Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লেট দেয়ার বি লাইট

আনোয়ার হাকিম
১১ জুলাই ২০২৪ ১৭:১৫

রবীবাবু ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল । এখনো সে জায়গাতেই সুস্থির আছেন। দু’হাতে লিখেছেন যত বেঁচেছেনও সে পরিমাণ। ছিলেন জমিদার। কিন্তু মাথায় ছিলো সাহিত্যের পোকা আর গলায় ছিলো গানের গুনগুনানি। ছিলেন ঋষি টাইপ মানুষ। কিন্তু তলে তলে প্রেমের অমৃত সুধা পান করেছেন গ-ুস গ-ুস। সম্পর্কে কাদম্বিনী দেবী ছিলেন তাঁর বৌদি। হলে কি হবে, তা নিয়েও কুলোকে আড়ালে আবডালে বসে যেন কীসব রসালো কথা বলে থাকে! অন্যের জন্য যা পরকীয়া রবীবাবুর জন্য তা নিছক প্রেমলীলা।

বিজ্ঞাপন

বিখ্যাতদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। হঠাৎ একদিন কবিতায় ট্রেনে দেখা সখী পরিবেষ্টিতা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, “আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে”? রবীবাবুর প্রেমিকাও কম যান না। সাহিত্য করে তিনিও উত্তর দিয়েছেন, “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। তাঁর ঈঙ্গিত স্পষ্ট। প্রেম অবিনশ্বর। তাই যে যাই বলুক, প্রেম তার নিজস্ব গতিপথে চলবে। আমি সাহিত্যের ছাত্র না। সাহিত্য বিশ্লেষকও না। উদ্দেশ্যও তেমন না। কাঠখোট্টা প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে পাঠক ধরে রাখার জন্য কিছু সুগন্ধি ছড়িয়ে দিলাম মাত্র। এখন আসল কথায় আসা যাক।

বিজ্ঞাপন

আমাদের এখন ক্রান্তিকাল চলছে। আমরা না চাইলেও কোথা থেকে যেন কীসব চটকদার খবর সপ্রমাণ বেরিয়ে আসছে। অথচ ঘুণাক্ষরেও আগে এরূপ কল্পনা করতে পারিনি কখনো। শীর্ষ পদধারীদের বিত্তবাসনা ও চিত্ত লালসার খবর এখন দেশ জুড়ে মুখরোচক খবর হিসেবে যত্রতত্র চর্চিত হচ্ছে। বিনোদন প্রিয় জনগণ এগুলোকে নাড়াঘাঁটা করেই তাদের বিনোদন পিয়াস মেটাচ্ছে। এর মধ্যে কোথা থেকে ইয়া বড় সাইজের এক ছাগল আবির্ভূত হলো মঞ্চে। সাথে নাদুসনুদুস এক রাখাল বালকের আস্ফালন আর উচ্ছ্বাস চিত্রও। মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাতে। তারাও কি জানত এই এক ছাগলই তাদের নিউজ খরা দূর করে দেবে? সেই ছাগল কা-ে হোমরাচোমরারা ধরাশায়ী, অনেকে এখন শীত নিদ্রায়, হয়ত কেউ কেউ পলাতক। ছাগল নিরীহ প্রাণী এতকাল জানতাম। শুধু ভ্যা ভ্যা করাই তার কাজ। মানুষের কাছে তার ইমপ্রেশন হলো, “পাগলে কী না বলে আর ছাগলে কী না খায়”। ছাগলে ঘাস পাতা খায়। কিন্তু এখন দেখছি মনুষ্য প্রজাতির অনেককেই খেয়ে দিচ্ছে। তাই অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া ব্যাক্তিরা এখন নিজ নিজ ছাগল সামলাতে ব্যস্ত।

এতকাল এটাও জেনে এসেছি হুজুররা মাঠে-ময়দানে, স্কুলে-মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, বিশেষ বিশেষ ফোরাম- সমিতির আয়োজনে ওয়াজ নসীহত করে থাকেন। এসব নিয়ে ইউটিউবে তাদের ওয়াজ প্রচার করা হয়ে থাকে। দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে-মেয়েরা তাদের বিশেষ বিশেষ বচন ও বাচন ভঙ্গি নিয়ে ট্রলও করে থাকে। আজকাল ইউটিউব আর ফেসবুকের কল্যাণে নেট দুনিয়ায় এ নিয়ে অর্থোপার্জনের বেশ ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে হুজুরদের ওয়াজ নিয়ে ট্রল করে কন্টেন্ট ক্রিয়েট করা এখন বেশ আয়যোগ্য পেশায় পরিণত হয়েছে। প্রকৃত হুজুরদের এসব ওয়াজ নসীহতে এক শ্রেণির দর্শকের আবেগ কাজ করে থাকে। আবার আরেক শ্রেণির দর্শকের কাছে তারা রীতিমত এলার্জি। দিন পরিবর্তিত হয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যের মত দৃশ্যপট বদল হয়েছে অনেক। এখন মাঠে আরেক ধরণের ‘ওয়ায়েজিনের’ আবির্ভাব ঘটেছে। এরা বৈধ সম্পদে সাধারণ শ্রেণির কিন্তু আলাদীনের চেরাগ প্রাপ্তির কারণে অবৈধ সম্পদে টাইকুন শ্রেণির। তারাই এখন ওয়াজ নসীহতে নেমে পড়েছে। দুনিয়াদারি মিছে, নিছক মায়ার খেলা, খেলতামাশা মাত্র, দান-খয়রাতেই আখেরাতের শক্ত ভিত্তি , ভোগে ভ্রান্তি, ত্যাগে শান্তি, পরোপকারই হলো আসল ধর্ম ইত্যাদি কত কি যে তারা বলেন তার সীমা-পরিসীমা নেই।

ধরাশায়ী এসব শীর্ষপদধারীদের অনেকে বলছেন এসব সম্পদ তাদের বৈধ আয়ে অর্জিত। অথচ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হচ্ছেন না তারা। পালিয়ে, গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ বলেছেন শেয়ার মার্কেটে ফেয়ার প্লে করে কামিয়েছেন। দুষ্টু লোকেরা বলছে, জুনিয়র বান্ধবীকেও আঁচল ভরে তুলে দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, অবৈধ ভাবে যা কামাই করেছেন তা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিয়েছেন। ভাবছি হঠাৎ করেই আমাদের দেশে কত বড় বড় পীর, দরবেশ, আউলিয়া, ইমামের উদ্ভব হয়েছে! ধরা খাওয়া সরকারি পদস্থরাও জুনিয়রদেরকে চান্স পেলে সৎ পথে চলার, হারাম না খাওয়ার ওয়াজ নসীহত করতেন বলে পত্রিকান্তরে দেখেছি। এসব নিয়ে উপুর্যুপরি নিউজ করায় মিডিয়া কোন এক বিশেষ সার্ভিস এসোসিয়েশনের বিবৃতির মুখোমুখি অবস্থানে পড়েছে। অস্তিত্ব রক্ষার্থে তারাও পাল্টা বিবৃতি ছুঁড়ে দিয়েছে। কেউ কারো চেয়ে কম কীসে? অন্য সার্ভিস এসোসিয়েশনগুলোও রয়েছে আতংকে। এই বুঝি থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়লো। প্রবাদে যাই থাক, যুগ পাল্টেছে। বিড়াল নিরীহ প্রাণী, অতিশয় আয়েসি ও আদুরে; সন্দেহ নেই। তবে, বিড়াল এখন অতি নগণ্য প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। সেই থলেও এখন আর নেই। বেশি পরিমাণ টাকার জন্য এককালে থলে ব্যবহার করা হত। এখন আনলিমিটেড সম্পদ ও অর্থকড়ির জন্য থলে মোটেই উপযোগী না। স্ট্যাটাসে তো নয়-ই। তাই ছাগল আর রাখাল তাদের জায়গায় আবির্ভূত হয়েছে। ‘কুত্তার বাচ্চা ফুটফুটে সুন্দর’- গানটি কিছুদিন আগে বেশ প্রচার পেয়েছিলো। এখন সে জায়গায় নাদুসনুদুস ছাগলের অভ্যুদয় ঘটেছে। আর রাখাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ততোধিক সুন্দর পুত্র-কন্যা- জায়াগণ। এদের নিয়ে এখনো কোন গান রচিত হয়েছে বলে শুনিনি।

ঘটনা- রটনার দেশ বাংলাদেশ। আবেগ যখন কাজ করে তখন বিবেক অফ থাকে। তেমনি বিবেক যখন অন থাকে তখন আবেগ পজ ম্যুডে থাকে। আবেগ-বিবেকের যৌথ কম্বিনেশন নিয়ে যারা চলেন তারা সংখ্যায় কীরূপ তার পরিসংখ্যান আছে কিনা জানিনা। তারা সংখ্যানুপাতে লঘু না গুরু তারও অনুমান করা কঠিন। তবে এতটুকু অনুমান করা মোটেই কঠিন নয় যে, আবেগ-বিবেকের যৌথ চর্চাকারীরা এখন ব্যাকফুটে। তারা আজ সমাজে, পরিবারে, কর্মস্থলে, রাষ্ট্রযন্ত্রে অচ্ছ্যুত, উপেক্ষিত, ধিকৃত। তাই, পরিত্যাজ্য।

আমরা এখন বিচিত্র সব ডামাডোল নিয়ে ব্যস্ত। এর কতক স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভুত, কিছু বহুদিনের বকেয়া বিধায় নতুন করে আলোচনায় পুনরুত্থিত আর বেশ কিছু বিষয় কারা যেন ধামাচাপা দিয়ে জনগণের চোখে ধান্ধা লাগাতে অতিশয় সক্রিয়। হয়ত অতীতের মত আজকের উদ্ভুত এসব উলঙ্গ চিত্র ততোধিক কোন কা-ে তলিয়ে যাবে কিছুসময় পর। নতুন কুশীলবদের নিয়ে মাতামাতি শুরু হবে তখন। আর এভাবেই ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে কূলে কূলে সুর-তরঙ্গ অনুরণিত হতে থাকবে। আমরা যে তিমির দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি হয়ত সে তিমিরেই থেকে যাবো।

ব্যাংক লোপাট হচ্ছে, ভল্ট খালি হচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। সংবাদ শিরোণাম হচ্ছে, নাড়াঘাটা হচ্ছে। কিন্তু শেষতক কী হচ্ছে কারো জানা নেই। এখন এসবে কারো কোনো আগ্রহও নেই। প্রকল্পের নামে, কেনাকাটার নামে, আত্মসাতের মোড়কে অর্থ ড্রেন আউট হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে জানা না গেলেও সরকারি অর্থ যে বেহাত হচ্ছে তা সত্য। নিয়োগে ‘দুর্নীতি’ এখন টপ রেটেড নিউজ। গোডাউন থেকে বেরিয়ে আসছে চমকপ্রদ সব কাহিনী। স্ব স্ব ক্ষেত্রে বাদশাহ , পীর, দরবেশ, ইমাম, ড্রাইভার, কেরাণী, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, মাস্তান, চাঁদাবাজ, ঠিকাদার, দলীয় ক্যাডার আর পিওনে কোন পার্থক্য নেই। সবাই কোটিপতি। তাও আবার মামুলী কোটিপতি না। শ’ কোটি থেকে হাজার কোটিপতি। রবীবাবু জমিদার কাম ঋষি কাম দুরন্ত প্রেমিকও ছিলেন। তাই, বাঁশী কবিতায় তিনি নিজ মনের খেয়ালেই লিখতে পেরেছেন, “হঠাৎ খবর পাই মনে/ আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানীর কোনো ভেদ নেই”। সমাজে এখন আর বিত্তবানের জাতপাতের বড়াই নেই। সবাই মিলিয়ন ডলার ক্লাবের সদস্য। টাকায় কথা বলে। একই সি-িকেটের নিচে সকলেই সকলের তরে। তাই সুরক্ষিত।

হতাশা নিয়ে জীবন চলে না। তাই মানুষ হতাশা ঝেড়ে ফেলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। চারিদিকের এতসব ডামাডোলের মধ্যে নিজেকে সুস্থির রাখতে সত্যিই শক্ত নার্ভের প্রয়োজন। সেটা ক’জনেরই বা আছে? তাই, ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভিন্ন টানেলের শেষ প্রান্তে আশার আলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। অথচ আমরা তা দেখতে চাই। তাই আশাবাদী। কিন্তু আশা সহসাই মিলিয়ে যায় যখন কিছু প্রশ্ন মাথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিলবিল করতে থাকে। এই যে এত এত রাঘব বোয়াল আর চুনোপুটি আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আকারে উঠে আসছে তাদের নাম, এদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেবে কে, কে বা কারা তাদের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করবে? যারা কর্তৃপক্ষ হয়ে বসে আছেন, যারা তাদের অধীনস্থ হয়ে পদ দখল করে আয়েশি মেজাজে আছেন আর যারা এককালে কর্তৃপক্ষ বা তাদের অধীনস্ত ছিলেন অথচ কপালের ফেরে পড়ে আজ ধরা খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা কি একই রসুনের জমাট বাধা বটম না?

বিড়ালেই আবার ফিরে আসতে হচ্ছে। প্রবাদে আছে, বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? আজ সেই বিড়াল আর নেই। সে জায়গায় ছাগলের আবির্ভাব হয়েছে। বিড়ালের জন্য যে সাইজের ঘন্টার দরকার পড়ত এখন কী সেই সাইজের ঘন্টা দিয়ে হাইব্রিড এসব ছাগলের গলায় ঘন্টা বাধা যাবে? বিশেষত যিনি বা যারা বাধবেন তাদের গলায়ও কি ঘন্টা বাধতে অন্যরা সক্রিয় থাকবে না? ঘোর অমানিশায় সামনের সব কিছুই বিভীষিকাময়, ভয়ানক বলে মনে হয়। আর পথ হারালে তো যাতনা বহু গুণ মনে হয়। আমরা কী পথ হারিয়ে ফেলেছি? এর উত্তর জানা নেই। তবে রবীবাবুর সেই ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতায় আবার ফিরে আসি- ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’। আশা করতে সাধ জাগে- তিমিরাবস্থা সত্বর কেটে যাবে। আমরা উজ্জীবিত হয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবো। আবার সব কিছু কেটেছেটে সাফসুতরো করে, পরিপাটি করে গুছিয়ে নেবো। জানি কথাগুলো অলীক স্বপ্নের মত শোনাচ্ছে। হাস্যকরও। এর চেয়ে ভালো কোন উপায় জানা নেই। কারো জানা আছে কি? সবার সুবোধ জাগ্রত হোক। আবেগ আর বিবেক একসাথে সক্রিয় থাকুক। লেট দেয়ার বি লাইট।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম মুক্তমত লেট দেয়ার বি লাইট

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর