Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুণী শিক্ষার্থিদের মুখে গুণী শিক্ষকের মূল্যায়ন

বিপ্লব বড়ুয়া
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৫

মানুষ মাত্রেই কোন না কোন গুণের অধিকারী। গুণের রয়েছে নানান শ্রেণি বিন্যাস। গুণবান মানুষ ব্যতীত সমাজ-দেশ কখনো উন্নত হতে পারে না। আজকে এমন একজন মানুষের কথা বলতে চাই, যে নাকি দারিদ্রতাকে জয় করেই মহান শিক্ষকতা পেশায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। শিক্ষকতাকে মহানব্রত হিসেবে নিয়ে শত শত ছাত্রকে নিজের সন্তানস্নেহে শিক্ষাদান করেছেন। বিনিময়ে লাভ করেছেন অভাবনীয় আত্মসম্মান আত্মমর্যাদা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর ক্লাসমেট যার সাথে চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসিতে শিক্ষাজীবন কাটিয়েছিলেন, তিনি হলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বিমল কান্তি বড়ুয়া। ১৯৫৭ সালে এইচএসসিতে তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে মেধাকোটায় সরকারের বৃত্তি লাভ করেন মাত্র দুইজন ছাত্র। তার মধ্যে একজন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যজন শিক্ষক বিমল কান্তি বড়ুয়া। প্রফেসর ইউনূসের মাসিক বৃত্তির পরিমাণ ছিল ৩০ টাকা আর বিমল কান্তি বড়ুয়ার বৃত্তির পরিমাণ ২০ টাকা। তা ছাড়া এই দুইজন অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে সম্পূর্ণ ফ্রিতে পড়ার সুযোগ লাভ করেন। এইচএসসি সম্পন্ন করার পর তাদের দু’জনের মধ্যে আর তেমন একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। বিমল কান্তি বড়ুয়া শিক্ষকতার প্রায় অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। পরবর্তিতে অবসরে যাওয়ার পূর্বমূহুর্তে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন খাগড়াছড়ি সরকারি স্কুলে। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ সালে লাভ করেন দেশসেরা শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের জাতীয় পুরস্কার।

সম্প্রতি বিমল কান্তি বড়ুয়া’র সংস্পর্শে গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থিদের মধ্যে বর্তমান যে টানাপোড়ন চলছে তখনকার সময়ের স্মৃতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। শিক্ষক বিমল কান্তি বড়ুয়া বলেন, “শিক্ষকের দুটি মাত্র চোখ নয়। তারা অন্তরে অজ¯্র চোখ দিয়ে দেখেন। তেমনি ছাত্র এবং অভিভাবকদেরও চোখ অনেক। তারাই প্রকৃত বিচারক। তারাই জানেন প্রকৃত শিক্ষক কে।” বার্ধক্যের সাথে এই প্রবীন শিক্ষকের জীবনযুদ্ধ চলমান থাকলেও এখনো অসংখ্য ছাত্রের নাম অনর্গল বলতে পারেন। অনেক ছাত্র এখনো স্যারের খোঁজখবর রাখেন সময়সুযোগে সেই প্রিয় স্যার থেকে দোয়া নিতে বাসায় ছুটে যান। এই গুণী শিক্ষকের অসংখ্য গুণী ছাত্র বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানে নিয়োজিত আছেন। তাদের মধ্যে থেকে প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে কয়েক শিক্ষার্থির স্মৃতিচারণ পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরলাম। ঢাকার জেলা দায়রাজজ বিচারক (অবঃ), তথ্য কমিনার শহীদুল আলম ঝিনুক মাসখানেক পূর্বে স্যারের বাসায় এসে দেখা করেন এবং দোয়া নিয়ে যান। এসময় তিনি তার ব্যারিষ্টার ছেলেকেও তার প্রিয় স্যারকে দর্শন করাতে ঢাকা থেকে নিয়ে আসেন। জীবনে এতটুকুন আসার পেছনে স্যারের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করেন। বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কথা সাহিত্যিক দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেন- স্যার সত্যিকার অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ, শিক্ষক বলতে যে সৌম্য ভাবমূর্তিটি আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে সে রকম একজন মানুষ বড়ুয়া স্যার। কলেজিয়েট স্কুলের মতো সর্বার্থে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক আমাদের পাড়ায় থাকেন, এটা ছিল পুরো এলাকাবাসীর গর্ব। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর বিমল স্যার প্রাতঃশাখার ক্লাসে ছাত্রদের আমার পরীক্ষার পুরো খাতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন, যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন এবং সবাইকে এরকম করে লেখার চেষ্টা করতে বলেছেন। কম বয়সে ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও অনেক বড় হয়ে ওঠে। এরপর বন্ধুরা আনন্দে-উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরেছিল। এভাবে বিমল স্যার একদিন আমার মতো ব্যাক-বেঞ্চারকে সম্মুখ সারিতে টেনে এনেছিলেন। এই ক্ষুদ্র, কিন্তু আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আজ যখন সামান্য সাহিত্যচর্চা করি, পাঠকের কিঞ্চিৎ ভালোবাসা পাই, এমনকি বাংলা একাডেমির পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করি, তখনও বিমল স্যারের সেই স্বীকৃতির কথা ভুলতে পারি না।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক, কবি ডা. হাফিজুল ইসলাম বলেন- আমার শিক্ষাজীবনে বড়ুয়া স্যার ছিলেন একজন ফেভারিট টিচার। যার কোনো তুলনা চলে না। স্যার চলনে, বলনে, কথনে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান মানুষ। তিনি অনেক বড়মাপের মানুষ যারা স্যারের সান্নিধ্যে যায়নি তারা এ বিষয়টি কখনো অনুধাবন করতে পারবে না। স্যারের মধ্যে সবসময় ছিল সৃষ্টিশীলতা। নতুন কিছু জানার, নতুন কিছু শেখার এবং ছাত্রদের গড়ে তোলার। স্যারের মেমোরি খুব সার্প। স্যারের বড়গুণ বয়সের নয় দশকে এসেও অসংখ্য ছাত্রদের নাম মনে রাখা। তিনি আমার কাছে এখনো উজ্জ্বল্য, দেদীপ্যমান। দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সম্পাদক রুশো মাহমুদ সময় পেলেই স্যারের শারীরিক খোঁজখবর নিতে ছুটে যান তিনি বলেন- শ্রেণি কক্ষে পাঠদানই একজন শিক্ষকের একমাত্র কাজ না, এর বাইরেও ছাত্রের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হয়। তার বড় দৃষ্টান্ত বিমল বড়ুয়া স্যার। শিক্ষাদান একটি জটিল ও কঠিন কাজ। একজন শিক্ষক জীবন্ত উপাদান নিয়ে কাজ করেন বলেই শিক্ষকতা অতি উচ্চ পর্যায়ের শিল্প। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থির বন্ধু, নির্দেশক ও জীবনাদর্শের বাস্তব প্রতীক। আমাদের অনেকেরই শৈশবে এমন একজন আদর্শ শিক্ষকের ছায়া-মায়ায় পল্লবিত হয়েছিল। বড়ুয়া স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি আর পেয়েছি আশীর্বাদ। ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান চিকিৎসক, নিউরো সার্জন অধ্যাপক ডা. ধীমান চৌধুরী বলেন- বড়ুয়া স্যারের কথা ওঠলেই আমার চোখের সামনে সেই এক দীর্ঘ ইতিহাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কথা ভেসে ওঠে। জীবনের পরতে পরতে স্যার যেন আমার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। আমার কাছে স্যারের গল্প কখনো ফুরোবার নয়। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে স্যারের কাছে প্রথম দিন যখন বাংলা ক্লাস করি সে এক অদ্ভুত মোহে পড়ে গিয়েছিলাম। বড়ুয়া স্যার লাইনের পর লাইন রবীন্দ্র রচনা, কোটেশন কীভাবে দিতে হয়, বাংলা যে একটা মজার জিনিস স্যারের কাছ থেকেই প্রথম জানলাম ও শিখলাম। চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি প্রচুর বাংলা সাহিত্য পড়েছি এর রসটা তৈরী করে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় বড়ুয়া স্যার।

বিশিষ্ট কার্ডিওলোজিষ্ট অধ্যাপক ডা. শেখ হাছান মামুন বলেন- একজন শিক্ষক কতটুকু হলে অনায়সে মাথা নুয়ে যায় ছাত্রের; পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নেয়ার পরম ইচ্ছা জাগে মনে প্রাণে। তেমনি একজন আদর্শবান শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম ১৯৮৩/১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন বড়ুয়া স্যারকে। শ্রেণি কক্ষে স্যারকে দেখতাম কর্ম্যদ্যেম ও প্রাণময়তা পরিমিতবোধ সম্পন্ন একজন শিক্ষক অনেক ছাত্রের সামনে পিনপতন নীরবতায় সহজ, সাবলীল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ্য বইয়ের প্রতিটি বিষয় শান্ত মেজাজে পাঠদান করতেন। স্যারের উদ্দীপনা সঞ্চারকারী পাঠে বাংলা ভাষার গদ্যাংশ-পদ্যাংশ এবং ব্যাকারণের জটিল অংশ বুঝতে আমার এতটুকু বেগ পেতে হতো না। পাঠদানের পর যখন প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতো আমি সহজে উত্তর দিতে পারায় তার স্নেহধন্য ও প্রিয় ছাত্রে রূপান্তরিত হলাম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. সৌমেন সরকার বলেন, সমুদ্রের কথা কি সংক্ষেপে বলা যায়! স্যার হচ্ছেন একটা সমুদ্রের মতো। বাংলার সমুদ্র ছিলেন আমাদের বড়ুয়া স্যার। স্যারের কাছেই প্রথম কোনো কবিতা শিখি। শিখি বলা ভুল হবে উপলব্ধি করি। স্যারের ছিল নিজস্ব কবিতার সংজ্ঞা। স্যার চাইলে তখন কোচিং সেন্টার খুলে অনেক ছাত্র পড়াতে পারতেন। কিন্তু উনি তা করেননি। মঞ্চ অভিনেত্রী কবি আবৃত্তিশিল্পী একাত্তর টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা ফারজানা করিম প্রিয় স্যারকে নিয়ে অনুভূতি ছিল অন্যরকম। আমি ভাবতে পারছিলাম না, এতবড় এই বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীকে একদিন দেখি আমাদের বাসায় হাজির। ড্রইংরুমে বসে গল্প করছেন আব্বার সাথে। আমি দেখে স্তম্বিত হয়ে গেলোম। খুশিতে আর্তনাদ, লাফিয়ে উঠলাম। সময় পেলেই স্যারকে দেখতে ছুটে যাই। স্যার এখন আর আগের মতো হাঁটতে পারেন না, বার্ধক্য ঘিরে ধরেছে। কানেও তেমন একটা শুনতে পান না। এই বার্ধক্যের বেলায়ও স্যারের মনে প্রচন্ড সাহস, প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। আদর্শবান মানুষ কখনো ভেঙে পড়েন না, স্যারকে দেখেই বুঝা যায়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএনসিডিএফ’এর প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট, কান্ট্রি ফোকাল পয়েন্ট জেসমুল হাসান বলেন- অল্প কয়েকজন শিক্ষক আজকে আমার এই আমিকে গড়ে তুলেছেন, তার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক বড়ুয়া স্যার। মাত্র দুই বছরেই জীবনের ভীত গড়ে দিয়েছেন। অসাধারণ মমতায়, কোমল নম্র ব্যবহার দিয়ে পড়াতেন আমাদের। স্যারের কথা এখনো আমি প্রতিনিয়ত স্মরণ করি এবং শারীরিক খোঁজখবর নিই। বিশিষ্ট শিল্পদ্যোক্তা সেলিম বিন সালেহ বলেন- শান্ত সৌম্য দর্শন, জলদ-গম্ভীর ভরাট কন্ঠ, জোস্নালোকিত হ্রদের জলের মতো ধীর স্থির তার চলন। স্যার আমি এবং আরো অনেকের কাছে দেবতাতুল্য। স্যারের শারীরিক সুস্থতা কামনা করছি। আসুন, আমরা স্যারদের শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

গুণী শিক্ষার্থিদের মুখে গুণী শিক্ষকের মূল্যায়ন বিপ্লব বড়ুয়া মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর