বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদন
৩০ মে ২০২৪ ১৯:১৪
সম্প্রতি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা যখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী’ শিরনামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে। তথ্যচিত্রে বলা হচ্ছে এটি ডয়চে ভেলে, নেত্র নিউজ ও স্যুডডয়চে সাইটুং নামে তিন প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এর প্রতিবেদক তিনজন। আমি ২০ মিনিটের পুরো প্রতিবেদনটি দেখেছি। পাশাপাশি ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের ওয়েব পোর্টালে প্রতিবেদনটি ছাপা সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে। সেটাও পড়েছি। প্রতিবেদনে মূলত বলার চেষ্টা করা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যারা কাজ করছে, তাদের অনেকের নামে যার যার দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এর উদাহরণ হিসাবে তারা বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার শান্তি রক্ষীদের চিহ্নিত করেছেন।
এরইমধ্যে প্রতিবেদনটির ঠিক নয় বলে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর মুখপাত্র আইএসপিআর এর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এমনকী খোদ সেনাপ্রধানও এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রতিবেদনের নানা অসঙ্গতি নিয়েও কথা বলছে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পক্ষ। প্রতিবেদনটির অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিবেদকদের নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। তাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে কেন প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ। আমি কিন্তু মোটেও অতীতাশ্রয়ী নই। আমার প্রসঙ্গ বর্তমান। তাই আমি কথা বলতে চাই শুধু প্রতিবেদনের কাঠামো নিয়ে।
সাংবাদিকতায় ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ শব্দটি খুবই পরিচিত। বলা যায় শব্দটি বাজে সাংবাদিকতা চিহ্নিত করার অন্যতম পরিভাষা। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কোন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে সাংবাদিকতা করলেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়। শব্দগত অর্থে হয়তো তাই। কিন্তু অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতা বলতে বুঝি, খুব পরিকল্পনা করে কোন মানুষ বা গোষ্ঠীর ক্ষতি করার জন্যে যে প্রচার সেটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার। এই প্রতিবেদনটি নানাভাবে সেই সারিতেই পড়ছে।
পাঠক একবার ভাবুন, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১৬০টির মত দেশ কাজ করছে। তাহলে খারাপ উদাহরণ হিসাবে শুধু বাংলাদেশের ৩ জন কর্মকর্তার নাম আসবে কেন? ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন পুলিশের হাতে ১২৭৭১ জন মারা গেছেন। সেখানে বিচার হয়েছে মাত্র ১.৯৪১ শতাংশ ঘটনায়। উদাহরণ হিসাবেতো সেই গোষ্ঠীর নাম আগে আসার কথা। কিন্তু কেন এলো না? তাই পরিস্কার বোঝা যায়, শুধু কোন অনুসন্ধানের ফলাফল যখন আগে ঠিক করে রাখা হয় তখনই এরকম হতে পারে।
এবার আমরা দেখে নিতে পারি সেই উদ্দেশ্য পূরণের পথে কীভাবে হাাঁটলেন প্রতিবেদকরা। সেই পথ কতুটুকু সাংবাদিকতা সম্মত? প্রতিবেদন যখন নানা নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছে, তখন দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা ইউনিটের ছবি। যেখানে পরিস্কার ভাবে চেনা যাচ্ছে সৈনিক ও কর্মকর্তাদের। ঢাকার রাস্তার ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কর্মরত র্যাব কর্মীদের। সেখানে কারো কারো নেমপ্লেটও দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত এই প্রতিটি কর্মী ও কর্মকর্তার পরিবার আছে, বন্ধু আছে। গণমাধ্যমে তাদের ছবি ব্যবহার করে হেয় করা কী আদৌ নৈতিক? শুধু নিরাপত্তা কর্মী কেন, কোন সাধারণ মানুষের ছবিও কী এরকম নেতিবাচক ভাবে ব্যবহার করা যাবে?
প্রতিবেদনে প্রচারিত ছবিগুলো কীভাবে তোলা হয়েছে সেব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু যে কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ছবি তুলতে গেলে অবশ্যেই অনুমতি নেয়ার কথা। আর যেখানে ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেতো অনুমতি লাগবেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ছবি তুলেছেন, তারা কী জানিয়েছিলেন কোন প্রতিবেদনের জন্যে তারা ছবিটি তুলছেন? প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করে সাবেক তিনজন র্যাব কর্মকর্তার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কি সেই অভিযোগ, তা পরিস্কার না করেই দেয়া হয় নানা তথ্য।
প্রতিবেদনে একজন সাবেক র্যাব কর্মকর্তার ভয়েস বদলের কথা স্বীকার করে এবং তার চেহারা না দেখিয়ে র্যাব এর কাজ নিয়ে নানা অভিযোগ করা হয়। পরে বলা হয়, এসব অভিযোগের কোন প্রমাণ যোগাড় করা যায়নি। যে অভিযোগের প্রমাণই যোগাড় করা গেলো না, সেই অভিযোগ বলা হলো ২০ মিনিট ধরে? আরও অবাক করা তথ্য হচ্ছে ওই ২০ মিনিটের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তাদের কোন বক্তব্য নেই। যদিও এর কারণ হিসাবে বলা হয়, যোগাযোগ করা হলে কেউ কথা বলেনি। অথচ প্রতিবেদনে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করছেন এমন দু’জনের সাক্ষাতকার ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের কাউকে প্রশ্নটা করা গেলো না?
ডয়চে ভেলের যে অনুসন্ধানের সূত্রে এই প্রতিবেদন, সেখানে আরও দু’টি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে তাদের প্রসঙ্গে আমার কিছু বলার নেই। কারণ বিশ্বব্যাপী যে গণমাধ্যমগুলো সাংবাদিকদের মানুষ বান্ধব সাংবাদিকতা শেখায়, ডয়চে ভেলে তাদের অন্যতম। তাই সাংবাদিক হিসাবে আমি তাদের কাছে অন্তত দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা আশা করি। আর সেকারণেই বলি, অনুসন্ধানের কথাই যেখানে বলা হচ্ছে, সেখানে তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে প্রতিবেদন চালিয়ে দেয়াটা কতটুকু সংবাদ সম্মত? অনুসন্ধান শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য প্রমাণ নিশ্চিত করা প্রতিবেদকের দায়িত্ব হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদন জুড়ে ব্যবহার হয়েছে অসাংবাদিক সুলভ কিছু শব্দ। যেমন র্যাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বার বার ‘কুখ্যাত’ বা ‘ডেথ স্কোয়াড’র মত নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। আর র্যাবের বিরুদ্ধে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলেছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’এর মত ইতিবাচক শব্দ দিয়ে। একটি অনুসন্ধ্যান কী কখনো এরকম জাজমেন্টাল হয়? গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য তো শুধু নিরেট তথ্য জানানো। বিচার করার জন্যে তো আদালত আছে। প্রতিবেদনে যদি এরকম সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আইন বা আদালতের কোন দরকার আছে? এখন এই প্রতিবেদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে কেউ যদি বলে, এটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন হয়ে ওঠেনি, বড় জোর একটি প্রতিবেদন হওয়ার ক্লু হয়েছে মাত্র। যেটা যাচাইয়ের বহু পয়েন্ট রয়েছে। তিনি কী ভুল বলবেন?
প্রতিবেদনে ২০০৯ সাল পর্যন্ত শ্রিলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে থাকা সেনাবাহিনীর আচরণের সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর আচরণ মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ ২০০৯ এ তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে ভয়াবহ মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী। ওই সময়ের সামরিক কর্মকর্তা শেভেন্দ্র সিলভার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে জাতিসংঘও তাকে চিহ্নিত করেছিল মানবাধিকার বিরোধী হিসাবে। এর পর সেই শেভেন্দ্রকেই পরে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করেছিল শ্রীলঙ্কা।
বিষয়টি ভালভাবে নেয়নি শান্তি রক্ষা মিশন কর্তৃপক্ষ। এই এলটিটিই নির্মুল করা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তুলনা করা খুবই ভারসাম্যহীন একটা কাজ। কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে কোথাও ন্যূনতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নেই। অথচ ১৯৮৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৪০টি দেশে জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন ১৭৬ জন বাংলাদেশি।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন প্রচারের পর নিউইয়র্কে এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই প্রতিবেদন সম্পর্কে তারা কিছু জানেন কী না? জবাবে জুরিক বলেন, তারা তথ্যচিত্রটি দেখেছেন। এখানে শান্তিরক্ষা মিশনের কর্মীদের মানবাধিকার রক্ষার যে মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আসলে শান্তিরক্ষা মিশনের একটা মান নির্ধারণ করা আছে। সেই মান ধরেই কর্মী মোতায়েন হয়। এই যাচাই–বাছাই পদ্ধতির তিনটি অংশ রয়েছে। একটি অংশে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়া কর্মীরা ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নেই। আরেক ধাপে যে দেশ থেকে তাঁদের পাঠানো হয়, তারা একই ধরনের ঘোষণা দিয়ে থাকে। আর অবশ্যই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকেও বিষয়টি যাচাই–বাছাই করে দেখা হয়।
এরইমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জাতিসংঘ মিশন সবাই কথা বলেছেন এই প্রতিবেদনের ইস্যুতে। তাহলে প্রতিবেদনের আগে কেন বললেন না। ডয়চে ভেলের মত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে কেন এরকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হলো? কেন তারা এমন দায়িতত্বহীন হলো? তাদের সঙ্গে কেউ কথা বললো না? না তারাই কারো কাছে কিছু না জিজ্ঞাসা করে প্রতিবেদন বানালো? এর আগে ২০২১ সালে একবার বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব নিয়ে প্রায় কাছাকাছি একটা প্রতিবেদন করেছিল ডয়চে ভেলে। তখনও একই রকম প্রশ্ন উঠেছিল।
এখন অনেক কথা বলা যায়, কারা এরকম করছে, কেন করছে, সবারই জানা। এই লেখায় সেসব কথা বলে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। কারণ সেটা আমার কাজ না। কিন্তু এটা যাদের কাজ, তাদের শক্ত প্রতিবাদ করা উচিত। এই প্রতিবাদ পৌঁছানো উচিত আন্তর্জাতিক দরবারে। ডয়চে ভেলের দপ্তরে ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে প্রতিবাদ পাঠানো উচিত। একই প্রতিবাদ পাঠানো উচিত জার্মান সরকারের কাছে। কারণ ডয়চে ভেলে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হলেও এর অর্থায়ন করে করে জার্মান সরকার।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
পলাশ আহসান বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদন মুক্তমত