বিশ্ব চিঠি দিবস: চিঠি দিও প্রতিদিন
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪৪
আজ বিশ্ব চিঠি দিবস। চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে চিঠি নিয়ে এরকম আরও অসংখ্য গান, কবিতা রয়েছে। কাগজের উপর কলম দিয়ে যত্ন করে প্রিয়জনের খোঁজ খবর নেওয়ার যে পদ্ধতি তা এখন সময়ের সাথে বিলুপ্ত হয়েছে। তার জায়গায় প্রযুক্তির নিত্য নতুন পদ্ধতি এসেছে। হারিয়ে গেছে চিঠি লেখা। চিঠি লেখা আসলেই এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। এই শিল্পে রয়েছে নিপুণ কারুকাজ, আবেগ ও ভালোবাসা। ‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’- কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মত করে আজ আর আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা হয় না। কারণ চিঠি দেওয়ার বা নেওয়ারও কেউ নেই। আমরা প্রায় সকলেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে চিঠি লিখেছি। অন্তত পরীক্ষার হলে বসে একটি চিঠি তো সকলেই লিখেছি। তা সে হোক বাবার কাছে টাকা চেয়ে ছেলের চিঠি, বা ভাইয়ের কাছে অথবা হতে পারে বন্ধুকে চিঠি লেখা। আজও পরীক্ষার খাতায় চিঠি লেখা আছে। তবে বাস্তবে চিঠি লিখে ভাজ করে তা হলুদ খামে ভরে প্রিয়জনের ঠিকানায় দেওয়ার মতো মানুষ আর নেই। এত ঝামেলা করতেও ইচ্ছে হয় না! সেই আবেগটুকু নেই আর ধৈর্যও নেই। একটি চিঠি লিখতে একজন প্রেমিক বা প্রেমিকার বা নববধুর যে সময়, যে শ্রম ব্যয় হতো আজ তার কিছুই হয় না। অনেকেই তার প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রথম পাওয়া চিঠির কথা আজও মনে রেখেছে নিশ্চয়ই। এক চিঠির ভাঁজ খুলে বারবার করে পড়েছে অনেকেই। তারপর সযতনে সেই চিঠি নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছে। একটি চিঠি কেবল আবেগের বিষয়ই ছিল না। একটি চিঠিতে শেখার মতো অনেক কিছুও ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ব্যক্তির হাতের লেখা এবং শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ।
ছেলে যদি বাবার কাছে চিঠি লিখতো তাহলেও চিঠির যথাযথ নিয়ম মেনেই লিখতো। এতে তার যোগাযোগের সাথে সাথে লেখাপড়ার কাজটিও অনায়াসেই হতো। আজ যেমন মোবাইলে ফোন করে অনায়াসেই বলে দেয়া যায় তখন তা চিঠির মাধ্যমে জানাতে হতো। যে চিঠি লিখতো সে সবসময় চাইতো তার হাতের লেখা যেন যতটা সম্ভব সুন্দর হয়। কারণ সেটি কেউ পড়বে এই চিন্তা থাকতো তার মাথার ভেতর। আজ ম্যাসেজে দুচার লাইনে যা জানানো যায় চিঠিতে সেই দু’চার লাইনে কিছুই প্রকাশ করা হতো না। ফলে চিঠি লিখতে গিয়ে অনেকেই অনেক কিছু শিখতে পেরেছে। বর্তমানে ই-মেইলে আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খুদে বার্তার ভিড়ে কাগজের চিঠি হারিয়ে গেছে। ছোট ছোট বাক্যে, কাটছাঁটকৃত শব্দে বিন্যস্ত এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘টেক্সটস্পিক’। কারও সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন হলেই, চট করে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ইনবক্সে পাঠানো যায়। প্রতিবছর আজকের এই দিনে পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’। এই দিবসের শুরু ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি দেশের বড় ব্যক্তিত্বদের চিঠি পাঠাতেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি সেসব চিঠির উত্তর পেতেন না। আর যখন কোনো চিঠির উত্তর পেতেন, তখন তার আনন্দের সীমা থাকত না। সেই ভালোবাসা থেকে সিম্পকিন ২০১৪ সালে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন চিঠি লেখার চর্চা আবার ফিরে আসুক।
অথচ একসময়ে দূরে থাকা আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যমই ছিল চিঠি। শুধু দূরে নয়, অন্তরের খুব কাছের কাউকে মুখে না বলতে পারা কথাগুলোও সযতেœ সাজিয়ে নেওয়া হতো চিঠিতে। এক একটি চিঠিতে কত যে গল্প, কত যে ইতিহাস থাকত! একটি দিবস দিয়ে সেই দিবসের সবকিছু বোঝানো সম্ভব নয়। তবুও চিঠি দিবসের কথা মনে হলেই ওপরের শব্দ কয়টির কথা মনে পরে। চিঠির সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পরে। প্রথমে যতœ করে চিঠি লেখা, তারপর সেই চিঠি হলুদ রংয়ের খামে ভরে ডাকঘরে যাওয়া এবং তারপর সেই চিঠি ডাকবাক্সে ফেলা। একথা স্বীকার করি যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে মানুষের বহুবিধ উপকার সাধিত হয়েছে। তাছাড়া আজকাল মানুষের কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে। পেছনে ফেরার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। এত সময় নিয়ে, এত ধৈর্য নিয়ে চিঠি লেখা এবং তা ডাকবাক্সে ফেলার মতো সময়ও হয়তো মানুষের নেই। তাই চট করে অতি সংক্ষেপে ম্যাসেজে জানিয়ে রাখাই উত্তম মনে করে। তা হলেও এত স্মৃতি যার সাথে জড়িয়ে আছে তা টিকে থাক আজন্মকাল। এ কথা ঠিক যে চিঠি লেকা হারিয়ে গেছে। এটা আর ফেরানো সম্ভব হবে না। তবে আমরা চাইলে কিন্তু এটা অন্তত টিকে থাকতে পারে। হতে পারে তা প্রতিযোগীতার মাধ্যমে অথবা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে যেখানে হাতে চিঠি লেখাই হবে যোগ্যতার প্রমাণ। এ কথা তো সত্যি যে এই চিঠি লেখা আমাদের লেখার দক্ষতাও বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে যা আজকের বাংলিশ ধরনের ম্যাসেজে সম্ভব না।
লেখক: কলামিস্ট