শেখ হাসিনার পতন: সামনে পেছনে যারা ছিলো
১৩ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৪০
আমার জন্ম ১৯৯২ সালে; সে হিসেবে নিজের বয়সের অর্ধেক পার করেছি, শেখ হাসিনার শাসনামলে! ঠিক সে একই হিসেবে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা এ স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছে তাদের গড় বয়স বড়োজোর ২০-২২ বছর! আরও স্পষ্ট করে বললে, বলতে হয়; এরা যখন বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এ জায়গায় দাঁড়িয়ে বলতে পারি, আমি এবং আন্দোলনে যুক্ত প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভাই-বোনের রাজনৈতিক দলের এবং অন্যান্য সরকারের দেশ পরিচালনা নীতির তেমন স্ব-চক্ষু দর্শনের অভিজ্ঞতা নেই। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ইতোপূর্বে কোন দল বা সরকার কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, তা তারা চোখে দেখেনি! তবে তারা সবাই এটা দেখেছে এবং বুঝেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে দেশকে পরিচালিত করেছে, একটা রাষ্ট্র সেভাবে চলতে পারে না। এছাড়া, তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সেখানকার কোথাও বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কিংবা বাংলাদেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা, বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানো, নিষিদ্ধ জামাত শিবিরকে স্বীকৃতি প্রদান এসব ছিলো না। তারা কোথাও বলেনি যে, মিজানুর রহমান আজহারীকে প্রধানমন্ত্রী, আবু ত্বহা আদনানকে শিক্ষামন্ত্রী বানাবে। এসব বিষয় প্রমাণ করে যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অগ্রভাগে এবং সামনে ছিলো একমাত্র সাধারণ ছাত্রসমাজ ও তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকরা।
এছাড়াও দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেও যখন বিএনপি-জামাত এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এবং শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করাতে পারেনি, সেক্ষেত্রে এ কথা স্পষ্টত প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে একমাত্র সাধারণ ছাত্রজনতার কাছে; অন্যকোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের কাছে নয়। আওয়ামী লীগের পতনের সামনের যে কারণ, তার আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে, শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রীসভার বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের, হাসান মাহমুদ, আরাফাত রহমান, আনিসুল হক এবং পলকসহ আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সাবেক ডিবি প্রধান হারুনের বেফাঁস মন্তব্য। আওয়ামী লীগ সরকার যতই স্বৈরাচার হোক না কেন, যদি প্রধানমন্ত্রীসহ এসব মন্ত্রীরা জনগণের পার্লস বুঝে মন্তব্য করত, তবে জোর জবর্দস্তি করে হলেও এ মেয়াদ শেষ করতে পারত, কিন্তু তা আর হল না!
আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখান থেকে একটা কথা জোর দিয়েই বলতে পারি, এদেশে, সাধারণ জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলকেই এক মেয়াদের বেশি আর সহ্য করতে পারেনি। কারণ, ক্ষমতা ধরে রাখার লোভে প্রতিটি দলই যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখনই বিরোধী দল ও মতের উপর নির্যাতন নিপিড়ন করেছে এবং আবার ক্ষমতায় থাকার যতপ্রকার নীলনকশা ও কারসাজি করার সব করেছে এবং কম-বেশি তারা সফলও হয়েছে। সে সফলতার ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সালে নানা-ঘটনা চড়াই-উতরাই ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতাকে দীর্ঘ মেয়াদি করার জন্য প্রথমেই যে কাজটি করেছে, সেটা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি। দ্বিতীয় যে কাজটি করেছে সেটা হলে, দেশের বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন। সেদিনের সেই জনপ্রিয় ও নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পতনের পেছনের প্রথম সূত্রপাত বলতে গেলে, সেখানেই। দ্বিতীয় সূত্রপাত হচ্ছে, ২০০৯ সালে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ! এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিরোধী দল-মতের উপর নির্যাতন, দমন গুমসহ এমন কোনো কাজ নেই যা সরকার করেনি। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধনের নামে ২০১৩ সালে সংযোজিত ৫৭ ধারা; যা মানুষের ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে চুড়ান্তভাবে খর্ব করে এবং এ আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে জেল জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছে স্বৈরাচার! পরবর্তীতে মানুষের ভোটাধিকার হরণ, বিরোধীদল বিহীন ও ডামি বিরোধীদল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন ও সরকার গঠনসহ এহেন ঘৃণ্য কোনো কর্ম নেই যা তারা করেনি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও অনিয়ম মাধ্যমে দেশকে লুটপাট করা শুরু করে দলের ভেতরে বাইরের সবাই। কেবল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নয়, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন আমলাদেরও দিয়েছে অনৈতিক এবং অবৈধ সুযোগ সুবিধা। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলেছে সরকার সমর্থিত পা-চাটা বাহিনী, ভেঙ্গে দিয়েছে দেশের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড। কেবল তা নয়, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের এ পনেরো বছর শাসনামলে একাধিকবার শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রশ্নফাঁসসহ বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়মের মাধ্যমে দেশকে পুরোটাই বিকল করে দিয়েছে। আর এসবে জড়িত, সরকারের সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং আমলারাও এ পতনের জন্য দায়ী।
সর্বশেষ যে কারণটি বলতে যাচ্ছি, সেটা হচ্ছে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যার সাথে জড়িত, আওয়ামী লীগের জারজ সন্তান! যে সন্তান পুরো দলের এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন ঘটিয়েছে। সে সংগঠনের নাম, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’! আওয়ামী লীগের যে সুনাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য; আজকের আওয়ামী লীগের হাতে গড়া ছাত্রসংগঠন এ ছাত্রলীগ-ই সব ধূলিসাৎ করেছে। এবং এ সংগঠনই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারকে শেষ দিন পর্যন্ত, শেষ পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। আজকের যে পতন, সেটার সামনে কোটা আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ হলেও পেছনে পুরোপুরি আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন এবং অপরিপক্ক ও ঘৃণ্য রাজনীতিই দায়ী।
শেখ হাসিনার এ পতন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয়ের এ ইতিহাস এত লম্বা যে, এখানে বলে শেষ করা যাবে না। যাইহোক, যদিও একটা কথা সবাই জানি, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই!’ সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আবারও বলতে পারি; হয়তো আওয়ামী লীগ আবারও কোনো একদিন উঠে আসবে রাজনৈতিক মঞ্চে। যদি না পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা বর্তমান এবং অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে। তাছাড়া, পনেরো বছর শাসন করার পর, পনেরো ঘন্টার মধ্যে যদি একটা দলের পতন হতে পারে; সেক্ষেত্রে, কারও ক্ষমতা যে, এ বাংলাদেশে চিরস্থায়ী হবে তা কল্পনা করা বোকামি। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে কেবল এতটুকুই বলে শেষ করব, আজকে সূর্য ডুবেছে মানেই সূর্য শেষ হয়ে যায়নি, বুঝতে হবে- আগামীকাল আবার নতুন করে উঠবে সেই একই সূর্য। সুতরাং এখান থেকে দল-মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলকে শিক্ষা নিতে হবে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং রাজনীতি হওয়া উচিত কেবল জনগণের কল্যাণে- দেশের তরে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই