Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষকদের অসম্মান করা প্রকৃত শিক্ষার্থীর কাজ নয়

মো. রাকিব
৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৭:৩৭

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর এই মেরুদন্ড যিনি সোজা রাখেন তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষকরা আমাদের মধ্যে বড় হওয়ার উদ্দীপনার বীজ বপন করে দেন। বলা হয়ে থাকে কোনো একটি জাতি ধ্বংস করতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের ধ্বংস করতে হয়। অর্থাৎ শিক্ষকরা হচ্ছেন একটি আধুনিক জাতি গড়ে তুলার একনিষ্ঠ কারিগর। তাই শিক্ষকদের প্রতি আমাদের অটল সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ রাখা উচিত। আসুন একটু একজন আদর্শ শিক্ষকের শিক্ষকতা জীবনী নিয়ে আলোচনা করা যাক। ব্যাতিক্রম একজন শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। প্রচন্ড রাগী হলেও মনের দিক থেকে খুবই দয়ালু শিক্ষক। যেহেতু বাবা শিক্ষক ছিলেন তাই আমার শৈশব মোটামোটি খুব কড়াকড়ির মধ্য দিয়েই গিয়েছে। বাবার শাসনকে তখন আমার মাত্রাতিরিক্ত মনে হতো। কথায় আছে একই কাজ মানুষ বার বার করলে সেটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ঠিক তেমনি বাবার এই শাসন গুলো এক সময় আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বলা যায় তিনি আমাকে একদম নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন ।

আমি যে কোনো আহামরি কেউ হয়ে উঠেছি তা কিন্তু নয়। তবে আমি একজন শিক্ষক অনুরাগী শিক্ষার্থী হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা সব সময় আমার ভাই-বোন সবাইকে বলতেন,দেখো তোমরা আমার সাথে অন্যায় করলে হয়তো আমি সন্তান ভেবে তোমাদের ক্ষমা করে দিবো কিংবা আমার মধ্যে তোমাদের প্রতি কোনো অভিমান কাজ করবে না। কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের কোনো শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করো বা তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করো তবে সেই ভয়ংকর অপরাধ থেকে তোমরা সহজে মুক্তি পাবে না। তাই আর যায় করো কখনো শিক্ষকের সম্মানে হাত দিবে না । যদি দেও তবে ভাববে তোমার আমাকে অসম্মান করছো।

বাবার একটা কথা বেশি ভালো লাগতো আমার । তিনি সব সময় বলতেন আমি পড়া না পারার জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে প্রহার করিনি। কারণ সৃষ্টিকর্তা সকলকে মেধাবী করে সৃষ্টি করেননি। তবে কোনো শিক্ষার্থীর বেয়াদবি সামনে আসলে তিনি সেটা কঠিনভাবে প্রহার করতেন। আর এভাবেই বাবার ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনী থেকে অবসরে এসেছেন।

কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো একটা সময়ে আমরা শিক্ষকদের বাঘের মতো ভয় পেতাম। ক্লাসে যেসকল দুষ্ট শিক্ষার্থী থাকতো তারা মোটামোটি শিক্ষকদের প্রহারের ভয়ে সোজা হয়ে যেতো। এরপর কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেলো শিক্ষকদের শাসন। ধীরে-ধীরে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের প্রতি ভয় আর শ্রদ্ধাবোধ কমতে শুরু হলো। আর বর্তমানের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের দেখলে মনে হয় শিক্ষকরা তাদের কাছে সহপাঠীদের মতো। আবার আমাদের শিক্ষকদের মধ্যেও এমন কিছু শিক্ষক আছেন যারা আসলেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য নন। একটি বিষয় না টানলেই নয়। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন হলো। আমরা দেখতেছি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকসহ বিভিন্ন শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলকভাবে পদত্যাগ করাচ্ছেন। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীরা যেই অবমাননাকর পন্থা বেছে নিচ্ছেন তা আমার কাছেও বেমানান লাগছে। আর এই বেমানান পন্থা বেশি বেছে নিচ্ছেন আমাদের মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা।

সম্প্রতি স্যোশাল মিডিয়ায় কতগুলো ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষক থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে তার গায়ে হাত তুলেছে। আরেকটি ভিডিওতে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক তাদের ম্যামের হাত ধরেই স্বাক্ষর করাচ্ছেন। এর চেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তারা শিক্ষকদের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে আবার উল্লাসধ্বনি দিচ্ছে। হ্যাঁ, আমি মানছি আমাদের অনেক শিক্ষকই তাদের নৈতিকতা হারিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মন বিষিয়ে রেখেছেন। তাই বলে কি শিক্ষার্থীদের কোনো অধিকার আছে একজন শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর? গায়ে হাত তোলার? কিংবা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার ?

আসেন আরেকটি ঘটনা বলি যেটি আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। আমাদের বাড়ির সামনেই একটি স্কুল আছে। গত দুইদিন ধরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতেছেন। তারা আন্দোলনে কী স্লোগান ব্যবহার করছে জানেন? অমুক স্যারের গালে-গালে      (আশা করি স্লোগানটি আপনারা বুঝতে পেরেছেন)। তখন আমি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা স্যারের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ নিয়ে এসেছো? তারা আমাকে জানায় যে, প্রধান শিক্ষক ৭০ লক্ষ টাকা দুর্নীতি করেছেন, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে জরিমানা বাবদ নেওয়া ফি তিনি কোথায় ব্যবহার করছেন? অতিরিক্ত পরীক্ষার ফি নেওয়া এই জাতীয় অভিযোগ। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম এগুলা কী তোমাদের দেখার বিষয় নাকি স্কুল কর্তৃপক্ষের? তারা কথার জবাব না দিয়েই চলে যায়।

একবার চিন্তা করুন, এই সমস্ত শিক্ষার্থীরা নিজেরাও জানে না যে তারা তাদের আওতার বাহিরের বিষয় নিয়ে একজন শিক্ষকের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করতেছে। এরকম শত শত শিক্ষা বহির্ভূত আচরণের স্বীকার হতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষকদের। আবার এই দোষ যে শুধু শিক্ষার্থীদের তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশ গড়ার কারিগররা যদি দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন, শিক্ষার্থীদের সাথে অসংগতিপূর্ণ আচরণ করেন তবে তারা তো শিক্ষকের কাতারেই পরেন না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যে ভুলটি করেন তারা আইনের কাজগুলো নিজেদের হাতে তুলে নেন। শিক্ষকদের হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের আবারও শিক্ষকদের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। না হয় অচিরেই আমরা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবো। নিজে একজন গৃহশিক্ষক হওয়ায় বলতে পারি, আমি এই পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষার্থী পড়িয়েছি খুব কম শিক্ষার্থী বলতে পারবে যে আমি পড়া না পারলে প্রহার করেছি। কিন্তু কোনো বিষয় যদি আমার কাছে বেয়াদবি মনে হয় তখন আমি সেটির প্রতিবাদ করি। কারণ আজ আমি প্রতিবাদ না করলে আগামীকাল সে একই অপরাধ অন্য শিক্ষকের সাথেও করবে।

মূল কথা হলো শিক্ষক এমন একজন কারিগর যিনি একটি অবুঝ মনকে আগামীর বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। আর এই শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করা বা শিক্ষককে অবমাননা করা খুবই ভয়ংকর রকমের অপরাধ। আমি তো বলি যে শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে সম্মান করে না সে জীবনে কোনো সুশিক্ষিত মানুষ হতে পারবে না। হ্যাঁ, শিক্ষকের ভুল হতেই পারে। তাই বলে কি একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে অসম্মান বা অপমান করতে পারবে ? অবশ্যই না। আসুন আমরা আমাদের শিক্ষকদের প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল হই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম

সারাবাংলা/এজেডএস

মো. রাকিব শিক্ষকদের অসম্মান করা প্রকৃত শিক্ষার্থীর কাজ নয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর