প্রসঙ্গ: চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র রাজনীতি ও কিছু কথা
১৩ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৪৭
চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র রাজনীতিতে দীর্ঘসময় ধরে আওয়ামী সন্ত্রাসী তথাকথিত খুনি হাসিনার অনুসারী অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে। যেখানে কলেজের নিরীহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের হাতে প্রতিনিয়তই হেনস্তা ও নানা ভাবে লাঞ্ছনা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এমনকি খুনি হাসিনার এই নিবন্ধিত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারিও রেহাই পায়নি। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে।
কলেজ ছাত্রলীগের প্রধান দু’টি ব্লক (প্রেসিডেন্ট ব্লক– মাহমুদ, সেক্রেটারি ব্লক– সবুজ) মূলত ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্যের জানান দিতে নানান সময়, নানা বিষয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তো। ঠিক সেই সময়টাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাংশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নিরীহ সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে পুঁজি করে কলেজ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি স্বৈরশাসক খুনি হাসিনার নানান এজেন্ডা বাস্তবায়ন ভূমিকা রাখতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ কলেজ ছাত্রলীগের ফাঁদে আটকা পড়ে বিভিন্ন হামলা-মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। এইসব সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিবার আজ কতটা অসহায়? তারা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা লাভের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম কলেজের মতো একটি স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি করিয়েছে। সেইসব বাবা-মার কপালে আজ দুশ্চিন্তার ভাঁজ আছড়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তির পর থেকেই মূলত ছাত্রলীগের শীর্ষক দু’টি ব্লক তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিরুনি অভিযানের আলোকে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। দুই ব্লকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে কর্মী সংগ্রহ উৎসব প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। অনেকসময় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম কলেজে পড়তে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে হবে এমনটাই ঘোষণা করে কলেজ ছাত্রলীগ। এছাড়াও কলেজ ক্যাম্পাসে বাধ্যতামূলক ভাবে অহরহ সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে জিম্মি করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার অভিযোগও উঠেছে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও কলেজ ছাত্রলীগের বাধ্যতামূলক রাজনীতির রোষানল থেকে রেহাই পায়নি। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হই। সেদিনই কলেজ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ব্লকের কাছে আমি জিম্মি হই। তারা আমার ফোন নাম্বার নিয়ে নেয় এবং তাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে গিয়ে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করিয়ে দেয়। পরবর্তীতে তারই ধারাবাহিকতায় আমাকে প্রতিনিয়তই তাদের মিছিল মিটিং-এ যেতে বাধ্য করেছে। অনেকসময় ক্লাস থেকে টিচারের সামনে বের করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। যেখানে আমার সম্মানিত শিক্ষকগণ খুউপ লজ্জিত হতেন। আমাকে যেভাবে জিম্মি করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছে, তদ্রূপ ভাবে চট্টগ্রাম কলেজের আরও হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে তারা প্রতিনিয়তই জিম্মি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
পরবর্তীতে ২০২০ সালের শেষের দিকে আমি বিবেকের তাড়নায়, স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াই। তারপর থেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করা আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। কারণ তারা জানতো আমি জাতীয় পত্রিকায় টুকটাক সমসাময়িক বিষয়ে লেখালেখি করি। এই লেখালেখিই যেন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সমস্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে বোধহয় আমিই প্রথম কলম ধরেছি। আমার সম্মানিত শিক্ষকগণ প্রতিনিয়তই আমাকে অভয় দেখিয়েছেন। মূলত আমার শিক্ষকদের পরোক্ষ সাপোর্টে আমার বুকভরা সাহস সঞ্চারিত হতো। তারা নানান ষড়যন্ত্র করেও আমার কলমকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। চট্টগ্রাম কলেজের প্রতিটি খাতে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ এবং প্রত্যক্ষ চাঁদাবাজি ছিলো। যেমন- ভর্তিতে খাম বাণিজ্য, পরীক্ষার প্রবেশপত্র বিতরণে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন পরীক্ষার ফি নির্ধারণে ছাত্র সংসদের আড়ালে চাঁদাবাজি। এছাড়াও কলেজের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নেও সরকারি বাজেটের ফান্ড থেকেও বিশাল অঙ্কের টাকা চাঁদাবাজির জঘন্য অভিযোগও উঠেছে কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তাদের কাছে কলেজ প্রশাসন খুবই নগণ্য ছিলেন। তাদের হাতের আঙুলের ইশারায় মূলত চট্টগ্রাম কলেজ প্রশাসন পরিচালিত হতো, এমনটাই বলা যায়।
চট্টগ্রাম কলেজের নব্য নির্মিত ১০ তলা ভবনের লিফট চালুকরণে বিলম্ব ঘটায়, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিশেষ অনুরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করবার নিরিখে একটি চিঠি লিখেছিলাম। যেটা বেশক’টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এমনকি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, জনাব মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) -এর দৃষ্টিগোচর হয় এই বিষয়টি। তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ জনাব মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের সাথে আলোচনা করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এই লিফট চালুকরণ সংক্রান্ত জটিলতার নিরসন করেন। এ-ই চিঠি লেখার কারণে চট্টগ্রাম কলেজের সম্মানিত অধ্যক্ষ স্যার আমাকে তাঁর কার্যালয়ে নিমন্ত্রণ করেন। বিষয়টা আমার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিলো। স্যারের নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে গিয়ে সেদিন সর্বোচ্চ সম্মানিত হয়েছিলাম। স্যারের আতিথেয়তা ও স্নেহময় ভালোবাসা বরাবরই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
এই চিঠি প্রকাশিত হলে পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে দু’টি প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই।
১. জনাব মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের কাছ থেকে পুরষ্কার লাভ। (সেদিন জনাব অধ্যক্ষ স্যার নিজের সংরক্ষিত পার্সোনাল ডাইরিতে আমার মতো নগন্য লেখকের অটোগ্রাফ নিয়ে আমাকে সম্মানিত করেন)
২. চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কাছ থেকে তিরস্কার, থ্রেট, হুমকি এবং লাঞ্ছনা। (কলেজ ছাত্রলীগের অনুমতি ছাড়া চিঠি লেখার কারণ দেখিয়ে আমাকে নানান কৌশলে হেনস্তার শিকার হতে হয়, পাশাপাশি অশালীন ও অকথ্য ভাষায় শব্দের নির্যাতনও সহ্য করতে হয়)
লিফট চালুকরণ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টিকরণে মূলত কলেজ ছাত্রলীগ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। সেই প্রাসঙ্গিক তথ্যটি একটি বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে অবগত ছিলাম। এই চিঠি লেখার কারণে কলেজ ছাত্রলীগ ব্যতীত কলেজ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রায় সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছি।
আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমার কলম স্বাধীন। সকল প্রশংসা মহান স্রষ্টার। যিনি সর্বোচ্চ সম্মান দাতা। তিনি ব্যতীত কেউই অসম্মানিত করতে পারেন না।
শেষমেশ গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক খুনি হাসিনার পতনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্যাম্পাস আওয়ামী সন্ত্রাস মুক্ত হয়। দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসের ন্যায় সেদিন চট্টগ্রাম কলেজও খুনি হাসিনার দোসরদের পাশবিকতা থেকে মুক্তি পায়। আজ আমাদের ক্যাম্পাস স্বাধীন। আমরা স্বাধীন। চট্টগ্রাম কলেজ স্বাধীন। সর্বোপরি প্রত্যাশা, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
এস এম রাহমান জিকু প্রসঙ্গ: চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র রাজনীতি ও কিছু কথা মুক্তমত