শান্ত বাহিনী আর কতকাল নকল বাঘের অভিনয় করবে
২৬ জুন ২০২৪ ১৮:৪৩
অষ্টাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ও পূর্ব ইংল্যাণ্ডে ক্রিকেট খেলা শুরু হলেও এটি সে দেশের জাতীয় খেলা হিসাবে বিবেচিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আবার বিংশ শতাব্দীতে এই খেলা সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হলেও স্বীকৃত প্রথম টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ খেলা শুরু হয় ১৮৭৭ সালে। এরপর আর এই ক্রিকেট খেলাকে পিছপা হতে হয়নি। কালের বিবর্তনে আজ ফুটবলের পরেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা। মোটামোটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বলা যায় বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে।
১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইসিসি স্বীকৃত ওয়ানডে খেলুড়ে দেশ হিসেবে ওয়ানডে খেলে আসছে। বাংলাদেশ আইসিসি’র টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক মর্যাদাপ্রাপ্ত স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে। সেবারের টুর্নামেন্টে ৪ ম্যাচের ২ টি ম্যাচে তারা জয়লাভ করে এবং বাকি ২ টি ম্যাচে পরাজিত হয়। এর সাত বছর পর ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ এশিয়া কাপে তারা সর্বপ্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটি খেলে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতে এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। বিশ্বকাপে তারা পাকিস্তান এবং স্কটল্যান্ডকে পরাজিত করে।
এটুকু ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলায় আসার ইতিহাস। এবার আসুন মূল আলোচনায়। দেখুন বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে খেলে ৩ মার্চ ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। আর প্রথম ওয়ানডে জয় লাভ করে ১৯৯৮ সালে কেনিয়া এর বিপক্ষে। একই ভাবে প্রথম টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ২৮ নভেম্বর ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আর প্রথম টি টোয়েন্টি জয় পায় সেই জিম্বাবুয়ের সাথেই। আবার বাংলাদেশ ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেললেও প্রথম টেস্ট জয় পেয়েছে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে । সেদিক থেকে বলা যায় ২০০৫ সালের পর থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম জয়ের স্বাদ পাওয়া শুরু করে। তবে সেটা খুব আহামরি ছিল না। সে থেকে ধীরে- ধীরে ক্রিকেট আমাদের আবেগের যায়গা হতে শুরু করে। বাংলাদেশ দলের ১১ জন খেলোয়াড় যখন মাঠে লড়াই করে তখন মনে হয় তাঁরা আমাদের ১৬ কোটি মানুষের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এই ক্রিকেট নামের মহাযুদ্ধে খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল খান, সাকিব আল হাসান, মুসাফির রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের মতো খেলোয়াড়রা দেশের পতাকাকে উজ্জ্বল করেছেন অনেকবার।
একসময় যে আমরা একটি ম্যাচ জেতার জন্য আক্ষেপ করতাম এখন সে আমরাই নিয়মিত ম্যাচ জেতার স্বাদ পাচ্ছি। এতে বলা যায় আমাদের এখন ক্রিকেটারদের থেকে অনেক বেশি পাওয়ার ইচ্ছে থাকে। তবে তাদের সাম্প্রতিক সময়ের খেলা দেখলে মনে হয়, তারা যেন দেশের জন্য নয় বরং নিজের জন্য খেলছে। তাদের মধ্যে এখন আর পূর্বের জয়ের নেশা দেখা যায় না। এটা তো সেই তামিম ইকবালের দল যে তামিম ইকবাল ভাঙ্গা আঙ্গুল নিয়ে এক হাতে ব্যাটিং করেছেন। এটা তো সেই মাশরাফি বিন মর্তুজার দল যে মাশরাফি একহাটুতে ৫-৬ টা অপারেশন করিয়েও দেশের জন্য লড়াই করেছেন। এটা তো সেই মুশফিকুর রহিমের দল যে মুশফিকুর রহিম শ্রীলংকার মাটিতে ২১৫ রান তাড়া করে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। কিন্তু বর্তমানে যারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের মধ্যে এই জয়ের নেশা নেই বললেই চলে। তাদের খেলা দেখলে মনে হয় কেউ জোর করে তাদের মাঠে লড়াই করতে পাঠিয়েছেন। চলুন এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলার ধরণ দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন।
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের সাথে পাঁচটি টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে যেখানে চারটি ম্যাচে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়। এতে আমি খুশি হওয়ার কিছুই দেখছি না। কারণ বর্তমান জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট টিমের যে অবস্থা এতে তাদের বিপক্ষে জয় পাওয়া আহামরি কিছু না। এরপর বাংলাদেশ আরো তিনটি টি টোয়েন্টি খেলে সদ্য ক্রিকেটে পা রাখা আমেরিকার সঙ্গে। যেখানে তিন ম্যাচের দুটিতেই বাংলাদেশ পরাজিত হয়। যদিও আমেরিকার দক্ষ কয়েকজন খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দেওয়ায় শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় লাভ করে। এরপর বিশ্বকাপের মূল পর্বের চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে বাংলাদেশ জয় লাভ করে। তবে এই ম্যাচ গুলো জেতার পিছনে শতভাগ ভূমিকা হচ্ছে তানজিম সাকিব, রিসাদ হোসাইন, মোস্তাফিজুর রহমান এবং তাসকিন আহমেদের। অর্থাৎ এই ম্যাচ গুলো জেতার পিছনে শতভাগ অবদান হচ্ছে আমাদের বোলারদের। সেই ২০১৬ সালের পর থেকেই আমাদের বোলাররা দারুন বোলিং করছেন। বোলারদের নৈপুণ্যে আমাদের হতাশ হওয়ার কিছুই দেখছি না।
তাহলে হতাশ করছে কারা? এই যে কয়েকজনের নাম বলেছি তাঁরা ছাড়া বাকি সবাই আমাদের হতাশ করেছে। আমাদের ব্যাটসম্যানরা পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই যা ইচ্ছে তা ধরনের ব্যাটিং করেছেন। তৌহিদ হৃদয় ছাড়া আর কারো ব্যাটিং দেখে মনে হয়নি তারা বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে আসছে। লিটন কুমার দাস, সৌম্য সরকার, তানজিদ তামিম, সাকিব আল হাসান, নাজমুল হোসাইন শান্ত, মাহমুদুল্লাহ, জাকির আলী সহ প্রত্যেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং করেছেন। এমনকি তাদের ব্যাটিং দেখে ভারতের রোহিত শর্মা তিরষ্কার করে বলেছেন ” এখন ই তো আসছে কয়েকটা বল মারতে দেও” । এগুলো কী আমাদের দেশের সম্মানে আঘাত করছে না ? গ্ৰুপ পর্বের একটি ম্যাচে আমাদের বোলারদের নৈপুণ্যে সাউথ আফ্রিকাকে আমরা ১১৩ রানে অলআউট করে ফেলি। টি টোয়েন্টি ম্যাচে আমাদের ব্যাটসম্যানরা এই সামান্য রানগুলোই সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন । ফলাফল আমরা ৪ রানে পরাজিত হয়। আপনি যদি বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্তান ম্যাচ দেখেন সেখানেও তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় পাবেন।
ভারতের সাথে অস্ট্রেলিয়া হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশ দলের সেমিতে খেলার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয় । এবারও আমাদের বোলারদের নৈপুণ্যে আফগানিস্তানকে আমরা ১১৫ রানে অলআউট করে ফেলি। সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য আমাদের এই রান তাড়া করতে হতো ১২.১ বলে। কিন্তু লিটন কুমার দাস ছাড়া আর কারো ব্যাটিং দেখে মনে হয়নি যে তারা সেমিফাইনাল খেলতে চায়। আমাদের সেমিতে যাওয়ার স্বপ্ন তো শেষ হলোই শেষ পর্যন্ত আর ম্যাচটিই আমরা জিততে পারিনি। অথচ সদ্য ক্রিকেটে পা রাখা আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দের মনোযোগ আর জয়ের নেশা দেখে মনে হয়েছে তারা বাংলাদেশের পূর্বেই ক্রিকেটে আগমন করেছে। আর কতো দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং দেখবো আমরা? আমাদের ক্রিকেট বোর্ড কর্মকর্তারা কখন সজাগ হবেন? কখন আমাদের ক্রিকেটে পরিবর্তন আসবে? এ প্রশ্ন গুলোর জবাব কে দিবেন? দিনের পর দিন আমরা সহজে জয় পাবো এমন ম্যাচ গুলো হেরে যাচ্ছি এর জন্য কখন ক্রিকেটারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে? আমরা ৫ম ধনী ক্রিকেট বোর্ড হয়েও কেনো আমাদের এই অবস্থা? আমাদের ক্রিকেট নিয়ে কেনো এতো কাদাছোড়াছুড়ি?
আমাদের এসকল ক্রিকেটাররা সর্বোচ্চ পরিমাণ পারিশ্রমিক নিয়ে দেশকে কী দিচ্ছেন। আহামরি কিছুই না। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ দলের প্রথম সারির একজন ক্রিকেটার মাসিক যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পান আফগানিস্তানের প্রথম সারির একজন ক্রিকেটার সে পরিমাণ পারিশ্রমিক পান একবছরে। অথচ আমাদের খেলোয়াড়দের খেলা দেখলে মনে হয় দেশের ১৬ কোটি মানুষের আবেগ – ভালোবাসা তাদের কাছে কিছুই না। তাই আমাদের ক্রিকেটারদের জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে তারা এভাবেই দায়িত্বজ্ঞানহীন খেলা প্রদর্শন করবেন আর দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবেন। হয় দেশের ক্রিকেট রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক অন্যথায় বাংলাদেশ থেকে চিরতরে ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করা হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস