Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংখ্যালঘুরা কি সবসময়ই রাজনৈতিক দাবার গুটি?

সুমন বৈদ্য
১৫ আগস্ট ২০২৪ ১৮:১২

‘ধর্মযুদ্ধ’ বরাবরের মতো যেনো একটি সিনেমা। আর এই সিনেমার সবসময় ভিলেনে পরিণত হয় বরাবরের মতোন সংখ্যালঘুরা। বর্তমানে তা যেনো গণহারে পরিণত হয়েছে। যার বেশিরভাগই উৎপত্তি হয় রাজনৈতিক সংঘাত অথবা গুজব থেকে।

এই দেশের মানুষের অনেক অনুভূতি রয়েছে। দেশীয় অনুভূতি, গণতান্ত্রিক অনুভূতি, লৈঙ্গিক অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তা অনুভূতি যেনো বর্তমানে ধর্মীয় অনুভূতি। কিছু অসুদপায় মানুষ প্রস্তুত থাকে কীভাবে এই অনুভূতিতে আঘাত হেনে দেশকে অচল বানানো যায়।

বিজ্ঞাপন

কারণ এই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার নামে চলে খুন হয় মানুষ, ভাঙা হয় উপাসনালয়, আগুনে পোড়ে লোকালয়, বাস্তুচ্যুত হয় অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এই বাস্তচ্যুত হয়ে পড়ার সংখ্যাটি যেনো সংখ্যালঘুদের বেশি।

পৃথিবীর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি তৈরির এই মোক্ষম অস্ত্র ধর্ম। বিশ্বে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পূর্বাপর পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই সব সৃষ্টির মূলেই ছিলো কিছু উগ্ৰবাদী মানুষ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে গিয়েছে তা আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে ঘটছে দাঙ্গা এবং একে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপদান করা হয়েছে।এমনকি অনেকেরই নিজ ধর্মাচারের প্রতি রয়েছেন চরম উদাসীনতা। অথচ এই সব দাঙ্গায় তারাই থাকেন নেতৃত্বে।

বর্তমান থেকে শুরু করে পুরোনো দিনেও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রধান কারণ ছিলো কিছু অসাধু ব্যক্তির নোংরা রাজনীতি এবং ঘৃণ মনোভাব থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার জন্ম। যার ফলে পুরো সম্প্রদায়ের নাম রসাতলে যাওয়ার অবস্থা। বলা যায় সংখ্যালঘুই যেনো রাজনীতি খেলার অনন্য এক দাবার গুটি।

বিজ্ঞাপন

সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের ইন্ধন থাকে। এর উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলের মাধ্যমে তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। এই তৎপরতার সঙ্গে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে লুটেরা, ভূমিদস্যু ও সাম্প্রদায়িক শক্তির।

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে সহিংসতার ধরন নিয়ে বলা হয়েছে, মোট সহিংসতার ৫৯ ভাগই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে। দুটো মিলিয়ে ৭০ ভাগ সহিংসতাই আসলে ভূমিকেন্দ্রিক। সহিংসতার মাধ্যমে ২৭ ভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে। মোট ২ শতাংশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা আর ১ শতাংশ নির্বাচনকেন্দ্রিক।

শুধু যে মন্দির ভাঙচুর উদ্দেশ্য থাকে তা কিন্তু নয়, মন্দির হামলার পাশাপাশি উদ্দেশ্য থাকে জমি দখলেও সচেষ্ট ভূমিদস্যুরা। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময়ও সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হয়। তৃণমূলস্তরের কিছু অসাধু ব্যক্তি মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে গেছে।

প্রশ্ন হতে পারে মন্দির ভাঙ্গন, ভূমি সম্পত্তি – দখল কেনো টার্গেট করা হয়! এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলা বছরকে বছর অব্যাহত রাখা, যাতে এটিকে ইস্যু বানিয়ে যেকোনো দলের কিছু ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ নোংরা রাজনীতি খেলতে পারে। যার ফলে সংখ্যালঘুদের মাঝে এক ধরণের ভিত্তির সৃষ্টি হয় এবং সেইসাথে হিন্দুরা তাঁদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশের হিন্দুদের মধ্যে ভারতে চলে যাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা আছে।

সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের নির্মম পরিচয় পাওয়া যায় বিএনপি জামায়াত শাসন আমলে। ২০০১ সালে ফিরে যাওয়া যাক। সে বছর দেশ চালানোর ক্ষমতায় জুটিবদ্ধভাবে অবতীর্ণ হন বিএনপি জামায়াত। কিন্তু সেই জুটি সংখ্যালঘুদের উপর কালো ছায়া হয়ে এসেছিলো। প্রথম ১৫০ দিনে সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-ধর্ষণের মতো ১৮ হাজার অপরাধ সংঘটিত হয়। এইসব হামলায় জড়িত ২৬ হাজার ৩৫২ জনের মধ্যে বিএনপির অনেক মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যও ছিলেন। জামায়াতের হাত ধরে অবাধ লুঠপাট ও ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠেন বিএনপির নেতারা। দেশের দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলে নির্যাতনের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভোলা জেলার শুধু একটি উপজেলা চরফ্যাশনেই ৩০০ হিন্দু পরিবার হামলার শিকার হয়। বরিশালের বানারিপাড়া, উজিরপুর এবং পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে বহু হিন্দু পরিবার বসতবাড়ি ছেড়ে গোপালগঞ্জের রামশীলে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরেই তাদের নেতা-কর্মীদের কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন ৫৬৬ জন নারী। ২০০২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১ হাজার ৯১ জন। হিন্দু নারীদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তাদের সম্পত্তি গ্রাস করাটাই ছিল বিএনপি নেতাদের প্রধান লক্ষ্য।

বিএনপি জামায়াত শাসন আমলের পর আওয়ামী লীগ আমলেও চলেছে সংখ্যালঘুদের উপর রাজনৈতিক নির্যাতন।সরকারকে পতন কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, উপাসনালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটায়। এর মধ্যে নাটোর, ঢাকার ধামরাই, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরে হিন্দুদের মন্দিরে এবং যশোর, নোয়াখালী, মেহেরপুর, চাঁদপুর ও খুলনায় বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। দিনাজপুরে হিন্দুদের ৪০টি দোকান ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া রংপুরের তারাগঞ্জে আহমদিয়াদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতার নির্দেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির করেছে।

এখানেই কি শেষ! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে (ফেইসবুক) কাজে লাগিয়ে গুজবের মাধ্যমেও সংখ্যালঘুদের উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামের এক কৈর্বত সন্তানের ধর্ম অবমাননার একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হিন্দুদের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। অথচ ঘটনার সত্যতা যাচাই করে দেখা অভিযুক্ত ব্যক্তি এই কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নন।

এর ঠিক এক বছর পর ২০১৭ সালেও রংপুরের গঙ্গাচরায় এক হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয় ফেইসবুকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার। মূহুর্তেই তা সরগোল ফেলে দেয় সাধারণ জনগণের মাঝে। শেয়ারের পর শেয়ারের মাধ্যমে ভাইরাল করে এলাকায় উত্তেজনা তৈরি করে একটি চক্র।

এছাড়াও সরকারের পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি ৪০টিরও বেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলা নিউজ ছড়িয়ে দেয়। যা রিউমার স্ক্যানারের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়।

বর্তমানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতির ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থান ও কমতে শুরু করেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ জনশুমারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৫১ সালে ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ২২ ভাগ, ১৯৬১ সালে ১৮.৬ ভাগ, ১৯৭৪ সালে ১৩.৫ ভাগ, ১৯৮১ সালে ১২.১ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১০.৫ ভাগ , ২০০১ সালে ৯.২ ভাগ , ২০১১ সালে ৮.৫৪ এবং তা হ্রাস পেয়ে ০.৫৯ গিয়ে নেমে দাঁড়ায় ২০২২ সালে। ২০২২ সালে সমীক্ষায় ফুটে আসে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মোট জনসংখ্যার ৭.৯৫ শতাংশ৷

বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু সেটি রক্ষা করাই যেনো এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সব সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে একে অপরের সহযোগী হয়ে থাকতে পারে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। ফেইসবুকে অপপ্রচার থেকে শুরু করে, ভূমি দখল, জাত বৈষম্য যেসব মানুষ দ্বারা সৃষ্টি হয় তাদের উপর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সংখ্যালঘুকে রাজনৈতিক দাবার গুটি বানিয়ে যাতে একে অপরের খুনের দায়ী করা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। চাকরি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বর্ণ বৈষম্যের শিকার না হয় সজাগ থাকতে হবে। তাহলে গঠিত হবে নতুন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত সংখ্যালঘুরা কি সবসময়ই রাজনৈতিক দাবার গুটি? সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর