প্রকৃতির সাহচর্যে বেঁচে থাকে প্রাণ
২৮ জুলাই ২০২৪ ১৩:৪৯
প্রকৃতি এবং প্রাণ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। প্রকৃতি ধ্বংস হলে তা প্রাণের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। প্রকৃতির একটি উপাদানও বিনষ্ট হলে শৃঙ্খল নষ্ট হয়। যার প্রভাব থাকে সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতি বলতে পৃথিবীতে সৃষ্প প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানকেই বোঝায়। যার ওপর ভর দিয়ে মানব সভ্যতা এগিয়েছে। আমাদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সবকিছুর যোগান পাই প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছি আমরা। অথচ দরকার ছিল সঠিক ব্যবহার। পরিকল্পিত ব্যবহার। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই উন্নয়নের বলি হিসেবে প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের লোভ আর বিলাসিতার কারণেই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মারাত্বকভাবে। যার ফলে পৃথিবী নাম এই গ্রহ আজ হুমকিতে রয়েছে। মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, এখন প্রকৃতি তার পাল্টা আচরণ করছে। আমরা যা আশা করি না তেমন রুদ্র রুপ দেখতে হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাচ্ছে যা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা রোগ ব্যাধি পৃথিবীকে গ্রাস করছে। যদিও আজ প্রাকৃতিক শঙ্খলা রক্ষার কথা বলা হয় কিন্তু যত দ্রুত সেই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা রয়েছে তত দ্রুত হয় না। বারবার উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে প্রকৃতিকেই ঋণ শোধ করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। বন্যা, খরা, তাপদাহ, বজ্রপাত, অতিবৃষ্টি, সাইক্লোন ইত্যাদি মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। প্রকৃতিই যেখানে আমাদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা সেখানে প্রকৃতিই আজ আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। উষ্ণতায় পুড়ছে পৃথিবী। পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন অতীতের সময়ের চেয়ে বেশি। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক জায়গায় তীব্র তাপদাহের সতর্কবার্তা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এশিয়ার দেশ জাপান, চীনেও তীব্র তাপদাহ চলছে। এই রেকর্ড তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হলেও ভবিষ্যতে এই তাপমাত্রা নিয়মিত সহ্য করতে হতে পারে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ আরও বৃ্িদ্ধ পাবে। বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে তাপমাত্রা আরও বাড়বে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দাবানল ও পানির সংকট।বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টাদশ শতক থেকে (অর্থাৎ, যখন থেকে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হয়) এত উষ্ণ গ্রীষ্মকালের অভিজ্ঞতা সম্ভবত হয়নি বিশ্ববাসীর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তাপমাত্রর বৃদ্ধির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া “এল নিনো” নামে প্রাকৃতিক আবহাওয়া-চক্রও এর জন্য দায়ী। প্রতি তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে একবার এই “এল নিনো” দেখা দেয়; এটি দেখা দিলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
প্রকৃতিকে আমরা যতই হালকাভাবে দেখি না কেন এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘদিনের এই ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড পরিবেশ পরিবর্তন করছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। এতসব প্রাকৃতিক সংকটের মধ্যই এবারে ২৮ জুলাই পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। এটি কেবল একদিনের কর্মসূচি নয় বরং এই চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে যেন প্রকৃতি সঠিকভাবে সংরক্ষণে ভূমিকার রাখতে পারি। আমাদের বেঁচে থাকলে হলে প্রকৃতির রক্ষা করতে হবে। মানব সভ্যতার টেকসই নিরাপত্তা, খাদ্য শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গাছপালা। মানুষ তার নিজের কাজের জন্য, সভ্যতার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কেটেই চলেছে। যেখানে আমাদের কোটি কোটি গাছ লাগাতে হবে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সেখানে আমরা সামান্য কারণেই গাছ কেটে সেখানে নির্মান করছি। একটি গাছ কেবল মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় প্রকৃতির অন্যান্য বহু প্রাণীরও আবাসস্থল। পরিবেশের সবকটি উপাদান পানি, বায়ু, মাটি এবং শব্দ এই সব দূষণ ঘটছে মারাত্বকভাবে। যার ফলও হাতে নাতেই পাচ্ছে মানুষ। কারণ এটা নির্ভর করছে মানুষের চরিত্রের ওপর এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই হঠাৎ মানুষ নিজেকে বদলে ফেলবে। মানুষ নদী দখল করবে না, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করবে, বনভূমি উজাড় করে সেখানে কৃষিজমি করবে অথবা অট্ট্রালিকা গড়বে। এসব চিন্তা খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। মানুষ যা করতে পারে তা হলো নিজেকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এখনও আমরা তাই করছি। অভিজোযনের চেষ্টা করছি।
গ্রীণ হাউস গ্যাস যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী সেটি নির্গমণের মাত্রা কমাতে না পারলে বা সময়মতো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলেই পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যাবে। সেদিন কিছুই করার থাকবে না। এন্টার্কটিকার বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। নিচু দেশগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জানিয়েছেন, সেখানকার বরফ দ্রুত গলছে। নাটকীয়ভাবে কমে যাচ্ছে মহাসাগরগুলোতে পানির প্রবাহ। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার এক গবেষণায় বলেছে, বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার কারণে এন্টার্কটিকা থেকে মহাসাগরগুলোর গভীরে যে পানির প্রবাহ রয়েছে তা ২০৫০ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর প্রভাব আগামী কয়েক শতক থেকে যেতে পারে। এখানেও সমস্যা সমাধানে গ্রীণ হাউজ গ্যাসের নিঃস্বরণ মাত্রা কমিয়ে আনার কথায় জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে চাই তাহলে গ্রীণ হাউজ গ্যাসের নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এর বিকল্প নেই।
গত ২০ বছরে বিশ্বে চরম আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে মানুষের পাশপাশি অর্থনীতিরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটনা বৃদ্ধিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য বিশ্ব বসবাসের অযোগ্য নরকে পরিণত হয়ে উঠছে। জাতিসয়ঘের মতে, আগামী এক দশকে পৃথিবীর জন্য তাপপ্রবাহ এবং খরা সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে আছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংক্রান্ত অফিস ’ইউএনডিআরআর’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ফলপ্রসু ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের ব্যর্থতায় এই গ্রহ ধীরে ধীরে কোটি কোটি মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য নরকে পরিণত হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, শুধুমাত্র ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভূমিকম্প, সুনামি এবং হারিকেন সহ বিশ্ব বড় ধরনের সাত হাজার ৩৪৮ টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ’দ্য হিউম্যান কস্ট অব ডিজাস্টার্স ২০০৯ থেকে ২০১৯ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির এই রেকর্ড ১৯৮০-১৯৯৯ সালের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ওই সময় বিশ্ব চার হাজার ২১২ টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছিল। জলবায়ু সেবা পরিস্থিতি ২০২০ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানুষ নিজেদের আপাত টিকে থাকার জন্য, সুখে রাখার জন্য যে ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড করছে তার ফলে সমস্ত প্রাণীকুলের অস্তিত্ত এমনকি পৃথিবীর অস্তিত্তই বিপন্ন করছে। বিশ্ব এখনও যেপথে এগিয়ে চলেছে তাতে আগামী কয়েক দশকে এই জলবায়ুর গতি রোধ করা কঠিন হবে। কারণ মানুষ এখন জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে কিন্তু তা পুরোপুরি প্রয়োগ করা অর্থাৎ জীবাশ্ম জ¦ালানী ব্যবহার রাতারাতি ব্যবহার বন্ধ করা এত সহজ কাজ নয়। এর সাথে সভ্যতার উন্নয়নের চাকা জড়িয়ে আছে। তবে এটা বাস্তবায়িত হবে। এই জীবাশ্ম জ্বালানী পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশেই দায়ী। প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার একার নয়। সেটা সম্ভবও নয়। এই দায়িত্ব আমাদের সকলের। কারণ বাঁচার তাগিদ আমাদের সবার। আমাদের দেশের ভূখন্ডের তুলনায় প্রয়োজনীয় বনভূমি নেই। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের বৃক্ষরোপণ করতে হবে। স্থান নির্বাচন করে বনভূমি সৃষ্টি করতে হবে। কারণ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পরবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের বাস্তুভিটা হারাবে। এসব আশ্রয়হীন মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শহরমুখী হবে। এর ফলে বহুমুখী সমস্যা তৈরি হবে। প্রকৃতির পরিবর্তন আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল, অভ্যাস ও জীবনধারা প্রভৃতির পরিবর্তন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে হলে দরকার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। আজকের প্রকৃত মানুষের নির্মমতার শিকার। আর মানুষ এখন সেই কর্মকান্ডের ফল ভোগ করছে। যদি আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন না করি তাহলে ভবিষ্যতে এর ফলও আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই