রিমার আত্মহত্যা দায় সমাজের; মোর্শেদের একার না
৫ জুলাই ২০২৪ ১৭:৪২
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। নিজের বিয়ের আগের দিন; অর্থাৎ মেহেদী সন্ধ্যার আগেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বিয়ের কনে। কারণ হিসেবে, প্রাথমিকভাবে যে জিনিসটা সবার নজরে এসেছে, সেটা যৌতুক। বিশেষ করে, আমাদের দক্ষিণ চট্টগ্রামের এ যৌতুকপ্রথা অত্যন্ত ভয়ানক এবং ভয়াবহ। যদিও কেউ এটাকে প্রকাশ্যে যৌতুক হিসেবে মানতে নারাজ, এর বিপক্ষে; তবুও আড়ালে আবডালে যৌতুকের রমরমা ব্যবসা চলছে দিনের পর দিন। বিষয়টা এমন নয় যে, মেয়ের পক্ষ থেকে যৌতুক নিয়ে ছেলে ব্যবসা করে, বিদেশ যায়। বিষয়টা হলে, বিভিন্ন নামে বেনামে উপায়ে যৌতুকের এ খড়্গ চাপিয়ে দেওয়া হয়; মেয়ে পক্ষের উপর। পক্ষান্তরে, মেয়ে পক্ষও কম যায় না; মেয়ের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা হিসাব করে দাবি করে মোটা অঙ্কের কাবিন। এ দুয়ের প্রভাব এতটা বিস্তৃত যে, কেউ এর প্রতিবাদ করেও টিকতে পারছে না; আবার মেনে নিতেও হাড়ভাঙা কষ্ট হচ্ছে।
যা ইহোক, মূল ঘটনায় আসি। জন্ম সূত্রে আমি পটিয়ার সন্তান। গলায় ফাঁস রিমা এবং তার হবু বরও আমাদের পটিয়ার, এবং দুজনেই আমাদের একই গ্রামের ছেলে-মেয়ে। আমার বাড়ি হাইদগাঁও ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডে আর আলোচিত ছোটো ভাই মোর্শেদ এবং মরহুমা ছোটো বোন ৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমার বোন রিমা মরে গিয়ে, আবারো প্রমাণ করে দিল যে, এ সমাজ অন্ধ, বধির। এখানে, ‘ আপ মার আপ মার সবাই বলে, লাটি দেওউন্নে কেউ নাই।’ আমার বোন, রিমা যখন আত্মহত্যা করে মরেই গেল; ঠিক তখনই রব উঠেছে, প্রেমিক মোর্শেদ যৌতুক লোভী। তার বিচার হোক; ফাঁসি হোক। ছোটো বোন মরহুমা রিমাও তার বিচার দাবী করেছে। কিন্তু, বোন আমার; তুমি হয়তো এটা বুঝার চেষ্টা করনি, মোর্শেদের এ লোভ তার একার নয়; তার পরিবারের, পুরো সমাজের। মোর্শেদ তোমাকে ভালোবেসেছে, তুমিও মোর্শেদকে ভালোবেসেছ; সেটা তোমাদের আবেগ। বাস্তবতা, হচ্ছে মোর্শেদ তার পরিবার ও সমাজ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পক্ষান্তরে, তুমিও আবেগের কাছেই হার মেনে নিলে। তোমার এ আত্মহত্যা প্রমাণ করে, এ সমাজ আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে কতটা ট্যাবু করে রেখেছে; তুমি যদি সেদিন সাহস করে; এ বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করতে; তুমি নিজেই ভেস্তে দিতে; সেটাই হত সমাজের মুখে চুনকালি। তুমি সেটা করলে না, কারণ, তুমি যদি সেটাই করতে, তবুও এ পরিবার, সমাজ তোমাকে সহজভাবে নিত না, তোমার টিকে থাকার লড়াই অনেক কঠিন হয়ে যেত, হয়তো তাই, নিজের “শখের পুরুষ” খ্যাতি দিয়ে, একটা ছেলেকে অপরাধী করে চলে গেলে। জানি না, তুমি কতটুকু কষ্ট নিয়ে এ ভুলটা করেছ, তবে ‘আত্মহত্যা’র মত মহাপাপ কখোনই সমাধান হতে পারে না।
আমিও সবার সাথে এটা স্বীকার করছি, মোর্শেদ একজন ব্যাংকার হিসেবে, স্বাবলম্বী পুরুষ এবং প্রেমিক হিসেবে চাইলে, সমাজের এসব ঘৃণ্য যৌতুক প্রথার বাইরে এসেও তোমাকে নিয়ে সংসার সাজাতে পারত, কিন্তু সেটা না করেই, উল্টো সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সে হয়তো বলেছে, ‘তুমি মরে যাও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’ আমার বিশ্বাস দীর্ঘদিন প্রেম করার পর, তুমি হয়তো বুঝেছ, এটা কখনোই একজন পুরুষের মনের কথা হতে পারে না। হতে পারে, এটা স্বার্থ হাসিলের জন্য, কিংবা পরিবারের চাপে মুখের কথা। তুমি ত সংসারই শুরুই করনি, তাই বুঝনি; আমাদের সংসার গুলোতে স্বামী-স্ত্রী হরহামেশাই এসব কথা বলে; আবার সংসারও করে। একটা কথা সবার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, আমরা ও আমাদের পরিবারগুলো যদি প্রকাশ্যে এসে, এসব যৌতুক, মোটা দাগের কাবিন, দেনা-পাওনা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে; তবে আমাদের যে অল্প-টেম্পারের প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে; তাতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আর আমরা খালি, কোরাস গাইব, বিচার চাই, বিচার চাই।
আমার মাথায় আসে না, আমরা কার বিচার চাইব? যে মোর্শেদের কথায় আত্মহত্যা করেছে সে মোর্শেদের নাকি মোর্শেদের পিতা-মাতার? নাকি এর বাইরে গিয়ে, যে সমাজ এমন অয়োজনে অংশ নিচ্ছে, আয়োজন করছে, প্রশ্রয় দিচ্ছে, কেউ এসব করতে অপারগ হলে, যারা সমালোচনা করে, কানাঘুষা করে; তাদের বিচার চাইব? আমার জানামতে, আমি মোর্শেদকে চিনি, ছেলেটা কিছুটা উড়নচণ্ডী, ফানি বটে। তবে এতটা লোভী হতে পারে না। যা হয়েছে, তা কেবল পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ বাস্তবতার চাপে হয়েছে। কারও আছে, তাই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় লোক দেখানোর জন্য দিচ্ছে, কেউ আছে তাই দিচ্ছে, কেউ আরেকজন নিচ্ছে তাই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিচ্ছে; যার সামর্থ্য আছে, সে এক হাজার মানুষের আয়োজন করে খাওয়াচ্ছে; এসবের প্রভাবে আমাদের কোমলপ্রাণ তরুণদের মনে খুব প্রভাব ফেলে। আমার বন্ধুর বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত করেছে, শ্বশুরবাড়ি থেকে এতকিছু দিয়েছে। আমাকেও দিতে হবে, করতে হবে। এভাবেই দেশটা রসাতলে যাচ্ছে; ডুবে যাচ্ছে যৌতুক ও অতিরিক্ত কাবিনের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে। আসুন, এসবের বিপক্ষে যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করি; প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। যদিও একদিনে সম্ভব না; তবুও চেষ্টা করতে অসুবিধা নেই। যেহেতু প্রেম-বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার কথা নিষেধ করলেও কেউ শুনবে না, তাই আমার প্রিয় ছোটো ছোটো ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিদের উদ্দেশ্য করে বলব; তোমরা বন্ধু বানাও, প্রেমিকা বানাও, জীবনসঙ্গী বানাও, এমন একজনকে; যে তোমার জন্য কেবল তার পরিবার নয়, প্রয়োজনে পুরো সমাজের বিরুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। আরেকটা কথা তোমাদের বলে যেতে চাই; “আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, পৃথিবীতে বাঁচতে হলে, যেকোনো পরিস্থিতি লড়াই করে বাঁচতে শিখ; সাহসীরা লড়াই করে বাঁচে, আর ভীতুরা আত্মহত্যা করে।” তোমাদের আবেগ তোমাদের কখনোই বুঝতে দেয় না; তোমাদের পরিবারগুলোতে তোমাদের প্রাণের মূল্য অনেক বেশি।
পরিশেষে, মোর্শেদের বিচারের চেয়েও রাষ্ট্রের কাছে বেশি প্রার্থনা করি; সরকারিভাবে, দেশে বিবাহের জন্য এমন কোনো আইন হোক; যার মাধ্যমে বিবাহগুলোকে যৌতুক মুক্ত, অতিরিক্ত কাবিনমুক্ত এবং দেনা-পাওনার লাগাম টেনে ধরা যায়। সেই সাথে আইন অমান্যকারীর ব্যক্তি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যথাযথ জবাবদিহি এবং তদারকির আওতায় আনা যায়। এমন নয় যে, বর্তমানে যে আইন আছে, তার মত আইনকরে সংবিধানে ও বিচারালয়ে বন্দি করে রাখলাম। আমরা যথাযথ আইন চাই এবং সে আইনের প্রয়োগও চাই। কেবল মোর্শেদের বিচার করেই বা কী হবে; তলে তলে, আমরা সকলেই যে যৌতুক লোভী।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, পটিয়া, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এজেডএস