বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা অটুট থাকুক
১৫ আগস্ট ২০২৪ ২০:৪৭
বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবের জন্ম নেওয়া আত্মশ্লাঘার বিষয়। তিনি কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমস্ত বাঙালির নেতা এবং বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্ব। যার মধ্যে ছিল অসম্ভব রকমের সম্মোহনীয় নেতৃত্ব। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিকে যে মানুষটি আলোর পথ দেখিয়েছিল, সেই প্রবাদপ্রতীম স্বপ্নদ্রষ্টাকে বুলেটের আঘাতে হত্যা করতে একটুও বুক কাঁপেনি আমাদেরই স্বজাতীয় উচ্চাভিলাষী উশৃঙ্খল কিছু ঘাতকের। এ রকম একটি নির্মম ট্র্যাজেডি বাঙালি কখনো আশা করেনি, কিন্তু তাই ঘটেছিল এই মহামানবের জীবনে। এর মধ্যে দিয়ে আরেকবার প্রমাণ করলো বাঙালি একটি আত্মবিস্মৃত জাতি। যে জাতি সময়, জ্ঞান, কীর্তিমান, বরেণ্য পুরুষদের স্মরণ, সম্মান করতে জানেনা, সে জাতি কখনো গর্বিত জাতি হতে পারেনা। তাই বাঙালি জাতির আজ সর্বক্ষেত্রে দৈন্যদশা। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও যে জাতি স্বপ্নদ্রষ্টাকে নিয়ে বিতর্কিত, ব্যঙ্গ কুটুক্তি করতে কুন্ঠাবোধ করে না, তার চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। যে মানুষটির নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্বনেতৃত্ব অটল অথচ তার জন্মভূমিতে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ? এতেই বুঝাযায় জাতি হিসেবে আমরা কত অকৃতজ্ঞ, অশ্রদ্ধাশীল!
১৫ আগষ্ট বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনাবিধুর দিন। এই দিনে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ট সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মম, নির্দয়ভাবে নিজ বাসভবনে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। যেখানে অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি এদেশীয় সন্তান। একটি রাজনৈতিক পরিবারের একসাথে এতবেশি মানুষকে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে তেমন নজির নেই। ব্যক্তিগত জীবনে যে মানুষটি সারাজীবন বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন; ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণদান ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে বাঙালির জীবনে আকাঙ্খিত স্বাধীনতা এসেছিল, কিন্তু অল্পসময়ে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হলো। কী পরিমাণ মানুষ অকৃতজ্ঞ হলে এ জাতীয় নির্দয় ঘৃণিত কাজ করতে পারে তা ভাববার বিষয়! বঙ্গবন্ধুর পরিবার , স্বজনসহ সেদিন যারা শাহাদাত বরণ করেছিলেন তাদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। পরিবার বর্গের প্রতি রইলো অকৃত্রিম সমবেদনা। জাতির এই শ্রেষ্ট সন্তানকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু তার জীবনের একেকটি অধ্যায় প্রতিটি বাঙালির অন্তরকে আলোকিত করে, উজ্জীবিত করে একজন সত্যিকারের বাঙালি হতে প্রেরণা যোগায়। হত্যাকান্ডের সময় বিদেশে থাকায় অতিভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ট কন্যা শেখ রেহানা।
প্রত্যেক দেশ ও জাতিতে জাতির কর্ণধার, জনক বা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে কেউ না কেউ অবির্ভূত হন। সেইসব বক্তিত্ত্বগণ হন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, স্মৃতিতে-চেতনায় থাকেন অবিনশ্বর। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন, চীন দেশের জনক সান ইয়াত-সেন, ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম, মিয়ানমারের জনক অং সান, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোনো দেশে জাতির পিতাকে নিয়ে বিতর্ক জড়ায় না। একমাত্র আমাদের দেশে যুগের পর যুগ এ বিতর্কের অবসান ঘটে না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্বজুড়ে রয়েছে খ্যাতি। বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্টান, বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘাতকদের কাছে আগষ্ট বাঙালি জাতির নিশানা মুছে ফেলার মাস, অপরদিকে বাঙালির কাছে আগষ্ট হচ্ছে শোকের মাস। শোক ও শক্তিতে অটুট থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার ত্যাগী নেতাকর্মিসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ বাঙালি জাতির এই শ্রেষ্ট বীর সন্তানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করবে। দুই’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৫ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষন, নির্মম, নির্যাতনের কষাঘাত থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত সাহসী যে বীর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বপরিবার ও বেশ ক’জন নিকট আত্মীয়সহ ধানমন্ডির ৩২ নং এর ৬৭৭ নম্বরের নিজস্ব বাড়িতে স্বাধীনতার ৪ বছরের মধ্যে একদল বিপদগামী সেনা সদস্যের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই নির্মম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতি কখনো ভুলবে না।
প্রশ্ন জাগে মনে, কেন, কীই-বা কারণ ছিল এই ঘৃন্য নির্মমতার! নিকৃষ্ট, পাষন্ড, পশুত্ব জ্ঞান থাকলেই এরকম পৈশাচিক ঘটনা ঘটাতে পারে। এই হত্যাকাণ্ড সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে তার সহধমির্ণী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বঙ্গবন্ধুর ২য় পুত্র শেখ জামাল, তার স্ত্রী পারভীন জামাল রোজি, বঙ্গন্ধুর ১০ বছরের কনিষ্ঠ শিশু পুত্র শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর সেঝ বোনের স্বামী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর মেঝ বোনের বড় ছেলে ভাগিনা ফজলুল হক মনি, মনির স্ত্রী বেগম আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ, পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, সৈনিক সামছুল হক, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ১৪ বছরের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, সেরনিয়াবাতের ১২ বছরের সন্তান আরিফ সেরনিয়াবাত, বরিশাল ১ আসনের সাবেক এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র মাত্র ৪ বছর বয়সী সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের পুত্র শহিদ সেরনিয়াবাত এবং ভাগ্নে আব্দুল নইম খান। এছাড়া তাদের সাথে জীবন দিয়েছেন ৩ জন অতিথি ও ৪ জন কাজের লোক। ভোর ৫ টা ১৫ মিনিটের একটু আগে পরে একই সাথে তিনটি বাসায় ঘাতকরা হামলা শুরু করেন। প্রথমে শেখ মনির বাসায় এরপর আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় এবং সর্বশেষ জাতির জনকের বাড়িতে গুলি করে এক নিমিষে সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এই ৩ টি বাসা ছিল ধানমন্ডিতেই। সেদিন ঘাতকরা অবুঝ শিশুদেরও পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। হত্যাকাণ্ডের সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। একই কায়দায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট জাতীয় ৪ রাজনীতিবিদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, দেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জমানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা নির্মমভাবে হত্যার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী রাজনীতিকে বেশ কিছু বছর নিশ্চিন্ন করে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার লক্ষে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ইডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন, পরবর্তিতে ১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এটিকে আইনে পরিণত করেন। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কালো আইন ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে বিচারের পথ সুগম করেন। ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির সেই বাড়ির রিস্পেসনিষ্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম (মুত্যু: ২৫ আগষ্ট, ২০১৬) ঢাকার ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা (১০(১০)৯৬) দায়ের করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল (মৃত্যু: ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারক ১৮ আসামীর মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের খালাসের রায় দেন। নিন্ম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হ্ইাকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ৫ আসামিকে খালাস দিয়ে ১০ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। অপরদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখার আদেশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি মামলার তদন্তকারী অফিসার তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তে হত্যাকাণ্ডে সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আগেই তারা মারা যাওয়ায় তাদের নাম অন্তুর্ভুক্ত করা থেকে বিরত রাখা হয়।
১৯৭৫ সালের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের হত্যার দায়ে যাদেরকে বিচারের আওয়াতায় আনা হয় এদের ১২ আসামীর মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। বাকি ৫ জন ঘাতক বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। ২০০৯ সালে ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দেন। এখন দেশে ছাত্র-জনতার আকাঙ্খিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তবর্তি সরকার শাসন ক্ষমতায়। অন্তবর্তি সরকারের নিকট অনেকের মতো আমারও প্রত্যাশা জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে নিয়ে আর নয় কোনো কাদা ছোড়াছুড়ি; দলমতের উর্ধ্বে ওঠে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকীর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যথাযথ মূল্যায়ন ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই