Wednesday 16 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১০৪ বছরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরিফ ইশতিয়াক রাহুল
১ জুলাই ২০২৪ ১৭:৫৭ | আপডেট: ১ জুলাই ২০২৪ ১৮:০৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। আমার সারা জীবনের প্রাপ্তির খাতায় সবচেয়ে বড় সবেধন নীলমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে আরো ১ বছর অতিক্রম করলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী ও ৩টি আবাসিক হল নিয়ে যে বিদ্যাপীঠ যাত্রা শুরু করেছিলো কালের বিবর্তনে তা আজ এই দেশের সবচেয়ে প্রচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। অতিক্রম করে ফেলেছে গৌরবের শতবর্ষ। শতবর্ষের পথপরিক্রমায় একদিকে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার, অন্যদিকে জন্ম দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকেই জন্ম হয়েছিলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণার। এখান থেকেই সংগঠিত হয়েছিলো আমাদের ভাষা আন্দোলন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রের এতগুলো বিষয়ের সাথে সরাসরি জড়িত আছে বলে আমার জানা নেই। সেদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, একটি জাতিরাষ্ট্রের কারিগর, জন্মযুদ্ধের অংশীদার ও ইতিহাসের একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়ও বটে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের আলোচনায় এই প্রসঙ্গগুলো যেমন আসে তেমনি অবধারিতভাবে আরেকটি প্রসঙ্গও আসে, যা সাধারণত যুগপৎভাবে আলোচিত হয় না। হয়তো অনেকেই একমত হবেনা না, তবুও তিক্ত সত্যটি হলো, শতবর্ষের ঐতিহ্য ও গৌরবের ভারে এই বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা হলেও ক্লান্ত হয়ে গেছে। যা এর চরিত্র, কার্যক্রম ও সক্ষমতা বিশ্লেষণ করলেই আমরা অনুমান করতে পারি।

প্রতিষ্ঠার ১০৪তম বছরে এসেও এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য পরিপূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে নি। এখানে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত সিট নেই, ক্যান্টিনে মানসম্পন্ন খাবার নেই, এমনকি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও নেই। অর্থাৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংশ্লিষ্ট প্রধান যেসব দায়িত্ব আছে সবক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা ও উদাসীনতাগুলো দৃশ্যমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদ্ভুত ও কর্তৃত্ববাদী দুটি সৃষ্টি হলো গণরুম ও গেস্টরুম। একজন শিক্ষার্থীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গণরুম নামক এই অভিশাপের বৃত্তেই কেটে যায় একাডেমিক জীবনের অর্ধেক বা এরও বেশি সময়। একেকটি গণরুম যেনো ময়লার একেকটি স্তুপ, যেখানে না আছে ঘুমানোর পরিবেশ, না আছে পড়াশোনার পরিবেশ, না আছে বসবাসের পরিবেশ। পাশাপাশি আছে আধুনিক কারাগার—গেস্টরুম। এই গণরুম ও গেস্টরুমের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে একজন নবীন শিক্ষার্থী হারিয়ে ফেলে তার কোমল মন, সহজাত প্রবৃত্তি ও সৃষ্টিশীলতা। হলের আবাসিক রুমগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। ৪ জনের রুমে ৮ জন, কোথাও কোথাও ১০ জন করেও থাকতে হয়।

এছাড়াও খাবারের সমস্যা তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ক্যান্টিনগুলোতে যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় সত্যিকার অর্থে তা কোনো খাবারই নয়। গত পরশুদিনও মুহসিন হলের খাবারের মধ্যে একটা দশ টাকার নোট পাওয়া গেলো, যে ছবি ইতোমধ্যে ভাইরাল। বলতে দ্বিধা নেই, হলের ক্যান্টিনগুলোতে খাবার খাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে। এসব শিক্ষার্থীর নূন্যতম আমিষ, শর্করা বা অন্যান্য পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় না। এসব খাবার খাওয়ার পর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে আর কিছুই থাকে না। যার ফলাফল অল্পতেই রোগাক্রান্ত হওয়া, অপ্রত্যাশিতভাবে শরীরের ওজন কমে যাওয়া ও দূর্বল হয়ে পড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো একেকটা মিনি হাসপাতাল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের অবস্থা আরও শোচনীয়।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সব কাজ সবচেয়ে অজনপ্রিয় তার মধ্যে অন্যতম হলো গবেষণা। দেখা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে যতোটা আগ্রহী থাকে গবেষণায় ঠিক ততোটাই অনাগ্রহী থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে তাদের মোট বাজেটের যথাক্রমে ২৬, ২৭ ও ৩১ শতাংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দ দেয় তার বাজেটের মাত্র ২%। যদিও এই ২% বরাদ্দও মাঝে মাঝে গবেষণার কাজে শেষ করতে পারেন না গবেষকেরা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় সাফল্যের জন্য যতোটা না পত্রিকার শিরোনাম হয় তারচেয়ে বেশি শিরোনাম হয় গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির কারণে। যার কারণে প্রতিষ্ঠার ১০৪তম বছরে এসেও আমাদের প্রধান গৌরব হলো কিউএস র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫৪তম স্থান অর্জন। যেখানে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ১৭ টি বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস র্যাংকিংয়ে ৫০০ এর মধ্যে অবস্থান করছে। হয়তো বা এ কারণেই এতো পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন না।

এতো না থাকা, না পাওয়া ও হতাশার মধ্যেও যেই কথাটি সবচেয়ে বেশি সত্য, তা হলো এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন যেমন আমাদের অর্জন, তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতাগুলোও আমাদের সীমাবদ্ধতা। বিগত ১০৩ বছরের পথপরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেই পথ পাড়ি দিয়েছে আগামী ১০০ বছর হোক তার থেকেও আরো বেশি আধুনিক, যুগোপযোগী ও শিক্ষার্থীবান্ধব। রাজনৈতিক গৌরবের ভারে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জৌলুশ ফিরে পাক গৌরব পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হয়ে উঠুক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সফল হোক।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

১০৪ বছরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরিফ ইশতিয়াক রাহুল মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর