নির্বাচন করার অপরাধে বহিষ্কার এবং ১৮ বছরের পুরোনো হিসাব
২৫ মে ২০২৪ ১৬:২৫
নির্বাচন কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলা সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ৭৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ইসির হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পড়ে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে ৬৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এছাড়া একই জেলার কাহারোলে ৬২ দশমিক ২৪ শতাংশ, নওগাঁর পোরশায় ৬৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বাগেরহাটের ফকিরহাটে ৬২.৬০ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে ৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পড়ে। কম ভোট পড়ার মধ্যে এগিয়ে ছিল রাজশাহীর বাগমারায় ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এই ধাপে সব মিলিয়ে ভোট পড়ে ৩৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এই নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটের হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এই হার সন্তোষজনক নয় সন্দেহ নেই। সবাই জানে কেন নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে। নির্বাচনে নেই সরকার বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতসহ তাদের অনুসারীরা। তারা যে শুধু নির্বাচনে নেই তা নয়, মোটামুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে যত রকম পদক্ষেপ নেয়া যায় যার সবই তারা নিচ্ছে। এখানে আপাত দৃষ্টিতে সফলই বলা যায় তাদের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাদের এই সাফল্য কতটুকু গণতান্ত্রিক, কিম্বা কতটুকু রাজনৈতিক?
দ্বিতীয় ধাপের ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও অকপটে বলেছেন, ভোটের এই হার কখনোই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। স্বল্প ভোট পড়ার প্রধানতম কারণ দেশের একটা বড় রাজনৈতিক দল। তারা প্রকাশ্যে এবং ঘোষণা দিয়ে ভোট বর্জন করেছে। জনগণকে ভোট দেয়ায় নিরুৎসাহিত করছে। অথচ ভোটের আয়োজন নিয়ে কোনো সংকট নেই। সংকট হচ্ছে রাজনৈতিক। আসলেই তাই। প্রথম দুই দফার নির্বাচনে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোথাও সেই অর্থে সংঘর্ষ, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, কেন্দ্র দখল কিম্বা জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ ছিল না। এমনকী নির্বাচন বয়কটের তথ্যও পাওয়া যায়নি।
অথচ নির্বাচনে অংশ নেয়ার অপরাধে বিএনপির দলীয় নেতাদের বহিষ্কার চলছেই। চার দফা উপজেলা নির্বাচনে এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বহিষ্কৃত নেতার সংখ্যা ২শ’ এর বেশি। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। কিন্তু উপজেলার সংখ্যা অনুপাতে, নির্বাচন বিমুখ প্রার্থীর সংখ্যা কমছে। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিস্কৃত বরগুনা সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হালিম গণমাধ্যমে জানান, যেখানে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আছে সেব যায়গায় প্রার্থীরা বহিষ্কার হয়েছেন। তাই তিনি এই বহিষ্কার নিয়ে চিন্তিত নন।
প্রথম দফায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপির ৭ জন জয়ী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় হয়েছেন ৬ জন। দুই দফায় অন্যান্য পদেও বিএনপির নেতারা জয়ী হয়েছেন। বহু প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। নির্বাচনের পর তাদের প্রত্যেকের কণ্ঠে একই রকম সুর। জয়পরাজয় বড় কথা নয় এলাকায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই তারা নির্বাচন করেছেন। দল এটা জানে। সময় হলে দলই তাদের ফিরিয়ে নেবে। কারণ তাদের সঙ্গে কর্মী বাহিনী রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে জয়ী হওয়ার মত ভোটারের সমর্থন। তাই ভোটের প্রার্থীকে দল এড়িয়ে যেতে পারবে না। দলের আজকের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে এখনকার তুলনায় অন্তত তিনগুণ প্রার্থী জয়ী হতে পারতো।
যদিও এনিয়ে সম্প্রতি দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক গণমাধ্যমে জানান, কারা পাস করল, কারা ফেল করল তা বিবেচ্য নয়। যারা পাস করছে তারা সরকারের আনুকূল্য পেয়ে তারা পাস করছে। তাই কাউকে ক্ষমা করা হবে না। তাদের দলে ফেরানোর সুযোগ নেই। এনিয়ে অবশ্য বিএনপিতে ভিন্ন মতও রয়েছে। তাদের মতে এরই মধ্যে বিজয়ীদের অনেকে দলে ফিরতে হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করছেন। তাদের সুযোগ দিলে আগামীতে দলের জন্যে তারা আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন ।
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশর রাজনীতি বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ায় এই বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্তটি যথাযথ নয়। এতে তাদের মাঠপর্যায়ে কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও কোন্দল আরও বাড়বে। তবে এটা যদি বিএনপির কৌশল হয় যে, মাঠপর্যায়ের জনপ্রিয় নেতারা দলের বাইরে থেকেই তাদের অবস্থান ধরে রাখুক, তাহলে ভিন্ন কথা। জোবাইদা নাসরীনের এই শেষ কথাটি খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে।
কেন যৌক্তিক? কারণ একটি রাজনৈতিক দল সজ্ঞানে সারাদেশ থেকে ২’শ নেতা কর্মীকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। এই ২’শ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একই বছরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া আরও ১ হাজার নেতা কর্মী। প্রিয় পাঠক ধরুন, ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে একটি দলটি। তারা ৬৪ জেলার দেশ থেকে এমন ১২’শ মানুষকে নিষ্ক্রিয় করলো, যারা প্রত্যেকেই যেকোন নির্বাচনে জয়পরাজয় নির্ধাণের প্রভাবক। পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে যারা ভূমিকা রাখেন। যাদের নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাহলে সেই দল, ১৮ বছর আগে যত বড় থাকুক এর থেকে কমত েকমতে কোথায় এসে ঠেকে? এই সরল সত্যটি বুঝতে পারেন দেশের রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বুঝতে পারছেন দল থেকে সম্প্রতি বহিষ্কৃত ১২শ নেতা।
এখন আবার প্রশ্ন ওঠে, দলের তৃণমূল আসন্ন বিপদ বুঝতে পারে, নেতাদের বড় অংশ বুঝতে পারে, তাহলে কে বোঝে না? দলের তৃণমূলের বোঝার প্রসঙ্গ যখন আসলোই, তখন বলতে হয়, ২০১৪ সাল থেকেই বিএনপির মধ্যেই নির্বাচনে ‘না’ বলাদের বিপক্ষে অবস্থান শক্ত ছিল। তারা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বলেছে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা জয়ী হবে। দলকে তারা বার বার নির্বাচনে আসার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু দল উৎসাহী হয়নি। দু’একবার দাপ্তরিকভাবে নির্বাচনে এসছে কিন্তু কোন এক অজানা দুঃখে মাঠেই নামেনি। শত শত ‘হ্যাঁ’ বলা্ নেতা কর্মী তখন দলের কথা চিন্তা করে চুপ থেকেছে।
কিন্তু বিএনপির ‘হ্যাঁ’ বলা্ নেতা কর্মীদের আজকের নির্বাচনী উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে, ১৮ বছরের লাভ-ক্ষতির হিসাব নিয়ে বসেছেন তারা। কারণ আজ তারা বুঝতে পারেন, সবাই নির্বাচনে না গেলে নির্বাচনে নিরপেক্ষ হয় না। যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ যত বেশি সেই নির্বাচন তত গ্রহণযোগ্য। যে নির্বাচনে প্রার্থী বেশি সেই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার বেশি। যে নির্বাচনে প্রার্থী বেশি সেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ তত বেশি। আর পর্যবেক্ষক বেশি থাকলে চাইলেও নিরপেক্ষতা নষ্ট করা যায় না। আজ তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, অযৌক্তিকভাবে কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে বাঁচানো কোন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হতে পারে না। তাছাড়া কাউকে বাঁচাতে হলে্ও হাত শক্ত করা চাই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
নির্বাচন করার অপরাধে বহিষ্কার এবং ১৮ বছরের পুরোনো হিসাব পলাশ আহসান মুক্তমত