সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্ররী নিষ্ক্রিয়তার কারণে অর্থনীতি ২০২৪ সালের মার্চে সমস্যায় পরেছে যা হলো: প্রথমত, অর্থনীতিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে স্থবিরতা, মারাত্মক ডলার-সংকটের কারণে আমদানি এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের মার্চে ১২০ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন।দ্বিতীয়ত, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি-পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা।তৃতীয়ত, দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং নতুন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দায়িত্বে ওপরে উল্লিখিত সব সমস্যাকে অবিলম্বে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। সবার আগে নজর দিতে হবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে টাকার ২৮ শতাংশ অবচয়নের কারণে উদ্ভূত মারাত্মক মূল্যস্ফীতি সমস্যার লাগাম টেনে ধরার দিকে। নজর দিতে হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে রুখে দেওয়ার দিকে।
আগামী বাজেটে এডিপি এর আকার
আগামী অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিয়েছে এনইসি (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ)। এডিপির মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্প থাকছে এক হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প এক হাজার ১৩৩টি, কারিগরি সহায়তার ৮৭টি এবং সমীক্ষা প্রকল্প রয়েছে ২১টি। মোট প্রকল্পের মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি থেকে স্থানান্তর হবে এক হাজার ২৭৭টি প্রকল্প। বাকিগুলোর মধ্যে নতুন অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে ৬০টি। এছাড়া আগামী অর্থবছরের এডিপিতে নতুন কিন্তু অনুমোদনহীন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৮৯৪টি, বৈদেশিক অর্থায়নের সুবিধা অনুমোদনহীন নতুন ২৫৭টি প্রকল্প এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) প্রকল্প থাকবে ৮০টি। নতুন এডিপির আকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় দুই হাজার কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাবে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৮ হাজার ৮০৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এদিকে সবচেয়ে কম বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত হলো প্রতিরক্ষা। এখানে ধরা হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। প্রকল্প থাকছে এক হাজার ৭৩৭টি। ব্রিফিং এ জানানো হয়, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে সরকারি ও বৈদেশিক সহায়তা মিলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন আছে ১৩ হাজার ২৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ধরলে নতুন এডিপির আকার দাঁড়াবে দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এডিপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৮৬ লাখ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষা খাত ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অন্যান্য খাতের বরাদ্দ হচ্ছে-গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি ২৪ হাজার ৮৬৮ কোটি ৩ লাখ, স্বাস্থ্যে ২০ হাজার ৬৮২ কোটি ৮৮ লাখ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি ২১ লাখ এবং কৃষি খাতে ১৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। আরও আছে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ছয় হাজার ৪৯২ কোটি ১৮ লাখ, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে চার হাজার ৭৮৬ কোটি ৯২ লাখ, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে তিন হাজার ৪৯২ কোটি, সামাজিক সুরক্ষায় তিন হাজার ৩০৪ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় তিন হাজার ৩০৮ কোটি এবং সাধারণ সরকারি সেবা খাতে দেওয়া হচ্ছে দুই হাজার ১৩৩ কোটি টাকা ।সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ: আগামী অর্থবছরের এডিপিতে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয় হয়েছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগকে ৩২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ বিভাগ ২৯ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ হাজার ১৩৫ কোটি, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৩ হাজার ৭২৫ কোটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। আরও আছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১১ হাজার ৩৮৭ কোটি, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আট হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা।সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকল্প, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল লাইন-১, পাওয়ার গ্রিডের নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ, বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনাল এবং পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প।
আগামী বাজেটে করের বোঝা কি বাড়বে?
ডলার-সংকটে আমদানি কমে আসায় শুল্ক খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আয়কর খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যার প্রতিফলন ঘটবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে।। এই বাজেটে শুধু আয়কর থেকেই অন্তত ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নতুন অর্থবছরের বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কী হারে, কোন কোন খাতে কর আরোপ করা হবে, কোন খাতের কর অবকাশ তুলে দেওয়া হবে, কর ফাঁকি থেকে কত আদায় করা হবে—এ রকম বেশ কিছু বিষয় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে কর বিভাগ।চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে কাটছাঁট করে তা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটিতে নামিয়ে আনা হয়। আসছে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে আয়কর থেকেই ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে চায় এনবিআর।এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আসছে বাজেটে ধনীদের ওপর নতুন করে ৫ শতাংশ বেশি কর আরোপ করা হতে পারে। অর্থাৎ যেসব ধনী ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে আসছেন, নতুন অর্থবছরে তাঁদের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হতে পারে। ওই স্তর করহার ছিল করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে। কর বিভাগ এ হার আবারও বহাল করতে চায়। এটি করতে পারলে কর বিভাগ বাড়তি অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে পারবে। এ ছাড়া উৎসে করসহ ১১টি খাতকে চিহ্নিত করে সেখান থেকে আরও ২৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই ১১টি খাতের মধ্যে শুধু উৎসে কর থেকেই ২২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা আদায়ের কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজস্ব ছাড় কমিয়ে ১ হাজার কোটি টাকা, কর ফাঁকি কমিয়ে ৫০০ কোটি টাকা, গ্রোথ সেন্টার পর্যায়ে নতুন করদাতার কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকা, এনবিআরের অভ্যন্তরে প্রযুক্তি সংযোজন করে আড়াই শ কোটি টাকা, এনবিআরের বাইরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে আড়াই শ কোটি টাকা, আয়কর রিটার্ন যাচাই করে ২০০ কোটি টাকা, অনলাইনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন জমা থেকে ২০০ কোটি টাকা, মাঠপর্যায়ে নজরদারি বাড়িয়ে ৫০০ কোটি টাকা, কর অফিসে করদাতার ফাইলপত্রে নজরদারি বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা এবং করদাতার সেবার পরিধি বাড়িয়ে আরও ৩০০ কোটি টাকা বেশি আদায়ের পথনকশা তৈরি করা হচ্ছে।বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে প্রতি অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কথা বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আসছে অর্থবছরে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে এনবিআরকে।
উপসংহার
অর্থনীতির সংকটগুলোর সমাধান কঠিন, তবে অসম্ভব নয় ।অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের জন্য দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘পরামর্শক কমিটি’ গঠন করা যায়। একই সঙ্গে অবিলম্বে একটি ‘ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন’ গঠন করা যঅয়। সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের কার্যকরভাবে আয়কর-জালে নিয়ে আসা যায়। সর্বোপরি, দুর্নীতি দমনকে কার্যকর করার জন্য ২০০৭-০৮ সালে প্রণীত ‘দুর্নীতি দমন অধ্যাদেশের’ আদলে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করা যায়।এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এক বছরের মধ্যেই অর্থনীতির সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করি। আগামী বাজেটে তার প্রতিফলন চাই ।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক,বার্ড (কুমিল্লা) ,সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি,ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য
সারাবাংলা/এজেডএস
ড. মিহির কুমার রায় বাজেট ২০২৪-২৫: অর্থমন্ত্রীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ