রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মান নেই দেশের বিমানবন্দরে
২৫ জুন ২০২৪ ১৪:১৯
সরকারি তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বের ১৭২ টি দেশে সরাকারি ভাবে বৈধ কাজের ভিসা নিয়ে প্রবাসে পাড়ি দেন প্রায় ১০ লাখ মানু্ষ। বিভিন্ন ভাবে আরো নানান ভিসা নিয়ে মোট পাড়ি দেন ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক । বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার এসব প্রবাসীরা প্রবাসে দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতি মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন অসামান্য অবদান। রাস্ট্র এবং সমাজ এসব মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবতায় প্রবাসীরা সব সময় অবহেলিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কর্তৃক প্রবাসীদের হয়রানির শেষ নেই।
আমি নিজে একজন প্রবাসী, আমি জানি প্রবাসী বাংলাদেশীদরা কত কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন। প্রবাসীরা এখানে খেয়ে না খেয়ে পরিবারের জন্য,দেশের জন্য দেশে রেমিটেন্সে পাঠান। বলা যায় কোন। বলা যায় একজন প্রবাসী কোন চাহিদা আর বিলাসিতা ছাড়া গোটা একটা জীবন পরিবার তথা দেশের জন্য উৎসর্গ করে দেন। দেশে থাকাকালীন সময়ে যে কাজ আত্মসম্মানে কারণে করতে পারেন না অথচ তার চেয়ে শতগুণ নিম্নমানের কাজ হলেও প্রবাসীরা করেন কোন অজুহাত না দেখিয়ে। দেশে থাকা মানুষজন দুই ঈদে কত সুন্দর ঈদ করে, যার নতুন জামা কিনার সামর্থ্য নেই তারেও কেউ না কেউ কিছু দেয় সেও ঈদ করে। কিন্তু প্রবাসে ঈদে নতুন জামা কিনতে খুব কম প্রাবাসীকেই দেখি, মুষ্টিমেয় কয়েকজন হয়ত কিনে। তবু প্রবাসীরা পরিবারের ঈদের খরচ কিন্তু পাঠিয়ে দেয়, পরিবার ঈদ করে, সবাই নতুন জামা কিনে, প্রবাসীরা এটুকুতেই শান্তি খুঁজে।
প্রবাসীকে বলা হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধা তবে এই যোদ্ধাদের সম্মানটা কোথাও দেওয়া হয়না। হতে হয় নানা জায়গায় লাঞ্ছনার শিকার। সমাজ কিংবা রাস্ট্র কোথাও প্রবাসীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়না। একজন প্রবাসী দেশের টানে কয়েক বছর পর ছুটিতে যায় এবং তাতেও ভোগান্তির শেষ নাই। দেশের বিমান বন্দর গুলোতে কতিপয় কর্মকর্তাদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে প্রবাসীকে। বিমান বন্দরে প্রবাসীদের সাথে করা হয় অমানবিক আচরন। এছাড়া দিন রাত মেধা ও শ্রম দিয়ে পরিবারের জন্য কেনা দামি মালামালও চুরি হয় দেশের বিমানবন্দরগুলোতে। এমন অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে, দেশের বিমানবন্দর গুলোতে যাত্রীদের মালামালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। যাত্রীদের সম্মানের ব্যাপারে উপর মহলের সার্বক্ষনিক নজদারি জোরদার করতে হবে।
সভা সেমিনারে কিংবা রাস্ট্রীয় প্রতিষ্টানের গোল টেবিলে প্রবাসীদের নিয়ে কত গুনগান কত বাহবা দেয়া হয়। অথচ বাস্তবতায় রাস্ট্রীয় কোন প্রতিষ্ঠান প্রবাসীদের সম্মান করেনা। পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে ট্রেনিং সেন্টার সবখানে একজন প্রবাসীকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ভর করে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্বীকার করা হয়। কিন্তু বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করা হয় না। ইমিগ্রেশনে ঢুকালে মনে হয় আমি কোন অপরাধী এবং অপরাধ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি। বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সঙ্গে আনা মালামাল চেকের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা এবং প্রবাসীর সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ বকশিসের নামে নিয়ে নেওয়া বিমানবন্দরের প্রতিদিনের চিত্র। বিমানবন্দরে একজন প্রবাসীর সাথে অসদাচরণ থেকে শুরু করে লাগেজে ছুড়ে ফেলা এমনকি গায়ে হাত তোলার মত ঘটনাও অহরহ ঘটছে। বিমানবন্দরে পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে শুরু মহাপরিচালক সবারই হাবভাব একই, ভদ্রতার বালাই বলতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ও নেই। নানা সময়ে প্রবাসীরা এসব নিয়ে অভিযোগ জানালেও এসবের কোন প্রতিকার এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের বিমানবন্দরের যাত্রী সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে অথবা হয়রানির শিকার হয়নি এমন প্রবাসী খুঁজে দুর্লভ। মাঝে মধ্যে সরকার প্রবাসী হয়রানি বন্ধে কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে এখনো বিমানবন্দরে চিত্র একই বরং দিন দিন প্রবাসী হয়রানির মাত্রা আরো বাড়তেছে।
শুধু বিমানবন্দরেই নয়, দুতাবাসে গিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। দুতাবাসেও দালাল চক্রের মাধ্যমে না করলে একদিনের কাজের জন্য তিনমাস টানা দুতাবাসে আসা যাওয়া করতে হয়। প্রবাসে প্রবাসীর জীবন-যাপনের সংখ্যা যেমন বাড়ছে একইসঙ্গে মৃত্যুর হারও প্রতি নিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রবাস জীবনের একটি বড় সমস্যা প্রবাসীর লাশ দেশে নেওয়া। প্রবাসে এসে অনেক রোগে আক্রান্ত হয়ে, আত্মহত্যা করে, সড়ক দূর্ঘটনায়, কর্ম ক্ষেত্রে দূর্ঘটনা সহ নানা কারণে মৃত্যু বরণ করেন। দেখা যায় মৃত প্রবাসীর লাশ যে সংখ্যক লাশ দেশে যায় তার দিগুণেরও বেশি লাশ বিদেশের মাটিতেই পড়ে থাকে। যা প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও কষ্টের।নানা জটিলতা বাধা বিপত্তির কারণে লাশ দেশে আনতে বা পাঠাতে সমস্যা হয়। এছাড়াও লাশ দেশে পাঠাতে দরকার হয় মোটা অঙ্কের টাকা যা অনেক প্রবাসীর পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে দেখা যায় কোন প্রবাসী মারা গেলে দেশে পাঠানোর জন্য চাঁদা তুলতে হয় যা একজন প্রবাসী হিসেবে খুবই লজ্জাজনক।এছাড়া লাশ নিয়ে দূতাবাসের সহায়তা নওতে গেলেেও ভোগান্তির শেষ থাকেনা। বিশ্বের যে কোন দেশে বাংলাদেশি মারা গেলে প্রবাসীর লাশ দেশে বিনা খরচে যাবে এমনটা চায় প্রবাসী এবং প্রবাসীর পরিবার।
শুধু বিমানবন্দরেই হয়রানি নয়, কোনো প্রবাসী যখন প্রবাসে বৈধভাবে কর্মরত থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, তখন প্রবাসীর লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা হয় না। মৃত প্রবাসীর সহকর্মী কিংবা প্রবাসে থাকা নিকটাত্মীয়রা আর্থিক সহায়তা করার মাধ্যমে প্রবাসীর লাশ দেশে পাঠান। কখনও কখনও মৃত প্রবাসীর বাংলাদেশি পরিবার থেকে টাকা পাঠানোর মাধ্যমে লাশ ফেরত আনতে হয়। আবার এমনও দেখা যায় যে, প্রবাসে মৃত ব্যক্তির কোনো কাছের মানুষ না থাকায় কিংবা আর্থিক সমস্যার কারণে প্রবাসেই লাশ দাফন করতে হয়। অথচ রাষ্ট্র প্রবাসীদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয় বিধায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো কোনো প্রবাসী প্রবাসে মৃত্যুবরণ করলে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচ ও দায়িত্বে প্রবাসীর লাশ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু মৃত প্রবাসীর লাশ দেশে ফেরত পাঠানো বিষয়ে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয়, তা যেকোনো মানদণ্ডে চরম অমানবিক। এছাড়া কোনো প্রবাসী যদি ঋণ করে প্রবাসে গিয়ে ঋণ পরিশোধের আগেই প্রবাসে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সহযোগিতা করা, এমন সহায়তা রাষ্ট্র তো করেই না, বরং বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠালে রাষ্ট্র উপকৃত হয়, প্রবাসীদের বাহবা দেয়া হয়। বিপরীতে প্রবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করলে রাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রাখে, যেকোনো কিছুই না দেখা যায়।
প্রবাসীদরা যাতে নিরাপদে সফর করতে পারে সেজন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী সুরক্ষা আইন করতে হবে। প্রবাসীরা দেশের সূর্য সন্তান তাই প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীদের আরো আন্তরিক হতে হবে। প্রবাসীর লাশ বিনাখরচে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে্। প্রবাসীরা ভালো থাকলে বাড়বে রেমিট্যান্স, রেমিট্যান্স বাড়লে ভালো থাকে প্রাণের বাংলাদেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই
মিনহাজ বিন মাহবুব মুক্তমত রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মান নেই দেশের বিমানবন্দরে