বিশ্ব বাঘ দিবস: বিশ্বজুড়ে বিপন্ন বাঘের অস্তিত্ত্ব
২৯ জুলাই ২০২৪ ১৩:৩৫
ছোটবেলায় বাঘের গল্প বলে মা যখন ঘুম পাড়াতো তখন মনে হতো বাঘ বুঝি ভয়ংকর কোন প্রাণী। এখনি হয়তো এসে আক্রমণ করবে। এরকম গল্প বলেই আজও হয়তো কোন পাড়াগায়ে শিশুদের ভাত খাওয়ানো হয়, ঘুম পাড়ানো হয়। তাই বাঘের সাথে নামের পরিচয়টা সেই ছোটবেলাতেই ঘটে। তবে কমতে কমতে বাঘের সংখ্যা এতটা হ্রাস পেয়েছে যে বাঘকে দেখার জন্য খোদ বাঘের রাজ্য সুন্দরবনে গেলেও অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়। প্রোকৃতিকভারসাম্য রক্ষায় পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর জীবনধারণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যচক্রের হিসেবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় সহ নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রাণী আজ হুমকীর মুখে। যুগে যুগে বহু প্রজাতির প্রাণী পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। সেই ডাইনোসর থেকে শুরু। নিজের অস্তিত্ত টিকিয়ে রাখতে না পেরে সেসব আজ বইয়ের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এখন যেসব নিজেদের অস্তিত্ত রক্ষায় লড়াই করছে তার মধ্যে বাঘ অন্যতম। বাসস্থানের সুষ্ঠু স্থানের অভাব আর শিকারীরে দৌরাত্মে বাঘ আজ বিলুপ্তির পথে। ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘের কথা শুনলেই মনে পরে যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা বললেই চোখে ভেসে ওঠে আমাদের দেশের মাশরাফি,সৌম্যদের ক্রিকেট খেলার কথা। মাঠে বাঘের মুখোশ নিয়ে অনবরত সমর্থন করতে থাকা দর্শকদের কথা। বিশ্ব এখন আমাদের জানে আমাদের চেনে। বিশ্ব এখন এই দলকে টাইগার হিসেবেই জানে। পৃথিবীতে কয়েক প্রজাতির বাঘ আছে। তার ভেতর রয়েল বেঙ্গল টাইগার সৌন্দর্যে অতুলনীয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাস আমাদের সুন্দরবনে। ডোরাকাটা এ প্রাণী দেখতে অপূর্ব।
সুন্দরবনও বিভিন্ন কারণে প্রাণী বসবাসের উপযোগীতা হারাচ্ছে। তাছাড়া বনে মাংশাসী প্রাণীর খাদ্যের অভাব থাকায় মাঝে মাঝেই বাঘ লোকালয়ে হানা দেয়। সেসময় গ্রামবাসীর হাতে প্রাণ যায় বাঘের। রয়েছে চোরা শিকারীদের দৌরাত্ম। এমন না সময় আসে যখন ছোটবেলায় শিশুদের বাঘ এলো বলে দুধ খাওয়ানোর গল্প শুধু গল্পই থেকে যায়। বাঘ ওরা আর দেখতে না পারে। শুধু আমাদের দেশেই নয় সারাবিশ্বেই বাঘ এখন মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত। চলতি বছর শুরু হওয়া বাঘ জরিপে খুলনা অংশে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি বাঘ দেখা গেছে। দুই বাচ্চাসহ বাঘের একাধিক পরিবার দেখা গেছে। ওই এলাকায় বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। সুন্দরবনের প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চলমান জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বন বিভাগ এসব তথ্য পেয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগের জরিপকারী দলটি বলছে, সাধারণত সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে সব সময়ই বাঘ বেশি দেখা যায়। এবার সেখানেও গতবারের চেয়ে বেশি বাঘ দেখা গেছে। শিশু বাঘের সংখ্যাও গতবারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে গতবারের চেয়ে এবার সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। ২০০৪ সালে প্রথম বন বিভাগ ও আইইউসিএন যৌথভাবে সুন্দরবনে বাঘশুমারি করে। পায়ের ছাপ গুনে করা ওই জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০। পরে ২০১৫ সালে প্রথম ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে বাঘের ছবি তুলে এবং পায়ের ছাপ গণনা করে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে বাঘের ওপর জরিপ চালানো হয়।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি ৪ হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি ১ হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমির স্থলে ২৮৯ প্রজাতির প্রাণী আর জলে ২১৯ প্রজাতির প্রাণী বাস করে। ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬ টি। আর ২০১৮ সালের শুমারিতে ছিল ১১৪টি।
২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবাগ শহরে সর্বপ্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে থেকেই এই প্রাণীটির অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত ছিল প্রকৃতিবিদরা। সম্মেলনের পর থেকে বিষয়টি আরো সামনে চলে আসে। বাঘ বাঁচাতে হবে এরকম একটা চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে সকলের মধ্যে। সেন্ট পিটার্সবার্গের সম্মেলনে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে লক্ষ্যে কয়েকটি সংগঠন প্রচার প্রচারণা চালিয়েও যাচ্ছে। বাঘ টিকে আছে এমন দেশের সংখ্যা রয়েছে ১৩টি। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়া। বাঘের বর্তমানে পাঁচটি উপজাতি রয়েছে। এগুলো হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রাণ টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার ও ইন্দো চায়না টাইগার। বাঘের এই পাঁচটি প্রজাতিই অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
যে কয়েকটি দেশে বাঘ আছে তার তালিকায় আমাদের দেশের নাম আছে। কিন্তু কত বছর থাকবে সেটাই প্রশ্ন। কমতে কমতে তো আজ একেবারেই হাতে গোণা। কারণ প্রকৃতি থেকে কোন প্রাণীই হারিয়ে যাক বা বিলুপ্ত হয়ে যাক তা চাই না। যদিও ইতিমধ্যেই এ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ থেকে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে বাঘ বা বাঘের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করা নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও আামাদের দেশেই শিকারীদের কারণে বাঘের অস্তিত্ব হুমকীতে পরছে। সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যুর হচ্ছে আশংকা জনকহারে। তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সাল থেকে ২০১২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গত ৩২ বছরে সুন্দরবন ও এর আশপাশ এলাকা থেকে বিভিন্ন কারণে ৬৭ টি বাঘের মৃত্যু ঘটেছে। আগেই বলেছি বাইরের ক্রিকেট প্রিয় দেশগুলো আমাদেও টাইগারদেও দেশ বলে জেনে গেছে। কিন্তু সেই টাইগারদের যে কি অবস্থা তা তো তারা জানে না। বিশ্ব প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বাঘ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪০০০ বাঘ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আজ থেকে শত বছর আগে অর্থ্যাৎ ১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ। এই একশ বছরেই বাঘ নামক একটি প্রজাতিই নিশ্চিহ্ন হবার পথে। অনেক প্রজাতি প্রাণীর মতই একসময় এটাও না অতীত হয়ে যায়। যদিও তা কোনভাবেই কাম্য নয়। যে ১৩টি দেশে আজও বাঘ টিকে আছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে কমপক্ষে ৪৬টি। এর মধ্যে প্রাকৃতিক কারণে মরেছে ৮ বাঘ। বিভিন্ন সময় শিকারিদের হাতে বাঘ মরেছে ১৩টি। লোকালয়ে প্রবেশ করায় স্থানীয়দের হাতে মারা গেছে ৫ বাঘ। এ ছাড়া, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা গেছে এক বাঘ। বন বিভাগের থেকে পাওয়া তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি ও এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিমি এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০টি থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার কথা জানা যায়। সুন্দরবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে ১০টি। ১৪টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোনে ও বাকি ২৫টি চোরাকারবারিরা হত্যা করেছে। বনে রয়েছে একটি খাদ্য শৃঙ্খল। প্রাকৃতিকভাবে এই শৃংখল নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় বা মানবসৃষ্ট কারণে এই শৃংখলে ব্যাঘাত ঘটে। লোভী আর অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্করে পরে বাঘ মারা পরে। তারপর বাঘের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চড়া দামে বিক্রি করা হয়। যদিও আইনের কড়াকড়ির কারণে এই হার আগের চেয়ে কমে গেছে। এছাড়াও বনে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে বাঘ বন ছেড়ে লোকালয়ে আসতে বাধ্য হয়। মারা পরে মানুষের হাতে। বনের পরিমাণ কমে আসছে। আয়তনে কমে যাচ্ছে বন। বাঘের আবাসস্থল ধংস হচ্ছে। আবাসস্থল হারিয়ে এদিক সেদিক ঢুকে সেই লোকালয়ে ছুটছে। একসময় ছিল যখন বাঘ যারা শিকার করতো তাদের লোকে বাহাদুর হিসেবে জানতো।
বাঘ বনের জীববৈচিত্র, খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক। প্রতিটি প্রাণীই এই নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিটি প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকীতে থাকলে মানুষ বাদ যায় না। এটা একটা সংকেত। জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের ফলে বাঘের অস্তিত্ত্ব ভবিষ্যতে আরও বেশি সংকটে পরতে পারে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের চোরাশিকারি অবাধ বিচরণ ও বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘ বাঁচাতে, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। বিংশ শতাব্দিতেই তিন প্রজাতির বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি যে পাঁচ প্রজাতি রয়েছে তা আমরা কোন ক্রমেই বিলুপ্ত হতে দিতে পারি না। কারণ প্রকৃতি থেকে একটি প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া মানে প্রকৃতির উপর একটি বিরূপ প্রভাব পরা। আর প্রকৃতির সাথে সাময়িক লড়াই করার ক্ষমতা মানুষের আছে কিন্তু স্থায়ীভাবে সে সমস্যার মোকাবেলা মানুষ করতে পারে না। তাই পরিবেশ শৃঙ্খল রক্ষা করা আবশ্যক। আসুন সবাই বাঘ রক্ষায় সোচ্চার হই।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য বিশ্ব বাঘ দিবস: বিশ্বজুড়ে বিপন্ন বাঘের অস্তিত্ত্ব মুক্তমত