স্মার্ট বাংলাদেশে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা
১১ জুলাই ২০২৪ ১৭:২৪
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এ বলা হয়েছে বর্তমানে দেশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে শহরে এ হার মাত্র ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ কৃষকের আবাস গ্রামে এ হার হচ্ছে ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ। অনুরূপভাবে বিভাগওয়ারি হিসাবে হাওর-বাঁওড় ও কৃষিজমি বেষ্টিত বিভাগেও (সিলেট বিভাগ) বিরাজমান সর্বাধিক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।এ কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবেও সামনে আসছে কৃষি। কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর এই হতাশার প্রভাব পড়তে পারে পুরো কৃষি খাতে। ফলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কারণে গত এক বছরে কৃষি পেশা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ। বিভিন্ন হতাশার কারণে তারা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, আয়ের বৈষম্য, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজের ক্ষেত্র কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে কৃষি পেশা ছাড়ছে মানুষ। অনেক কৃষকই এখন দেশে ফসল ফলানোর চেয়ে বিদেশে অন্যের জমি চাষ করছে। বর্তমানে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই যাচ্ছে কৃষিকাজে। শ্রমশক্তি জরিপ (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্য অনুযায়ী, কৃষি পেশায় জড়িত ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার। অথচ এর আগের বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার। কৃষকরা তাদের পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে। বিবিএস এখন জিডিপির হিসাব প্রতি প্রান্তিকেই দিয়ে থাকে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসে দেশের জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৭। এ প্রান্তিকে এসে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি এত বেশি কমেছে যে, দেশের খাদ্য উৎপাদন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। অথচ এর আগের অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষির প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি বছরই ধারাবাহিকভাবে দেশের কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে। ফলে খাদ্যপণ্যের আমদানি নির্ভরতা আরও বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে।ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে।২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় হয়,। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে সাধারন চিত্র, গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই বিধায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর । এক সময় সরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণ হলেও বর্তমানে এই ধারা রক্ষা করা যায়নি উচ্চফলনশীল বোরো ধান চাষের কারনে।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও নিজের জন্য কিছুই রাখেন না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, কৃষক যে খাদ্য ফলান, একটি পর্যায়ে গিয়ে সে খাদ্যই বেশি দামে কিনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। ওপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান, খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষক, কৃষিপ্রধান গ্রাম ও অঞ্চলই এ দেশে সর্বাধিক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। বিষয়টি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়; একই সঙ্গে ক্ষোভ এবং হতাশারও। ক্ষোভ এ কারণে, যে কৃষক এত কষ্ট করে খাদ্য উৎপাদন করল, তারাই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সর্বাধিক হারে। অথচ স্বাধীনতাউত্তরকালের অতি নিম্ন প্রবৃদ্ধি হারের দেশ থেকে বাংলাদেশ যে মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হারের দেশে রূপান্তরিত হতে পারল, তা তো মূলত কৃষি খাতে দৃঢ়, ধারাবাহিক ও অতি উচ্চ ধারার প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারার কারণেই। ১৯৭২ সালে দেশে মোট খাদ্য উৎপাদন যেখানে ছিল মাত্র ১০২ লাখ টন, সেখানে ২০২২ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন হয়েছে ৪৮৫ লাখ টন, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ গুণ। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তার মোট চাহিদা পূরণের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অন্য পেশাগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কৃষির ওপর নির্ভর পরিবারগুলোর চেয়ে অনেক কম। বিশেষ করে যারা শিল্প খাতে কাজ করেন তাদের খাবারের বিপদ সব পেশার মধ্যে সবচেয়ে কম। শিল্পের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অন্য পেশাগুলোর মধ্যে সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীলদের ২০ দশমিক ২৮৫ শতাংশ, আয় গ্রহণ করে এমন পরিবারের ২০ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রবাসী আয় গ্রহণকারী পরিবারের ২০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, অন্য পেশার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ।
বাণিজ্যিক কৃষি খামার স্থাপন করেছেন রংপুরের এক কৃষক।এ কৃষকের মতে, কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কয়েকটি কারণ আছে। আর্থিক অসচ্ছলতা ও নিজের খাদ্য মজুদের জায়গা না থাকায় উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। সিন্ডিকেট ও ফড়িয়ারা তাদের এসব পণ্য মাঠে থাকতেই কিনে নেয়। ফলে কৃষকের যখন খাবারের প্রয়োজন হয়, তখন তাকে অন্যের কাছ থেকে অনেক বেশি দামে কিনে খেতে হয়। কৃষকরা যেহেতু অল্প আয়ের মানুষ, তাদের খাদ্য কেনার সক্ষমতাও কম। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার এটি একটি বড় কারণ। আবদুস সালাম আরও বলেন, দেশে যেহেতু কৃষকের সংখ্যা বেশি তাই এ সংখ্যাটাও বেশি হবে, এটা স্বাভাবিক।এ কৃষকের মতে, এক সময় দেশে কীটনাশক অনেকটা বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল। এ কীটনাশক কৃষি জমিতে এত বেশি ব্যবহার করা হয়েছে যে, এখন এটি খুব বেশি দাম দিয়ে হলেও কৃষক কিনছেন। এখন তিনিও বিষাক্ত খাবার খাচ্ছেন, যারা কিনে খাচ্ছেন তাদেরও এসব বিষাক্ত খাবার খেতে হচ্ছে। এ কারণে পুরো দেশেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
কৃষকরা এত বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগছেন এ প্রশ্নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন বলেন কৃষকরা খাদ্য সরবরাহ করেন। বিশেষ করে এখন যে উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য এসেছে তারা সেগুলো উৎপাদন করে বিক্রি করে ফেলে। তারা নিজের খাবারের জন্য যা রাখেন সেগুলো খুবই সামান্য, অপুষ্টিকর। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তাদেরই বেশি হবে। যেমন তারা দুধ বিক্রি করে ফেলেন, নিজের জন্য রাখেন না। দুধ পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য রাখেন না। তারা দুধ বিক্রি করে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য কিছু কেনেন। তিনি বলেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কম। সে হিসেবে তারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারেন না। তারা যেসব শাকসবজি খায় সেগুলো একেবারেই নিম্নমানের, সব বিক্রি করার পর যা থাকে। এটি তো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা খাদ্য সরবরাহ করলেও পুষ্টি নিয়ে তাদের শিক্ষা কম। সেজন্য তাদের খাদ্য নিরপত্তাহীনতা বেশি। তাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর প্রভাব কৃষকদের একটি অংশের ওপর তো পড়বেই। এজন্য তাদের খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা খুব কমই উপকৃত হচ্ছেন। বিশেষ করে আলু উৎপাদনের মৌসুমেও প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে দেশে আলু আমদানি করতে হচ্ছে। ডিমের উৎপাদন যথেষ্ট থাকার পরও আমদানি করা হয়েছিল। এ ছাড়া পেঁয়াজ, চাল, মরিচসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি নির্ভরতার দিকেই ঝুঁকেছে বেশি। বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল ও খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় হয়।
খাদ্য নষ্ট ও অপচয় কমাতে পারলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ৩৭তম এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলনে খাদ্য ও পানি সংরক্ষণ এবং খাদ্য অপচয়রোধ শীর্ষক সেশনে কৃষিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রের নীতি কাঠামো ও পরিকল্পনায় কৃষক, গ্রামীণ মানুষ ও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো কিছু চিন্তা করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসনে আমলা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমতাবিহীন রাজনীতিকরাই মুখ্য ভূমিকায়। সে দেশে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে আলাদা কোনো গুরুত্ব পাবে কীভাবে?
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত স্মার্ট বাংলাদেশে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা