Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে

আনোয়ার হাকিম
৮ জুন ২০২৪ ১৩:১৬

এককালে ছিলো এখন নেই এরকম জিনিসের সংখ্যা অনেক। এই যেমন ধরুন একসময় কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, নীতি-নৈতিকতা, সততা সবই ছিল আমাদের চর্চার ভেতর। এখন নেই। একেবারে নেই বললে ভুল বলা হবে। আছে, তবে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট করতে হবে। কিন্তু, উল্টো জিনিস তালাশ করা মাত্র হাজারটা উদাহরণ চোখের সামনে সপ্রমাণ উঠে আসবে। যেমন ধরুন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অবৈধ-অনৈতিক কর্মকা-, বাছবিচার তথা অবিচার, প্রতিশ্রুত কথা না রাখা ইত্যাদি। তেমনি, আরেকটি জিনিস একসময় আমাদের ঘরে ঘরে ছিল খুবই শক্তপোক্ত ভাবে। তা হলো চোখের পর্দা। ব্যাক্তির ছিলো, পরিবারের ছিলো, সমাজের ছিলো, রাষ্ট্রের ছিলো। এখন নেই। নেই মানে; নেই। উল্টো যা আছে তা হলো লজ্জাহীনতার সংস্কৃতি। এটাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারিদিক।

বিজ্ঞাপন

তাহলে কি আমাদের চোখের পাতা নেই? আছে, তবে তা নষ্ট, অকেজো। গাড়ীর নষ্ট ওয়াইপারের মত তা এখন আর কাজ করে না। প্রশ্ন উঠতে পারে চোখের পর্দার আবশ্যকতা নিয়ে। এটা গবেষণার বিষয়। সে প্রসংগ থাক। পর্দা মানে অন্তরাল, ঢাকনা, আচ্ছাদন, আবরণ, লজ্জা ইত্যাদি। এই পর্দা ড্রয়িং রুমের বিলাসি পর্দা না। মন-মানসিকতার মনিটর বিশেষ। খারাপ দৃশ্য দেখে মন যে গুলিয়ে ওঠে, সেটা ঐ পর্দার কারণে। কোন অনৈতিক কাজে মন সায় দিতে চাচ্ছে না? তা ঐ পর্দার কারণেই। একসময় হাত বাড়ালেই যা করায়ত্ত করা যেত অনায়াসে তাতে বাধ সাধত ওই চোখের পর্দা। লাইন ঠেলে বেলাইনে এগোতে গেলেই সেই পর্দা জানান দিয়ে দিত কাজটা ভালো হচ্ছে না। একজনের জিনিস অলক্ষ্যে সরিয়ে নিজের দখলে নেওয়ার চিন্তা মাথায় আসা মাত্রই পর্দা তাতে বাগড়া দিত। এখন দেয় না। কারণ চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে। মোটকথা, আমাদের ন্যায়নীতিবোধ, মানবিকতাবোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের পক্ষে ফ্রন্ট লাইন ফাইটার হলো এই চোখের পর্দা। আজকাল এই চোখের পর্দা নিয়ে হয়েছে যত ঝামেলা। যার এই পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে তার আর কোন সমস্যা নেই সমাজে, রাষ্ট্রে চলতে-ফিরতে। সমস্যা তাদেরই হয় যাদের এই পর্দা এখনো কাজ করছে। এককালে এটা ছিলো সুস্থতার প্রতীক, বিবেচিত হত সম্পদ হিসেবে। আর আজকাল তা দেখা হয় ঝামেলা হিসেবে। থাকলেই বিপদ।

বিজ্ঞাপন

পর্দা তথা চোখের পর্দা বিষয়ে ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক, ব্যাক্তিক ও প্রশাসনিক ব্যাখ্যা আপাত দৃষ্টিতে ভিন্ন হলেও সারকথা কিন্তু অভিন্ন। ধর্মীয় দৃষ্টিতে যা কিছু অন্যায়, অনৈতিক, অশোভন, অশ্লীল ও হারাম তা পরিত্যাজ্য। পর্দা এখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ব্যাক্তির চোখের পর্দা পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক রীতিনীতি ও দীক্ষা থেকে উদ্ভুত হয়। অন্যরা ভালো আমি খারাপ বলে চিহ্নিত হলে সমাজে মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না- এই বোধ পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক রীতিনীতি থেকে উৎসারিত। ব্যাক্তি তার চোখের পর্দার অনুগামী হয়ে চলে কারণ তার জন্য তার পরিবার যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা লোকলজ্জার মুখে যাতে না পড়ে। তদ্রুপ বৃহত্তর বলয়ে, কর্মক্ষেত্রে বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও চোখের পর্দা সু আচরণের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। কেউ তার অবস্থান খাটো হয়ে যাক, ম্লান হয়ে যাক, অন্যের কাছে বা সর্বসমক্ষে ধিকৃত হোক তা চায় না। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও নগর যন্ত্রণা, অতি মুনাফা জনিত সি-িকেট বাণিজ্যের স্ফুরণ, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট এর দীক্ষামন্ত্রের তাড়না, নানামুখী শিক্ষার প্রসার, জনাধিক্য জনিত সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার প্রসারণ, অতিমাত্রায় চাকরি নির্ভরতা ইত্যাদি আমাদের চোখের পর্দাকে সময়ান্তরে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে।

ডিজিটাল যুগ, বৈশ্বিকায়নের দৌড় আমাদের নিজস্ব ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক মূল্যবোধে দারুণ আঘাত হেনেছে। ধর্মীয় অনুশাসন সাম্প্রদায়িক আচার হিসেবে পৌনঃপুনিক গোয়েবলসীয় প্রপাগা-ার কবলে পড়েছে। বিপরীতে অসাম্প্র্রদায়িক চেতনার প্রবক্তারা একাট্টা হয়ে বায়বীয় এক মডেল দাঁড় করাতে গিয়ে ধর্মকে উন্নয়ন, প্রগতি ও অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, তার জন্য নিরন্তর কোশেশও করে যাচ্ছে। সিণ্ডিকেটিজমের উদ্ভবের ফলে দলীয়, গোষ্ঠীগত ও মামা-ভাগ্নে কালচার গতি পেয়েছে। চোখের পর্দা এখন দুর্বল ও পিছিয়ে পড়াদের বিলাপের বিষয় হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেও প্রভুভক্তি নির্লজ্জ ভাবে বেড়েছে এবং কদরও পেয়েছে। রাজনীতি সবার উপরে থেকেও সি-িকেটিজমের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে পারে নি। বরং সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে একদল বশংবদ দুর্বৃত্ত আর অনুগত প্রশাসন। ফলতঃ রাষ্ট্রীয় কালচারেও এর ছোঁয়া পড়েছে প্রকটভাবে। অতি মুনাফা ও একচ্ছত্র মুনাফার নেশায় অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে কতিপয় ব্যাক্তি-দল-গোষ্ঠীর ইচ্ছাধীন ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে। আগে স্বচ্ছলতা মানেই ছিলো ‘বাড়ী, গাড়ী, নারী’। আর দীক্ষা ছিলো ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে’। এখন সে সূত্র আর কার্যকর নেই। যুগ পাল্টেছে, হাওয়া বদল হয়েছে। বিশ্বায়ন গতি পেয়েছে। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ দর্শন আরো প্রকট হয়েছে। তাই, নিজেদেরকে গ্লোবাল ভিলেজের পরিযায়ী পাখি বলে মনে হয়। কসমোপলিটান সিটিজেনের ফ্লেভারই আলাদা। তাই, কাড়িকাড়ি টাকা চাই, জায়গায় জায়গায় নিরাপদ আবাসন চাই, বৈচিত্রময় স্মার্ট কর্মক্ষেত্র চাই। আরো চাই একাধিক পাসপোর্ট। লাল, নীল, সবুজ, বিদেশী।

কালে কালে এরূপ নতুন মাল্টিপল বোধের উন্মেষ হওয়ায় আমাদের চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে। বেলেল্লাপনার সংস্কৃতি উন্নয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কোথাও কোন রাখঢাক নেই। এখানে বিচরণকারী বামাদের অনেকের চোখের পর্দা অনেক আগেই ফুটো হয়ে গেছে। এখন তারা নেমেছে পাল্লা ভারি করতে। তাই একাধিক বিয়ে করা নায়কের তৃতীয় স্ত্রী হতে মিডিয়ার সহজলভ্য লোকদের ডেকে এনে প্রকাশ্য ঘোষণা দিতেও এদের কোথাও বাধে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এদের কোন পরিবার নেই, আপনজন নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, সহকর্মী নেই। আসলেই নেই। থাকলে এরকম দুর্বিনীত হতে পারত না তারা। কেউ বছর যেতে না যেতেই ড্রেস পাল্টানোর মত করে স্বামী পাল্টাচ্ছে, একে ধরছে, ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, অমুকের সাথে এক্সট্রা এফেয়ার্সে জড়িয়ে যাচ্ছে, একাধিক রিলেশনে ডুবে আছে। কেউ খেলারাম হয়ে অবিরাম খেলে যাচ্ছে। এদেরকে পাবলিক উচ্চমূল্যে স্টেজ শো-তে নিয়ে যায়, দুবাই কিংবা ল-ন কিংবা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা। কেউ দোকান উদ্বোধন করছে, কেউ ফিতা কাটছে, কেউ নেচে কুঁদে টাকা কামাচ্ছে। আজকাল এসকর্ট সার্ভিস নামে উর্বর সেবা খাতের অভ্যুদয় হয়েছে। তাদের দৃশ্যমান কোন আয় নেই, বৈধ কোন স্থায়ী প্লাটফর্ম নেই অথচ অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা আছে। টাকা আসে কোত্থেকে এর কোন উত্তর মিলে না। হয়ত আসে এই সেই করে। অথচ মিডিয়ার সামনে এসে কত উঁচুমার্গের কথা, কত নছীহত, কত জ্ঞান দান! এরা সেপারেশনকে নিরাপদ সাইনবোর্ড ভাবে। সিঙ্গেল মাদার ঘোষণা দিতে গর্ব বোধ করে। টিন এজদেরকে সে দিকে উদ্বুদ্ধও করে। তাদের যে চোখের পর্দা নেই এটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু, তারা যে পাবলিকের চোখের পর্দাও ফুটো করে দিচ্ছে মাথাব্যাথা সেটা নিয়েই।

রাস্তার ছোকড়া, পাড়ার তৃতীয় কিছিমের মাস্তান, তিনবারের এস এস সি ফেল যুবকের কাছেও কোটি কোটি টাকা, লেটেস্ট গাড়ী, ডুপ্লেক্স-ট্রিপলেক্স বাড়ী। হাতে লেটেস্ট আই ফোন ম্যাকস প্রো, বিশাল সম্পত্তি, রিসোর্ট আরো কত কি! এলো কোত্থেকে? হলো কিভাবে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। মিডিয়ায় এগুলো ভাইরাল হয়। কিছু তারা নিজেরাই ভাড়া করে প্রচার করে। আর কিছু লাইক, ভিউ, কমেন্টস পাওয়ার তাড়নায় মিডিয়ার নিজস্ব প্রযোজনা। তারা বিয়ে করে হেলিকপ্টারে, হানিমুনে যায় সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালদ্বীপ, মরিশাস, স্ক্যা-েনিভিয়ান কান্ট্রি প্রভৃৃতি দেশে। সামান্য যে অর্ধশিক্ষিত, রুচি বৈকল্যে আক্রান্ত রাস্তার, বস্তির টিকটকার সেও আজ হিরো, এঞ্জেল, প্রিন্স নাম ধারণ করে ইউরোপ, আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে। তাদেরও লক্ষ লক্ষ ফ্যান- ফলোয়ার। তাদের আয়ের উৎস কি? জানা নেই। তবে সদর্পে প্রদর্শন করে বেড়ায়। তাদের নিয়ে পাবলিকের কত নাচানাচি, মাতামাতি, নেটিজেনদের কত ফাত্রামি!

কালোবাজারি, চোরাকারবারি, লুটেরা ভূমি দস্যু, ব্যাংক লোপাটকারী, নারী ভোগী বর্গাদার গনি মিয়াদের সে কি আস্ফালন আজ সর্বত্র! মিডিয়া আজ এদের দখলে। সংঘটন এদের তৈরি, সি-িকেট এদের ছাতা। রাজনীতির স্নেহধন্য হাত রয়েছে এদের মাথায়। আর কি লাগে? এদের কারোরই চোখের পর্দা নেই। নষ্ট ও অকার্যকর এই চোখের পর্দা নিয়ে এদের কোন মাথাব্যাথা নেই। এদের চোখে ভবিষ্যতের আলো, লাল-নীল-সবুজ। এদের কাছে ম্লেচ্ছ পাবলিক হচ্ছে এ যুগের নাচের পুতুল।

পর্দাহীন চোখ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমাদের কোন কিছুতেই কোন পরোয়া নেই। কোথাও কোন আওয়াজ নেই। হতাশা যা আছে তা ইতর শ্রেণির। শিক্ষা নিয়ে যাদের অহং আছে, মূল্যবোধ যাদের মনস্তত্বকে অষ্টপ্রহর পাহারা দিয়ে রাখে তারা পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর, উন্নয়নবিমুখ লোকজন। আসলে উন্নয়ন অভিযাত্রায় শামিল হওয়ার মত তাদের না আছে ইচ্ছা, না আছে কানেক্টিভিটি, না আছে সাহস, না আছে উদ্যোগ-উদ্যম, না আছে যোগ্যতা। আছে শুধু ঐ চোখের পর্দাটুকু। নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখের পর্দা ঠিক করার মত কারিগর, চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না। যারা পারে, তারা শামুকের মত গুটিয়ে রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথ জানা নেই। সুশাসন ও সংস্কার ভিন্ন বিকল্প কোন চিন্তার সুযোগ নেই। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ঘন্টা বাধবে কে? সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম আমাদের চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর