সুস্থ জাতি গঠনে মাদক প্রতিরোধ জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরি
২৫ জুন ২০২৪ ১৬:২২
মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় কিশোর ও তরুণ বয়স। এ সময়েই নির্ধারিত হয় একজন মানুষের ভবিষ্যৎ। নিজেকে যে নিয়ন্ত্রণ করে ভালো কাজের দিকে জীবনকে ধাবিত করতে পারে, তার ভবিষ্যৎ হয় উজ্জ্বল। আর যে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তার জীবন নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে। কিশোর ও তরুণরা সঙ্গদোষে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, ধূমপান থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। মেধাবী হওয়ার পরও তরুণরা এখন অভিশপ্ত জীবনযাপন করছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় সাফল্যের গৌরব ধরে রাখতে পারলেও স্নাতকোত্তর অর্জন সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে পারেননি বরং মাদকের অভিশপ্ত করাল গ্রাসে নিজেকে বিলীন করেছেন।
খাদিজা(কাল্পনিক ঘটনা) বেগমের ছেলে মাদক সেবন কারী। মাদকাসক্ত সন্তানের মা-বাবা তাদের ছেলে কে ছেলে হিসেবে সমাজে এখন পরিচয় দিতে চায় না। যদিও একসময় ছেলে হিসেবে তিনি ছিলেন পরিবারের আদরের সন্তান এবং তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের পথ খুঁজতেন তারা। আর এখন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজ পরিবারের কাছে।
রেখা বেগম( কাল্পনিক ঘটনা) সংসার ভালো চলছিল। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তার স্বামীকে হারান। বড় ছেলে বাবার ব্যবসায় হাল ধরে এবং সংসার চলায়। ছোট ছেলে কলেজ গণ্ডি না পেরোতেই মাদকের ছোবল তাকে গ্রাস করে। টাকার জন্য প্রায়ই পরিবারে ছেলেটি অশান্তির সৃষ্টি করে। একদিন চাহিদামতো টাকা না পেয়ে মাকে মারতে থাকলে বড় ছেলে ঠেকাতে আসে। দুই ছেলের মধ্যে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছোট ছেলে ছুরি দিয়ে বড় ছেলেকে আঘাত করলে সে মারা যায়। ভাই হত্যার দায়ে ছোট ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। রেখা বেগম তখন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
ওপরে আলোচিত দুটি পরিবারের পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসার মূল কারণ হচ্চে মাদকদ্রব্য। আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের প্রায় এক চতুর্থাংশ সর্বনাশা মাদকের কবলের শিকার। যাদের গড় বসয় ১৮ থেকে ৩২ বছর। মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করতে না পারলে তরুণ সমাজ এক ভয়াবহ সর্বনাশার কবলে প্রতিত হবে। যার প্রভাব শুধু মাদকসেবী নয়; যা সমাজ, রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত এবং বিভিন্ন অপরাধ সৃষ্টির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেসব দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার নেতিবাচক অবনতি ঘটায় এবং এই দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি পায় তাকেই মাদক বলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসাকার্যে ব্যবহার্য নয় এমন সব দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। মাদকদ্রব্য এমন এক রাসায়নিক দ্রব্য, যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে এবং আসক্তির সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি মাদকের ওপর আসক্ত হয়ে থাকে তাকে মাদকসেবী বলা হয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের উপস্থিতি অতি প্রাচীন। পূজা-পার্বণ, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বিনোদনে এদেশের অনেক আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মদ, তাড়ি, পচুঁই ও গাঁজা-ভাংয়ের প্রচলন ছিল। উপজাতীয় সংস্কৃতিতে জগরা, কানজি ও দোচোয়ানি ইত্যাদির ব্যবহার এখনও রয়েছে। আগে বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহƒত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এবং মাদকাসক্তের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মাদকাসক্তি এমন দুর্বার নেশা, যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। মাদকাসক্তি জাতীয় জীবনকে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলাটা বেশ কষ্টসাধ্য। ধূমপান জাতীয় মাদক: তামাক ও গাঁজা, তরল জাতীয় মাদক: ফেনসিডিল ও মদ। ইনজেকশন জাতীয় মাদক দ্রব্য; পেথিডিন, হোরোইন, কোকেন এবং বিভিন্ন প্রকার ঘুমের ট্যাবলেট, জুতায় লাগানো আঠা প্রভৃতি। বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকসের সঙ্গে অনেকে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েও নেশা করে থাকে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোয় মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে শতকরা ছয় গুণ। মাদক গ্রহণের অন্যতম কারণ বেকারত্ব বা কর্মহীনতা। বেকার সমস্যার আশু সমাধান করে তরুণ ও বেকারদের মধ্য থেকে মাদকাসক্তি দূর করতে হবে। মাদকের বিক্রয় ও বিপণন নিষিদ্ধ করতে হবে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও প্রকাশ্যে বেচাকেনা রোধে সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মাদকাসক্তি দূর করতে কিশোর ও যুবক সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে মাদকদ্রব্যের কুফল নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মিডিয়ার মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। ছেলেমেয়েদের প্রতি পরিবারের যত্ন ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। তারা কী করছে, কতক্ষণ বাইরে থাকে, কাদের সঙ্গে মেশে এসব খবর রাখতে হবে অভিভাবকদের। মাদকদ্রব্যের চোরাচালান ও এর প্রসাররোধে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাদকাসক্তের চিকিৎসা গ্রহণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সেই সঙ্গে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং সুস্থ ও নির্মল চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো পত্রিকার শিরোনামে‘নেশাগ্রস্ত যুবকের গুলিতে জোড়া খুন,’ ‘মাদকাসক্ত মেয়ের নিজ হাতে মা-বাবাকে খুন’, ‘ইয়াবা সেবনে বাধা দেওয়ায় খুন হলেন মা-বাবা’ ইত্যাদি খবরের পেছনের কারণ মাদকাসক্তি। এছাড়া ‘মাদকাসক্ত দেবর খুন করল তার ভাবিকে’, ‘মাদকাসক্তের হাত থেকে বাঁচতে মা খুন করলেন ছেলেকে’ পত্রিকায় প্রকাশিত ইত্যাদি শিরোনাম নাড়া দেয় আমাদের বিবেককে, যার মূলে রয়েছে মাদকাসক্তি। সুতরাং মাদকাসক্তরা তাদের স্বাভাবিক বিবেক-বুদ্ধি, মানবিক মূল্যবোধকে হারিয়ে, হয়ে ওঠে বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল। মাদকাসক্তির কারণে সমাজে বিভিন্ন অপরাধ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি এমনকি খুন-খারাপিও ঘটছে। এ মরণনেশা মাদক গ্রহণ শুধু যে তরুণরাই আসক্ত তা কিন্তু নয়, অনেক তরুণীরাও মাদক নিয়ে থাকে।
মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০ রহিত করে যুগোপযোগী আইন প্রণীত করা হয়; যা মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ নামে অভিহিত। এই আইন অমান্য করে মাদকদ্রব্য সরবরাহ, অপব্যবহার ও চোরাচালান করলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবত জীবন কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
বর্তমান সরকার মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজকে মাদকমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অধীন সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে ১৫৫টি অফিস রয়েছে। যে কোনো ধরনের মাদকের অপব্যবহার, পাচার এবং মাদকাসক্তের পুনর্বাসনের বিষয়ে তারা কাজ করে। মাদকাসক্ত লোকের সঠিক পরিসংখ্যান বলা বেশ কঠিন। তবে সারা দেশে আনুমানিক ৭০ লক্ষাধিক লোক মাদকাসক্ত। এদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে একটি করে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে দুই শতাধিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে বিনা মূল্যে রোগীদের থাকা, খাওয়া, ওষুধপত্র ও চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি রোগীর পাশাপাশি অভিভাবকদেরও বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে এসব সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মাদকদ্রব্যের প্রচার প্রসার বন্ধ করা, নজরদারি বৃদ্ধি এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে দেশ ভবিষ্যতে একটি মাদকমুক্ত জাতি পেতে পারে। তাই মাদকমুক্ত সুস্থ জাতি গঠনে চাই সবার সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত বণিক মুক্তমত সুস্থ জাতি গঠনে মাদক প্রতিরোধ জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরি