Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব কি বিলুপ্তির পথে?

অমিত বণিক
১২ আগস্ট ২০২৪ ১৬:৩৪

আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। নদীমার্তৃক আমাদের এই দেশ। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশব্যাপী। নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট নদীর সংখ্যা ১০০৮। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রবহমান নদী রয়েছে ৯৩১টি। নাব্যতা হারিয়েছে এমন নদীর সংখ্যা ৩০৮। নাব্যতা হারানো নদীর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৫টি, রংপুর বিভাগে ৭১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি, সিলেট বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি এবং খুলনা বিভাগে ৮৭টি। কিন্তু কালের বিবর্তনে কমছে নদী, খাল, বিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাশয়। যেসব নদী, খাল বা বিল রয়েছে, তাও আবার বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে।এক সময় এদেশের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশি মাছে। ওই সময়ে চাহিদার তুলনায় মাছ বেশি আমদানি হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন নদীপারের হাট-বাজারগুলোতে দেশি মাছ কেনার জন্য বছরজুড়েই ভিড় করত। চাহিদা সত্ত্বেও আমরা এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। জলাশয়ে বেড়ে ওঠা দেশি জাতের মাছের সরবরাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। হ্রাস পাওয়া কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলাশয় কমে যাওয়া। নদীতে আগের মতো আর মাছ ধরা না পড়ার কারণে মৎস্য সম্প্রদায়ের লোকজন জীবিকার তাগিদে তাদের বাপ-দাদার পেশা মাছ ধরা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে বহু মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবন ভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা দেশি মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-চ্যাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, মেনি, ভেদা, শিং, কই, টাকি, শোল, গজার, ফলি, চিতল, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, খয়রা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, কালবাউশ, বাঘাইর, ভাঙ্গন, ছোট চিংড়ি, পাতাশি, বড় বাইম, তারা বাইম, শালবাইম, চিকরা বাইম, কাকিয়া, কুইচ্চা, তারা, খোকসা, খরকুটি, বাশপাতারি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর সাড়ে ৪২ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওড়সহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ; পুকুর, ডোবার মতো বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগেই বিদেশ থেকে তেলাপিয়া ও কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে। আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুরও আনা হয়েছিল। তাছাড়াও আনা হয়েছিল পিরানহা, যা দেশি মাছের খাবার ও বাসস্থান দখল করত। অধিকন্তু কিছু বিদেশি প্রজাতির মাছ অনেক সময় দেশি মাছ খেয়ে ফেলত। যদিও পরে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরও বিদেশি প্রজাতির মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক দেশি মাছ কমে গেছে। বেসরকারি সংস্থা আরডিআরসি নদী নিয়ে গবেষণা করে থাকে। তারা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন নদীর দূষণ নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ওই গবেষণায় বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তার চিত্র খুবই ভয়াবহ। সেখানে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ গড়ে ২.০ মিলিগ্রামের নিচে। অথচ মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য পানিতে লিটারপ্রতি গ্রহণযোগ্য দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা হলো ৪.০০ মিলিগ্রাম। অপরদিকে রুই, কাতলা জাতের মাছের জন্য এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫-৭ মিলিগ্রাম। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, দেশের অধিকাংশ নদ-নদী এখন মারাত্মক দূষণের শিকার। ফলে বুড়িগঙ্গা এবং অন্য অনেক নদীতে মাছ ও অন্য জলজ প্রাণীর জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে নদীগুলোর মাছ তথা জলজ প্রাণী ধীরে ধীরে শূন্য হতে শুরু করেছে। গবেষণায় ৫৬টি নদীর ১৯টি ছিল ঢাকা বিভাগের, যেগুলোর সবই মারাত্মক দূষণের শিকার। এছাড়াও জরিপে খুলনার ৭টি, সিলেটের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮টি, রাজশাহীর ২টি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের ৪টি নদীর দূষণমাত্রা দেখা হয়। এ ছাড়াও সমুদ্রের পানিতে অম্লতা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ও অ্যাকুয়াকালচার অনেকটাই হুমকির সম্মুখীন। পানিতে এ অম্লতা বৃদ্ধি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। সরাসরি মাছের ওপর সামুদ্রিক পানির অম্লতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জাপানের নাগাসাকি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক ইউনিভার্সিটি, নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অফ বারগেন এবং জার্মানির লাইবনিজ ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্স । সমুদ্রের পানির অম্লতা বৃদ্ধির এ অবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তা হবে আরও মারাত্মক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর ফলে ২০৫০ সালের মধ্যেই পৃথিবী থেকে কোরাল রিফ হারিয়ে যেতে পারে। আর কোরাল রিফ যদি না থাকে, তাহলে এর ওপর নির্ভরশীল মাছের প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গোটা পৃথিবীর রিফ ফিশারিজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেটি মোট মৎস্য আহরণের প্রায় ৯-১২ শতাংশ। এতে পৃথিবীর প্রায় ৯৪টি দেশে কোরাল রিফের ওপর নির্ভরশীল পর্যটন শিল্পও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক আগেও দেশে ২৫০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপক হারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে সব অব্যবস্থাপনাকে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মিঠাপানির মাছগুলো এখন ধীরে ধীরে অস্তিত্বশূন্য হয়ে পড়ার পাশাপাশি অপ্রতুল হয়ে পড়ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভাণ্ডার হিসাবে খ্যাত চলনবিলের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। খরা মৌসুমে চলনবিলের কোথাও আর তেমন পানি থাকে না। বিলে আধুনিক পদ্ধতির ধান চাষের কারণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ হচ্ছে ব্যাপক হারে। এতে করে অপ্রতুল পানিতে ছাড়া মাছের ডিম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। এমনকি ভরা বর্ষা মৌসুমেও চলনবিল এলাকার হাট-বাজারগুলোতে গিয়ে তেমন দেশি মাছ চোখে পড়েনি। প্রাকৃতিক বা দেশি মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে যা করণীয়, সে সম্পর্কে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান-১. বিষ বা গ্যাস ট্যাবলেট প্রয়োগ করে মাছ ধরা শতভাগ বন্ধ করতে হবে; ২. ইরিগেশন ব্যবস্থা হতে হবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত; ৩. রাক্ষুসে জাতের মাছ উন্মুক্ত জলাশয়ে ছাড়া যাবে না; ৪. মাছের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের জলাভূমি বৃদ্ধি করতে হবে; ৫. মাছ ধরা, মাছ চাষের সুযোগ ও সরকারি জলাশয় লিজ প্রদান করে প্রকৃত জেলেদের পুনর্বাসন করতে হবে; ৬. নদ-নদীসহ সব জলাশয়ের নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিংসহ বাস্তবভিত্তিক আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ৭. দেশীয় মাছকে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক প্রজননক্ষম করতে হবে; ৮. পোনামাছ নিধনকারীকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে; ৯. রাক্ষুসে প্রজাতির বিদেশি মাছের ডিম, পোনা ও মা-মাছ আমদানি বন্ধ করতে হবে এবং ১০. দেশীয় মাছকে ব্যাপকহারে চাষের আওতায় আনতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়াও সব ধরনের জলাধার রক্ষা ও সংস্কারসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের অপ্রতুলতা রোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।

সারাবাংলা/এসবিডিই

অমিত বণিক দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব কি বিলুপ্তির পথে? মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর