Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের বোধের সীমাবদ্ধতা

আনোয়ার হাকিম
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৪

নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে মানুষের জীবনযাপন। একে অতিক্রম করতে তাই অহর্নিশ কত কী যে আমরা করে থাকি তা নিজেও ঠিক মত খেয়াল করি না। সব কিছু শেষে আমাদের বোধে ঢুকে গেছে ‘অর্থই সব শক্তির মূল’। অর্থই বিপদের একমাত্র বন্ধু। কে বলে ‘অর্থই অনর্থের মূল’? পরিবর্তিত এই বোধের মূলে রয়েছে সাম্প্রতিক বছর গুলোতে কিছু লোকের বিত্তের পাহাড় গড়া আর তা থেকে ঝিলিক দেওয়া সোনালী সূর্যের আভা। ক্ষণিকের এ আভাকে যারা চিরস্থায়ী ভেবে পাহাড়ের পর পাহাড় গড়তে মশগুল তারা ভেবে দেখেন নি একটু পরেই টুপ করে সূর্য ডুবে যাবে। ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে যার যার আপন ভুবন। চিত্তচাঞ্চল্য স্থিমিত হয়ে যাবে, তখন মুখোমুখি একান্তে বসবার মত কেউই থাকবে না।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই ভাবান্তর রেসের ঘোড়ার মত আমাদেরকে কেবল তাড়িয়ে নিয়েই বেড়িয়েছে। এক দ- শান্তিও দেয়নি ঠা-া মাথায় ভাববার। যারা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই পথে চলা অনুচিত, এত বেগ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এত অনিয়ম, উৎশৃংখলতা সমূহ বিপদ ডেকে আনবে তাদেরকে পরশ্রীকাতর জ্ঞান করে, ভদ্রবেশী শত্রু হিসেবে ধরে নিয়ে পারলে দশ হাত দেখিয়ে দিয়েছি নয়ত তাদেরকে সিলেবাস বহির্ভূত অধ্যায় হিসেবে অপাঠ্য করে নিয়েছি। আমাদের অর্থ আছে, অর্থ-বিত্তের নেশা আছে। আছে সুকঠিন অতি আপন ‘অলিগার্ক’। আর আছে প্রভু, বিশাল ক্ষমতাধারী, চিরঞ্জীব। আমরা তার খাস বরকন্দাজ, কামেল কারিগর। ভেবে নিয়েছিলাম এভাবেই ইতিহাসে অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবেন আমাদের প্রভু, আমরাও হয়ে উঠবো যার যার ভুবনে এক একজন শ্রদ্ধেয়, নমস্য, অপ্রতিরোধ্য সেনাপতি। ভুলেই গিয়েছিলাম বাল্যপাঠের কথা, মনীষীদের বচন। সেকালের ওসব পোড় খাওয়া দারিদ্র্য পীড়িত মনীষিদেরকে মনে হয়েছিল হতাশাক্লিষ্ট বিকট প্রতিভা। কত কথাই যে তারা বলেছেন! তার কোনটা অবাস্তব, কোনটা আবেগতাড়িত, কোনটা বঞ্চনাজনিত আর পুরোটাই দারিদ্রতা জনিত।

বিজ্ঞাপন

সময় গড়িয়েছে, যুগ পাল্টেছে, মানুষের রুচি, অভ্যেস, পছন্দ পরিবর্তিত হয়েছে। তাই ওসব অমিয় বচন এখন অচল। একজন বলেছিলেন অর্থই অনর্থের মূল। যার অর্থ নেই তার কাছে এরূপ ধারণা করাই সঠিক। যার অর্থ নেই তার স্বপ্ন নেই, আছে খেদ। আরেকজন অর্থকে দেখেছেন ‘পাতকী অর্থ’ হিসেবে। তিনি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এরূপ বলেছেন। দুনিয়া দু’দিনের। ক্ষণিকের আবাস। মরণ একমাত্র সত্য। এরপরের জীবনে অর্থের লেনাদেনা নেই। সেখানে যাপিত জীবনে উপার্জিত পাথেয়ই একমাত্র বিনিময় মাধ্যম ইত্যাদি। এরূপ কথা বাল্যকাল থেকে মগজে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে; যার ভিত্তি ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। যারা বিশ্বাসী তারা চিন্তায়, কর্মে, সৃজনশীলতায় কমজোর। তাই অর্থই শেষ কথা, বিপুল অর্থসম্ভারই একমাত্র রক্ষাকবচ।

সময় আসে, আবার গড়িয়েও যায়। ভেবে দেখার সময় কই? তাই, কামেলদের দেখানো মসৃণ পথে এই নিরন্তর হেঁটে চলা। কে জানত সামনে এমন ভয়ানক সুনামী ফাঁদ পথে বসে আছে? কে জানত বঞ্চিতদের এত বড় আওয়াজ সমূল বিধ্বংসী হয়ে উঠবে? কে জানত শক্ত কংক্রিটের অলিগার্ক এত সহজেই ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে যাবে। কে জানত সাজানো ঘরগুলো তাসের ঘরের চেয়েও স্বল্প সময়ে মাটিতে মিশে যাবে, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? কে জানত এত শক্ত ব্যুহ ভেদ করে তেড়ে আসা পিপীলিকার দল নিমিষেই মারণ কামড় বসাবে? একেই বোধহয় বলে কলিকাল! দেখার ছিলো, তাই দৃশ্যমান হলো।

আমাদের বোধে ছিলো তরুণ প্রজন্ম অতিমাত্রায় ‘স্বপ্নবিলাসী’। উরাধুরা জীবনে অভ্যস্ত। দেশ বিমুখ, বিদেশ কাতর। এদের রক্তে পশ্চিমা রিদম, চোখে ওয়েস্টার্ন ভাইব। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ব্যাক্তির স্বাধীনতা, যখন যা ইচ্ছে তাই। এরা রাত জাগে, কীসব কায়কারবার করে আর দিনভর ঘুমোয়। এরা গোল্লায় যাওয়া, অবাধ্য, বেয়াদব কেমন যেন অতি স্বার্থপর! এরাও অর্থের কাঙ্গাল। প্রচুর অর্থ ছাড়া এদের চলাফেরা স্থবির হয়ে পড়ে। এদের মেজাজ-মর্জির ঠিক নেই। এরা পরিবারের চেয়ে বন্ধু প্রবণ বেশি। আবার বন্ধুর চেয়েও গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড সমর্পিত প্রাণ।

আমরা ধরেই নিয়েছি, এরা সুযোগ সন্ধানী। চান্স পেলেই দেশান্তরি হয়ে যাবে, শিকড় উপড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। এদের কাছে দেশ পাড়া গাঁয়ের চেয়েও পুঁতিগন্ধময়। বিদেশ তাদের কাছে ঝলমলে। তাই এখানকার ছাপোষা কেরাণীর জীবনের চেয়ে বিদেশের অড জব শ্রেয়তর। এদের কাছে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ঢিলেঢালা গোছের, পানসে, কোন রিদম নেই, সর্বত্র সর্বহারাদের মত অতি আবেগী কণ্ঠ। কোন ভেরিয়েশন নেই। এখানে ঘাট আঘাট হয়ে দিব্যি করে খাচ্ছে। প্রাপ্যের আসন অপ্রাপ্যরা অলংকৃত করছে। সবাই তা মেনেও নিচ্ছে। এখানে পদ-পদবী-পুরষ্কারে প্রভুর মনোরঞ্জনই একমাত্র নিয়ামক। এখানে মেধা মানে বিনিময়যোগ্য বন্ধকী সম্পত্তি। যা বন্ধক রেখে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মালিক হওয়া যায় খুব সহজেই। এখানে পড়ালেখার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। হেসেখেলে যতটুকু করা যায় তা-ই সই।

প্রজন্মের তারুণ্যকে আমরা এভাবেই ভেবেছি, এবাবেই দেখেছি, সেভাবে মেনেও নিয়েছি। কখনো ভাবিনি যে, এরা এত রাত জেগে কী করে? কোন মনি-মুক্তো সিঞ্চন করে? ঘুণাক্ষরেও ভেবে দেখিনি কি তাদের মানসিক, আর্থিক, সামাজিক ও ধর্মীয় চাহিদা? এক বারের জন্যও ভাবিনি কিসে তাদের মঙ্গল নিহিত? অভিভাবক হিসেবে, কর্ণধার হিসেবে, আমানতদার হিসেবে একবারের জন্যও ধ্যান-জ্ঞান স্থির করে এদেরকে নিয়ে ভাবিনি এদের ভবিষ্যৎ পথ কী হবে, কারা করবে, কেমন ধারায় করবে? অথচ অর্থকেই সব সফলতার মূল হিসেবে পুনঃপুনঃ প্রচার করে গেছি। আর বেয়াদব, উৎশৃঙ্খল, অপরিণামদর্শী, ব্যাক্তিকেন্দ্রিক, দেশপ্রেম বিবর্জিত যান্ত্রিক রোবট হিসেবেই এদেরকে ধরে নিয়েছি। আমাদের ভুল যে কত বড় ভুল ছিলো তা আমাদের বোধের মধ্যেই আসেনি কখনো। ভেবে দেখার সময়ও হয়নি বিত্তবাসনার এস্কেলেটরে দৌড়াতে দৌড়াতে।

আজ আমরা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। আমাদের সব জারিজুরি আজ সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান। প্যান্ডোরা বক্স থেকে আমাদের সব কিছু পটাপট বেরিয়ে আসছে। আমাদের সাধ্য নেই এর ঝাঁপি বন্ধ করি। আমাদের ক্ষমতার সার্কিট শটসার্কিট হয়ে যাওয়ায় কোথাও কোন আলো নেই। চারিদিকে অন্ধকার। মুখোমুখি বসবার মত কেউ নেই একান্ত আপনার। আছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়, নিস্ফল বিলাপ আর শুধুই অন্ধকার।

যে প্রজন্মকে মোবাইল টেপা অথর্ব, বাবার হোটেলের পারমানেন্ট বোর্ডার হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের দুধ-ভাতের জন্য কামাই রোজগারের ধান্ধায় এত প্রাণাতিপাত করেছি সে প্রজন্ম তাতে মোটেই তুষ্ট না। তাদের ভেতরে তারা কখন যে এক একটি ডিনামাইট পেলেপুষে বড় করেছে তা বুঝতেই পারিনি। তারা যে ঘুরে ফিরে গোপনে গোপনে আবার সেই পুরোনো হাভাতে মনীষীদের কথাতেই শান দিয়েছে তা আঁচ করার শক্তিও আমাদের ছিলো না। আমরা তাদের হাতে বেশুমার অর্থ আর সুখ ভোগের উপকরণ তুলে দিয়েই নিশ্চিন্তে বসে রয়েছি। কখনো ভাবতেই পারিনি এরাই একদিন আমাদের হন্তারক, বিচারক, পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম জেগেছে স্ফুলিংগের মত। এদেরকে নির্বাপণের তরিকা আমাদের জানা নেই। কবে যে এরা চুপিসারে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছে সুস্থতায়, শুভ্রতায়, নতুন চিন্তায়, পরিবর্তনের আকাংক্ষায় ভাবতেই পারিনি। এরা হ্যামিলিয়নের বংশীবাদকের মোহন বাঁশীর সুরের অপেক্ষা করেনি। কেউ তাদের মাথার উপরে নেই। তারা সবাই মিলে সুনীল আকাশ। তাদের সাথে রয়েছে নির্মল অক্সিজেন, স্বেত শুভ্র মেঘপুঞ্জ, অবারিত নীলাকাশ আর দিগন্তবিস্তৃত জমিন। তাই তারা রাস্তায় নামে, বাধা বিঘœ বুক চিতিয়ে মোকাবিলা করে, প্রাণ দেয়, গান গায়, গ্রাফিতি আঁকে, শৃংখলা কাকে বলে, কত প্রকার আর কিরূপ তা বুড়ো হাবড়াদেরকে শেখায়। তারা স্বার্থহীন প্রতিবাদ করে দেখিয়ে দেয় রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে দগদগে গভীর ক্ষত, এর চিকিৎসা অত্যাবশ্যক। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি এরাই কি আমাদের সেই রাতজাগা ভুলভাল পথে হাঁটা, বখে যাওয়া, দেশান্তরে পাগল, স্বার্থপর, পাশ্চাত্য প্রিয়, বেয়াদব, আদুরে ছেলে মেয়ে? এরা কি তবে নতুন কোন যাদুবলে নবরূপে জন্ম নিলো, নতুন মন্ত্রে হঠাৎই দীক্ষিত হলো? আফসোস আমরা জানতেও পারিনি, অনুমানও করতে পারিনি। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা আমাদের বোধের ঘরে তালা মেরে দিয়েছিলো, আমাদের চোখে টমটমের ঘোড়ার মত একমুখী পথরেখা এঁকে দিয়েছিলো।

আমাদের নতুন এই তরুণের কখন কিভাবে উন্মেষ ঘটেছে আমরা জানিনা। তারা জেড-জি প্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত। আর আমরা ‘বুমার’। প্রকৃতপক্ষে আমরা ‘বুমার’ না, আমরা হলাম ‘ডিমার’। আমরা সব কিছুকে আড়াল করে রাখি। অস্বচ্ছ করে রাখি, সব পথ বন্ধ রেখে অন্যদেরকে নিজেদের পথে হাঁটতে বাধ্য করি। আমরা চেতনার রেকর্ড বাজিয়ে অভ্যস্ত, উন্নয়নের ধ্বনি আওড়াতে আওড়াতে মুখে ফেনা দলা পাকিয়ে তুলেছি। আমরা সব কিছুুতেই আমাদেরকে ব্র্যাকেট বন্দী করে ভাগাভাগি করতে ধাতস্থ হয়ে গেছি। বিপরীত কথা, বিকল্প দর্শন, পছন্দ-অপছন্দের রকমফের কোন কিছুই আমাদের ভালো লাগেনা। ধর্ম আমাদের কাছে এলার্জি স্বরূপ, সেকেলে, পশ্চাৎপদতার হাতিয়ার। নীতি-নৈতিকতার কথা শুনলে আমাদের রক্তে গরম জ্বালা অনুভূত হয়। আমরা যাকে ইচ্ছে তাকে সম্মান দেই, ক্রেণ দিয়ে আকাশে তুলি। আবার যাকে ইচ্ছে তাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করি, নিষ্পেষিত করি, নিশ্চিহ্ন করে দিতেও দ্বিধা করিনা। তারুণ্যের দ্রোহ আমাদের কাছে অকল্পনীয় ধৃষ্টতার শামিল। আমরা তাই ডিমার, বুমার না।

আসুন নতুন প্রত্যয় ও প্রত্যাশা নিয়ে সবাই উজ্জীবিত হই সৃজনের সুকুমার বৃত্তিতে। বড়ত্বের বড়াই মনন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে, এতকালের আত্মস্থ করা বদ খাসলত, যাবতীয় ফন্দি ফিকির ছেড়ে খোলা মন নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তাদেরকে উপযুক্ত পরামর্শ প্রদান করি। আমাদের ব্যর্থতার জন্য নি:শর্ত ক্ষমা চাই। আমাদের বোধ থেকে প্রোথিত সব আবর্জনা ডিলিট করে দেই। দেশ আগে, জাতি আগে। সবার স্বার্থ সর্বাগ্রে – এই হোক আমাদের মূলমন্ত্র। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আনোয়ার হাকিম আমাদের বোধের সীমাবদ্ধতা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর