মহাসাগর দিবসে দূষণ ভাবনা
৮ জুন ২০২৪ ১৩:৫৩
পরিবেশ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা সকলের। কারণ পরিবেশ দূষণের সাথে আমাদের অস্তিত্ত্ব জড়িয়ে আছে। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বহু উপাদান পরিবেশ দূষণকে আরও তরাণ্বিত করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাষ্টিক। পৃথিবীর ভূভাগ যেমন দূষিত হচ্ছে, সমানতালে দূষিত হচ্ছে মহাসাগরের তল। এর কারণ হলো মানুষ স্থল, জল ও আকাশপথ নিজের দখলে নিতে চাইছে। মহাসাগর বিপুল জলরাশি নিয়ে গঠিত। যা পৃথিবীকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। বিশ্বে স্বীকৃত ৫টি মহাসাগর আছে- প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারতীয়, আর্টিক এবং দক্ষিণ। এই মহাসাগরগুলো একত্রে পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ স্থান দখল করে আছে। এ বিপুল জলরাশি আবার অনেকগুলো মহাসাগর ও ছোট ছোট সমুদ্রে বিভক্ত। পৃথিবীর উপরিভাগে যে সম্পদ রয়েছে, বলা হয় তার থেকেও বেশি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে মহাসাগরের তলদেশে। পৃথিবীর শক্তি ও পুষ্টির চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হয় মহাসাগর থেকে প্রাপ্ত সম্পদ থেকে। এই মহাসাগরে কে রাজত্ব করবে সেটি নিয়েও রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। সাগরের তলদেশে রয়েছে বিপুল জীববৈচিত্র্য। সেই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পৃথিবীর দেশগুলো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এক দশকের দেনদরবার শেষে বিশ্বের সাগর মহাসাগরগুলো রক্ষায় একটি সমুদ্র চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে যেকোনো মূল্যে বিশ্বের গভীর সমুদ্র অঞ্চলের প্রকৃতির ৩০ শতাংশ বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হবে। চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে দীর্ঘ ৩৮ ঘন্টার বৈঠক শেষে হাই সি’স ট্রিটি নামে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি এক দশক ধরে ঝুলেছিল। জাতিসংঘের বিশেষ মধ্যস্থতায় বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ইউএন কনভেশন ‘অন দ্য ল অব দ্য সি’ অনুসারে গভীর সমুদ্র অঞ্চল ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করে, যা আন্তর্জাতিক জলসীমা নামে পরিচিত।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুসারে, বৈশ্বিক সামুদ্রিক প্রজাতির প্রায় ১০ শতাংশই বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে। নতুন চুক্তি অনুসারে, সমুদ্রের যেসব এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত হবে সেখানে মাছ ধরা, নৌযান চলাচলের রুপ এবং খনন কাজের সীমা, ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০ মিটার বা তার নিচের সমুদ্র তলদেশ থেকে কখন খনিজ পদার্থ আহরণ করা যাবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, সমুদ্র ঠিক কী কী ভাবে দূষিত হচ্ছে? আমাদের পানি দূষণ যেভাবে হচ্ছে, সেখানকার চূড়ান্ত রুপই হলো সমুদ্র দূষণ। আবার আমরা প্রকাশ্যেই সমুদ্র দূষণ করছি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাচ্ছেন পরিবার পরিজন সহ, সমুদ্রে প্লাষ্টিকের জিনিসপত্র ফেলছেন যেমন- কোমল পানীয়ের বোতল, চিপসের প্যাকেট,চকলেটের প্যাকেট সহ এরকম আরও প্লাষ্টিকের দ্রব্য সামগ্রী। এসব জমা হচ্ছে সাগরের তলদেশে। মাঝে মধ্যেই মাছের পেটে সেসব প্লাষ্টিক পাওয়া যায়। আবার নদী-নালায় যে কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জমা হয়, সেসবেরও শেষ গন্তব্য এই সমুদ্র। সুতরাং সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। আমাদের প্রতিদিন ছোট ছোট অবহেলার কারনে সমুদ্র প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখে পড়ছে। তাই আমাদেরকে দৈনন্দিন ব্যবহারের বর্জ্যসহ সকল প্রকারের বর্জ্য নিষ্কাশনে সচেতনতা অবলম্বন করা উচিৎ। সমুদ্র দূষণ চলতে থাকলে সমুদ্রের যতটুকু অঞ্চল দূষিত হয়েছে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া সামুদ্রিক জীবের পাশাপাশি স্থলভাগের জীবনকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। ২০১৫ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, সমুদ্রে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক রয়েছে। আর এই পরিমাণ প্লাস্টিকের ৮০ শতাংশ স্থলভাগের বিভিন্ন উৎস বিশেষ করে শহরগুলো থেকে নদীনালার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে।
বর্তমান দূষণধারা বজায় থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ উক্ত পরিমাণটি ৬০০ মিলিয়ন টনে পৌঁছে যাবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার (আইইউসিএন) মতে গাড়ির টায়ার ও বিভিন্ন টেক্সটাইল কারখানা থেকে নিঃসৃত ছোট ছোট প্লাস্টিকের বর্জ্য বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্র দূষণের মূল কারণ। মোট দূষণের প্রায় ৩০ শতাংশই প্লাস্টিকের কারণে হয়ে থাকে। অথচ আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তার অর্ধেকই উৎপাদন করে সমুদ্র, অর্থাৎ সমুদ্রের শৈবাল এবং ফিটোপ্লাঙ্কটন নামক এককোষী উদ্ভিদ। বিবিধ সম্পদের ভান্ডার হলো সমুদ্র। মানুষ চেষ্টা করছে সেই সম্পদের পুরোটা কাজে লাগাতে। বাংলাদেশও সেই চেষ্টা করছে। নীল জলেই রয়েছে ভবিষ্যত সম্ভাবনার দ্বার। পৃথিবীর পরাশক্তিগলোর দ্বন্দ্বও রয়েছে সমুদ্র এলাকা ঘিরে। সেসব স্থানে রয়েছে যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন। কিন্তু মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থে সমুদ্র দূষণ করছে অর্থাৎ সমুদ্রকে একটি ভাগাড়ে পরিণত করেছে। মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম উৎসও এই সমুদ্র। কিন্তু বহু দশক সমুদ্র দূষণ নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা মানুষের মাঝে ছিল না। বস্তুত দূষণের বিষয়টি নিয়েও মানুষের মধ্যে এতটা সচেতনতা ছিল না। এখন যখন সমুদ্রের সম্পদের বিষয়টি সকলেই বুঝতে পারছে তখন সমুদ্র রক্ষায় সচেষ্ট হওয়ার আহবান জানাচ্ছে বা চেষ্টা করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মানুষের অন্যান্য কর্মকান্ডে সমুদ্রের উপরিভাগে ক্ষতিকর শৈবালের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণে পানির নিচ পর্যন্ত অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাচ্ছে জলজপ্রাণীরা। এ ছাড়া প্লাষ্টিক দূষণ ও সমুদ্রে চলা বাণিজ্যিক জাহাজের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাষ্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে পরিত্যাক্ত মাছ ধরার সরঞ্জাম রয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টন। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এক লাখ সামুদ্রিক স্তুন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্রু ঘটছে প্লাস্টিক খাওয়ার কারণে অথবা প্লাস্টিকে পেঁচিয়ে। দ্য এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের গভীরের পানি ওপরে উঠে আসার ঘটনা বাড়বে। গবেষকরা আরও দেখেছেন, সাধারণ সামুদ্রিক ড্রাগনের সংখ্যা গত এক দশকে ৫৭ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে স্টারফিশ ও সামুদ্রিক আর্চিনের সংখ্যাও কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গত বছরের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, আগামী ৩০০ বছরের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কারণ সমুদ্র অতিরিক্ত তাপ শোষণ করছে। ছয় দশক আগে সমুদ্রের তাপ রেকর্ড করা শুরু হয়। ২০২১ সালে সমুদ্রগুলো সর্বাধিক তাপ শোষণ করছে। আমরা নিজেরাই সমুদ্রকে মেরে ফেলছি। আমরা সমুদ্রকে একটি বিশাল ভাগাড় ভাবছি। যেখানে যত উচ্ছিষ্ট রয়েছে সব ফেলছি। এর মূল উপাদান হলো প্লাষ্টিক। প্লাষ্টিক ও পলিথিন হলো পরিবেশে মূল শত্রু। সেই প্লাষ্টিক ও পলিথিন মহাসাগর ধ্বংস করছে বিভিন্নভাবে। এর থেকে বাদ নেই বঙ্গোপসাগরও।
ইন্টারন্যাশনাল কনজারভেশন অব নেচার বলছে, শুধু প্লাষ্টিক বর্জ্যরে কারণে প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। এর মধ্যে এক লাখের বেশি মারা যায় প্লাষ্টিকের মধ্যে আটকা পরে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে অযোগ্য হয়ে যেতে পারে বঙ্গোপসাগর। সাগরের প্রাণী ভুল করে খাদ্য ভেবে এসব প্লাষ্টিক বর্জ্য খেয়ে ফেলছে। কিন্তু অনেক প্রাণীই সেসব পেট থেকে বের করতে পারে না। ফলে সেগুলো মারা যায়। আবার প্লাষ্টিকের কারণে সামুদ্রিক মাছে স্বাদও কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন টনকে টন প্লাষ্টিক বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছ। আমেরিকার আর্থ ডে নেটওয়ার্ক বাংলাদেশকে বিশ্বের ১০ম প্লাষ্টিক বর্জ্য দূষণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি দূষণ হচ্ছে চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো প্লাষ্টিক দূষণের ভয়াবহ শিকার হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে খালগুলো। সেসব এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীগুলোর অবস্থাও তাই হচ্ছে। এর পরের অবস্থা হলো বঙ্গোপসাগরের। নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনছি। বিশ্বে সমুদ্রের সবচেয়ে বিশাল যে জায়গাটি জুড়ে প্লাস্টিক দূষণ ঘটেছে, সেটিকে সাধারণত “দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ” বলে বর্ণনা করা হয়। এটির অবস্থান উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে। সেখানে বড় মাছ ধরার জালের ছেঁড়া অংশ থেকে শুরু করে ছোট প্লাস্টিকের কণা জমে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরাট সমস্যা তৈরি হয়েছে। একটি অলাভজনক পরিবেশ সংস্থা ওশেন ক্লিন-আপ সাগর থেকে প্লাস্টিক অপসারণের জন্য একটি দীর্ঘ ‘ইউ’ আকৃতির প্রতিবন্ধক ব্যবহার করে, যেটি আসলে জালের মতো। নৌকা দিয়ে এই জালটি প্লাস্টিকের বর্জ্য জমেছে সাগরের যেসব এলাকায়, তার মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি টানা হয় খুব ধীরে ধীরে, যাতে সামুদ্রিক প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্রের কোন ক্ষতি না হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে পরিচালিত ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণ সাগর-পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা হয় প্লাস্টিকের বর্জ্যের সন্ধানে। এই ক্যামেরা আবার যুক্ত থাকে কম্পিউটারের সঙ্গে। ফলে ওশেন ক্লিন-আপ টিমের সদস্যরা বুঝতে পারেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এলাকাটিকে টার্গেট করতে হবে। এসব বর্জ্য সামুদ্রিক পরিবেশের স্বাভাবিকতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এ কারণে সমুদ্রের পানিতে বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি। জলবায়ু, পরিবেশ, সমুদ্র রক্ষায় বৈশ্বিক উদ্যোগে বাংলাদেশকে সামিল হওয়া এবং বৈশ্বিকভাবে কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার চেষ্টা চালাতে হবে।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই