Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে কবে?

অমিত বণিক
১৬ জুলাই ২০২৪ ১৪:৫০

বর্ষার সময় ঝিমঝিম বৃষ্টি পছন্দ করেন না, এমন মানুষ হয়তো বেশি নেই। কিন্তু বর্ষায় ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে জলাবদ্ধতা কেউই পছন্দ করেন না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলাবদ্ধতা যেন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজধানী শহরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। বর্ষা মৌসুম এলেই নগরবাসীকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। ঢাকা শহরের অন্যতম একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলাবদ্ধতা। সামান্যতম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তা-ঘাটসহ অনেক এলাকা। ১২ জুলাইয়ের টানা বৃষ্টিতে পানিতে থৈ থৈ করে রাজধানীর অনেক এলাকা। অনেক এলাকাতে দুই-তিন ফুট পর্যন্ত পানি ওঠে। কিন্তু এই পানি নেমে যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক থেকে দুদিনও লেগে যায়। যার ফলে রাস্তা-ঘাটে মানুষ এবং যানবাহন চলাচলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালের রাতে বৃষ্টির সময় মিরপুরে ঢাকা কমার্স কলেজ এরিয়ায় রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃৃষ্টে শিশুসহ একই পরিবারের ৪ জনসহ মোট ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তারপরও আমরা কতটুকু সতর্ক হতে পেরেছি তা প্রশ্ন থেকেই যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। সেই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স-কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে-অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। অথচ এর ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঢাকার আশপাশের সব নদীর অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। আগে বৃষ্টি হলে পানি খাল দিয়ে নদীতে চলে যেত, কিন্তু এখন এসব খাল বা নদী প্রায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে শহরের পানি নেমে যাওয়ার মতো জায়গা পায় না, ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। সেইসঙ্গে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- ঢাকার দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স-কালভার্ট ও ব্রিক সুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না। ড্রেনেজ সিস্টেমেও সমস্যা রয়েছে। যেখানে সহজেই পানির সঙ্গে বিভিন্ন বর্জ্য যেমন- পলিথিন এবং অন্যান্য অপচনশীল পদার্থ ভেসে গিয়ে নালার মধ্যে আটকে যায়, ফলে পানি সহজে নিষ্কাশন হতে পারে না, সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। শহরে অনেক মানুষ থাকেন, যাদের নিজস্ব বাড়িঘর নেই। রাত হলে তাড়া আশ্রয় নেন শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে তারা সেই আশ্রয়টুকুও হারান। আবার পথচারী থেকে শুরু করে ছোট আকারের যানবাহন প্রায়ই গর্তে পড়ে যায়। তাতে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক সময় মারাত্মকভাবে আহতও হন অনেকে। তাই রাজধানী ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ নির্মাণ করা চাই। যাতে করে বৃষ্টির পানি সহজেই নদীতে চলে যেতে পারে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারি কাম্য। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স-কালভার্ট ও ব্রিক সুয়ারেজ লাইনগুলোকে সর্বদা পরিষ্কার এবং পানি চলাচলের উপযুক্ত রাখতে হবে। ঢাকার আশপাশের সব নালা-খাল ও নদীগুলোকেও সংরক্ষণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের এ বিষয়ে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে, এটি ভেবে বসে থাকলে এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ, আমরা অনেকেই বর্জ্য ড্রেনে ফেলে দিই। ফলে, তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। এই যে ব্যাপকহারে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি জনজীবনে এর প্রভাব কিন্তু মারাত্মক। যদি বলা হয়- বাংলাদেশে বর্তমানে অন্যতম আতঙ্কিত হওয়ার মতো রোগ কি- উত্তর হবে ডেঙ্গু। এই রোগের অন্যতম বাহক এডিস মশার লার্ভা সাধারণত জন্ম দেয় বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা এই পানি। আবার এই জলাবদ্ধতার ফলে দেখা যায় বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। অতিরিক্ত বর্ষায় যখন নালা-ডোবা পানিতে ভরে যায় তখন সেখান থেকে ময়লা পানি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে রোগ-জীবাণুর বিস্তার ঘটে। এর সঙ্গে অন্যতম আরেকটি সমস্যায় মানুষকে পড়তে হয় তা হলো- বিভিন্ন ধরনের চর্মজাতীয় রোগ। জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন ড্রেনেজ লাইনের পরিপূর্ণ ব্যবহার। দেখা যায়- সামান্য বৃষ্টিতেই ড্রেনগুলো পর্যাপ্ত পানি নদীতে ফেলতে পারে না। প্রথমেই আমাদের এই ড্রেনেজগুলোর নিয়মিত তদারকি করতে হবে। সারাবছর নর্দমায় যে ময়লা পড়বে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ড্রেনগুলো থেকে আগের ময়লা তুলে ফেলতে হবে। সেই সঙ্গে সব জায়গায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ নির্মাণ করতে হবে। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে প্রায়ই দেখা যায় হাতেগোনা কিছু প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো সফল হয় না। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার মোট পানির ৬০-৭০ শতাংশ আসে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে জমে থাকা পানি থেকে। বৃষ্টির পানি আগে বিভিন্ন জলাশয়ে সরে গেলেও বর্তমানে বাড়ির ছাদ থেকে পাইপে করে নেমে তা আর যাওয়ার জায়গা পায় না। ফলে বিভিন্ন নালা উপচে পানি শহরের রাস্তায় জমে যায় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। বৃষ্টির পানি অত্যন্ত উপকারী একটি জিনিস। বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবেই তা করে আসছে অনেক আগে থেকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাপার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বৃষ্টি শুরু হওয়ার ৫ মিনিট পরই পরিষ্কার পানি ঝরতে শুরু করে, যা সরাসরি পান করা যায়। প্রকৃতি প্রদত্ত এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতার অনেকাংশ নিরসন সম্ভব বলেও দাবি করেন তারা। ঢাকায় বসবাস করা প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের পানির চাহিদার সবটুকুই আসে মাটির নিচ থেকে। ভূগর্ভ থেকে এত পরিমাণ পানি উত্তোলন করার ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। যার ফলে সেখানে পানির সংকট দেখা যায় এবং এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে পানির সংকট আরও বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং সফলও হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমন অবস্থায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাংলাদেশে পানির এ বিপুল চাহিদা মেটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে এ পানি সংরক্ষণ করলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমার পাশাপাশি ঢাকায় বসবাসরত মানুষের প্রায় ১৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন পানি বিশেষজ্ঞরা। আমরা যদি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি তাহলে শহরের মানুষের পানির চাহিদা যেমন পূরণ হবে ঠিক তেমনি অলি-গলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে এটি ভেবে বসে থাকলে এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ প্রায়ই আমরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক- আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হওয়া বর্জ্য ড্রেনে ফেলে দিই। এভাবে যদি সবাই ফেলতে থাকে অল্প অল্প করে, তাহলে দেখা যায় ড্রেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বর্জ্য দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়- সামান্য বৃষ্টির ধকল এই ড্রেনগুলো নিতে পারে না। তখনই দেখা যায় জলাবদ্ধতা আর সেই সঙ্গে পানিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থ। ঢাকা বর্তমানে মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক সব ধরনের কাজ এ শহরেই। যেখানে প্রায় বাস করে দুই কোটির উপরে মানুষ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কর্মকান্ডে ঢাকা শহরকে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি মোকাবিলা করা যাবে ততই মঙ্গল। এ জন্য জনগণ এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করার বিকল্প নেই। শহরের বাসিন্দারা এর দায় কিছুতে এড়াতে পারে না আবার সরকারি সংস্থাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। বাড়তি চাপের ফলে নতুন নতুন যে আবাসন তৈরি হচ্ছে সেখানে খেয়াল রাখতে হবে পর্যাপ্ত সুয়ারেজ লাইনের ব্যবস্থার ওপর। বৃষ্টির পানি যেন সহজেই নদীতে চলে যেতে পারে সেই অংশটিতে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুয়ারেজ লাইনগুলোকে সারা বছর পরিষ্কার এবং পানি চলাচলের উপযুক্ত রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- জলাবদ্ধতা কখনো একটি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। নগরায়ণ করতে হবে পরিকল্পনা মাফিক- যেন একটি শহর তার নাগরিকদের সব ধরনের নাগরিকসেবা সহজেই দিতে পারে। ঢাকার আশপাশের সব নালা-খাল, নদীগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করে এবং আমাদের মনে রাখতে হবে জলাবদ্ধতা কখনো একটি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। নগরায়ণ করতে হবে পরিকল্পনা মাফিক, যেন একটি শহর তার নাগরিকদের সব ধরনের নাগরিকসেবা সহজেই দিতে পারে। ঢাকার আশপাশের সব নালা-খাল, নদীগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করে এবং এর বাস্তবায়নে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

অমিত বণিক জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে কবে? মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর