Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অনিশ্চিত অমানিশার ঘোরে আওয়ামী লীগ

বিপ্লব বড়ুয়া
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৫০

বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী লীগ’। এই দলের রয়েছে লক্ষ লক্ষ সমর্থক-নেতাকর্মি। একটানা দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও একটি বিশাল দলের আকাশসম ধস নামতে পারে কেউ গুণাক্ষরে টের পেলো না, এই কথা কী ভাবা যায়! যে সংগঠনটির কর্মকা- বাংলাদেশের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রক্তের সাথে মিশে গিয়েছিল সে রকম একটি সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে ধাক্কামেরে ফেলে দেবে এই কথা কখনো কেউ কী ভেবেছিল? ব্যাপারটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবে তাই ঘটেছিল। তাহলে কী আওয়ামী লীগকে এই অবস্থায় ফেলতে ভিতরে-বাহিরে দীর্ঘ কোনো ষড়যন্ত্র হয়েছিল? সত্যি সত্যিই কী আওয়ামী লীগ এত নড়বড়ে, এত ঠুনকোতে পরিণত হলো! দীর্ঘবছর ক্ষমতার মসনদে থেকে নিজেরাই নিজেদের কী ধ্বংস ডেকে আনলো? এতবড় একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত দলকে নিয়ে তলে তলে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে নীতিনীর্ধারকরা কী কোনো খবর পেল না? আওয়ামী লীগকে এভাবে নাস্তানাবুদ হতে হবে শীর্ষ নেতৃত্বরা একটুও কী আঁচ করতে পারলো না? এখন কী হবে আওয়ামী লীগের ! এর পরিণাম কী; আবার কী ঘুরে দাঁড়াতে পারবে আওয়ামী লীগ? হাটে-ঘাটে, পথে-মাঠে এনিয়ে জনগণের এখন বিস্তর জল্পনা ! শেখ হাসিনার সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যক্তি পর্যায় থেকে সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্টানে ছিল দুর্নীতির মহোৎসব। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্টানগুলোতে সেবার নামে সেবাপ্রত্যাশীদের পকেট কেটেছে, প্রতারিত হয়েছে পদে পদে। রাজনৈতিক দলের ছোট নেতা থেকে বড় নেতা সবাই ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের সীমাহীন দম্ভ ও অহংকারের কারণে মানুষ ছিল তটস্থ, অসহায়। তাই আজ আওয়ামী লীগের বাঁচামরা অবস্থা!

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন আওয়ামী লীগের নাম কেউ মুখেও নিতে পারেনি সেই একই পরিস্থিতির দেখা মিলছে ২০২৪ সালের আরেক ঠিক ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে। আমার ছোট্টজ্ঞানে যতটুকু বুঝি তৎসময়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট ক’জনের কারণে বঙ্গবন্ধুর মতো এতবড় নেতার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল; ঠিক একই কায়দায় শেখ হাসিনাকেও ধ্বংস করার টার্গেটে নেমেছিল কী না তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ততদিনের জন্য। ফিরে দেখা যাক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বগণের বক্তব্যে- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ জুন ২০২৪- এ ঢাকায় এক জনসভায় বলেছিলেন- ‘আওয়ামী লীগ কচুপাতার শিশির বিন্দু নয় যে টোকা দিলে পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগের শিকড় এ দেশের মাটির অনেক গভীরে।’ একটু ধাক্কা লাগলে সরে যাওয়ার পাত্র নয় আওয়ামী লীগ। সদ্য পদত্যাগকারী দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ এর ১১ জানুয়ারি এক ভাষণে বলেছিলেন- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা দেয়া সহজ নয়। আওয়ামী লীগকে কেউ ধাক্কা দিল আর আওয়ামী লীগ পড়ে গেল, বিষয়টি এত সহজ নয়। একই দিনে ঢাকায় অপর আরেকটি সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার দল নয়, বরং যে ধাক্কা দেয় সেই পড়ে যায়। দয়া করে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করবেন না। এই বক্তব্যগুলোর কোনোরকম তাৎপর্য আছে কী না পাঠক হিসেবে আশাকরি আপনারা মিলিয়ে নেবেন।

বিজ্ঞাপন

অন্তর্বর্তি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে ৮ আগষ্ট অন্তর্বর্তি সরকারের উপদেষ্টাগণের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিদের ওপর নেমে আসতে থাকে একের পর এক খড়গের অস্ত্র। নবগঠিত সরকারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একদল দুর্বৃত্ত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের দেশব্যাপী হাজার হাজার কার্যালয় আগুনে পুড়ে ধ্বংস করে দেয়। মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মিদের গ্রেফতারের তালিকা লম্বা হচ্ছে। তাঁদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে দলের ডাকসাইটের নেতারা। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে গোপালগঞ্জ ব্যাতীত দেশের আর কোথাও শোকদিবস পালন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মিরা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন যারা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়েছিল তাদের কেউ গা বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পারেনি। ছাত্র-জনতা তাদেরকে বেদম প্রহার করেছে। সেখান থেকে অনেককে ফিরতে হয়েছে দিগম্বর হয়ে। ৬০/৭০ বয়সী মানুষদের ওপর এমন গর্হিত আচরণ দেখে বাংলার মানুষ লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়েছে। দেশব্যাপী তান্ডবে বাঙালির ইতিহাসের সাথে যার রয়েছে অনন্য অবদান সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ম্যুরাল ভাস্কর্য ভেঙ্গেচুড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংসের ছোবল থেকে বাদ পড়েনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষমূর্তি, ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাস মূর্তি, সুপ্রীম কোর্টের থেমিস, শিশু একাডেমির দুরন্ত ভাস্কর্য, রিলিফ ভাস্কর্যসহ সারাদেশে দেড় হাজার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ডিজিটাল ডেস্ক: ২০ আগষ্ট ২০২৪।

যে কথা বলা প্রয়োজন, চাকরি ও অন্যান্যক্ষেত্রে কোটাপ্রথা নিয়ে দেশের সর্বক্ষেত্রে যে চরম বৈষম্য দেখা দিয়েছিল তার একটি যোক্তিক সমাধানের জন্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনটি ছিল অত্যন্ত যুক্তিসম্পন্ন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন নিয়ে প্রথমদিকে একটুও মাথা ঘামাতে চাননি। চীন সফরের ওপর প্রেস কনফারেন্স করতে গিয়ে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা কোটা নিয়ে এক সাংবাদিকের জবাবে যখন বললেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে? এরপর আরেকধাপ বাড়িয়ে ১৫ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের ফুলকিতে ‘ঘি’ ঢেলে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলার পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় ব্যাপক সহিংসতা। শেষ পর্যায়ে আন্দোলন এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকে তার থেকে ফিরে আসা কোনোভাবে সম্ভব ছিল না। আন্দোলনটি বাঁধভাঙা গণঅভ্যূত্থানে মোড় নেয়। তাদের সাথে যোগদেন অভিভাবক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ। অবশ্য দেরীতে হলেও শেখ হাসিনা ছাত্রদের কোটাসহ সবক’টি প্রধান শর্তগুলি মেনে নিয়েছেলেন। ছাত্ররা যখন পুনরায় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের একদফা দাবিতে ফিরে গেলে অনেকটা বাধ্য হয়ে ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। এরপর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে আশ্রয় নেন পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। তিনি দেশ ছাড়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিদের মধ্যে দুর্দশা নেমে আসে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী, কারো জানা নেই। ভবিষৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে নিয়েও অনিশ্চিয়তা কাটছে না। এনিয়ে অনেকের প্রশ্ন আদৌ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে না তো আওয়ামী লীগ? জুলাইয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার দাবি তুলে গত ১৯ আগষ্ট মানবাধিকার সংগঠন সারডা সোসাইটির পক্ষে এক আইনজীবি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন। রীটের আবেদনে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার দায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিল এবং বিদেশে পাচারকৃত ১১ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনার নির্দেশনা চাওয়া হয়। এছাড়া গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মিকে অভিযুক্ত করে প্রতিদিন দেশব্যাপী অসংখ্য মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মিদের বিরুদ্ধে গণমামলা দায়ের সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিষ্টার সারা হোসেন বলেন, এই মামলাগুলো টিকবে না এবং প্রথম ধাপ পার হতে পারবে না। মামলার এজাহার ক্ষোভ ঝাড়ার জায়গা নয়। ছাত্র আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে মামলাগুলো। (সূত্র: গণমাধ্যমে প্রকাশিত, ২৪ আগষ্ট ২০২৪)। এ পরিস্থিতিতে এক কথায় বলা যায়, আওয়ামী লীগ এখন বড় বেকায়দায়, কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন। দেশের প্রাচীন দল হয়েও আওয়ামী লীগের এই পরিণতি কেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকলকে একযোগে হত্যা করা হলে তখন আওয়ামী লীগ এরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে বিদেশ থেকে দেশে এসে হাল ধরলে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগ কী পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারবে? নাকি পরিবারের মধ্যেই নেতৃত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলার সর্বত্র এনিয়ে এখন বেশ সরগরম!

আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯৯ সালের দিকে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও তিনি এখনো অন্তর থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছতে পারেননি। তাই গত ৭ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে আগুনের ধ্বংসস্তুপ দেখে নীরবে কেঁদেছিলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। আমি ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা কোনোমতেই এক কথা নয়। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক; আজ ৩২ নম্বর বাড়ি যেভাবে জ্বলতে পুড়তে, ধ্বংস হতে দেখলাম, তার আগেই আমার মৃত্যু হলে অনেক ভালো হতো।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাবস্থায় অন্যায় করেছে ঠিক, কিন্তু শেখ মুজিব তো কিছু করেননি। তিনি বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেছেন। সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা, ৭ আগষ্ট ২০২৪।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তারি সংগঠনের বিশ্বস্থ কিছু সহচর তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খন্দকার মোশতাক। খন্দকার মোশতাকতো বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাকে তিনি সব সময় সাথে রাখতেন। একাত্তরে মুজিবনগর সরকার গঠনকালে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায়ও মোশতাক মন্ত্রীত্ব পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মোশতাকের ব্যাপারে বলেছিলেন, তার মাথায় ‘অনেক প্যাঁচ ও শয়তানি’ তাকে বঙ্গবন্ধু ‘বগলের তলায় রাখতেন, যাতে শয়তানি করতে না পারে’। বঙ্গবন্ধু মোশতাকের ‘কূটবুদ্ধির’ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা যখন মারা যান সেদিন মন্ত্রী পরিষদের কেবিনেট মিটিং ছিল। বঙ্গবন্ধু কাউকে না যাওয়ার জন্য বললেও সেখানে মোশতাক গিয়ে লাশ কবরে না দেয়া পর্যন্ত গড়াগড়ি করে কান্না করছিলেন। সেকথা বঙ্গবন্ধু নিজের মুখে বলেছিলেন (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির (সিপিবি), সুত্র: বিডিনিউজ ২৪.কম, ১৭ আগষ্ট ২০২৩ইং)। যদি বলি ২০২৪ এর শেখ হাসিনাকে ডুবানোর ব্যাপারে তারই দলে নব্য মোশতাকের আবির্ভাব ঘটেছিল? এই দুষ্টুবুদ্ধির লোকেরা শুধু আওয়ামী লীগকে ডুবিয়ে দেননি, বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বি খ্যাতিকেও তারা ধ্বংস করে দিয়েছেন। চেয়ারে বসে শুধু ওপরের দিকে তাকালে হয় না, নীচের দিকেও তাকাতে হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বরা মনে করেছিলেন, ‘পুরো আকাশটাই তাদের দখলে কিন্তু আকাশ থেকেও যে তারা খসে পড়তে পারে তারা সেটি ভাবেনি।’ ক্ষমতার মসনদে তারা এতবেশি মশগুল ছিলেন যে, কারো কথার সামান্যতমও তোয়াক্কা করেননি। শুধু সুশীল আর সুশীলদেরকে কথায় কথায় চেং দোলাই করতেন। আমি যার কাছে সাংবাদিকতার অল্পবিস্তর যা শিখেছি তার নাম হলো মোস্তফা কামাল পাশা। তিনি সারজীবনটাই সাংবাদিকতার মধ্যে দিয়ে জীবন শেষ করেছেন। ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন। আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন তাঁর সংস্পর্শে যাই তখন থেকে বুঝতে শুরু করলাম মানুষটার ভিতরে বারুদের তীব্রতা কী পরিমাণ! যাক সে কথা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। ছিলেন আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ী। নেতিবাচক কিছু দেখলেই জোর সমালোচনা করতেন। সেকারণে তিনি আওয়ামী রাজনীতিকদের চোক্ষুশুলে পরিণত হয়েছিল। তিনি কটাক্ষভাবে ওবায়দুল কাদেরকে লিখতেন ‘ও কাদের’ সম্বোধন করে। তিনি এমনভাবে লিখতেন রীতিমতো হাসির বন্যা বয়ে যেতো। অথচ বিষয়গুলোকে তিনি তুলে ধরতেন বাস্তবতার নিরিখে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কারো কানে শ্রদ্ধেয় মোস্তফা কামাল পাশার তীব্র যন্ত্রণায় উৎসারিত কথাগুলো স্পর্শ করতো কিনা জানা নেই, তবে একথা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি যে হাজার হাজার সাধারণ পাঠক তাঁর এই লেখাগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। আজকে আওয়ামী লীগের পড়ন্ত বেলার এ দৃশ্য তিনি যদি স্বচোখে দেখতেন তাহলে যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর খুব প্রিয়ভাজন মানুষ ছিলেন সাংবাদিক মোস্তফা কামাল পাশা। একটানা দীর্ঘবছর সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় পরে ইষ্টার্ণ প্রেস অব বাংলাদেশে (ইপিবি) নামের বার্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যুর পুর্বমুহুর্ত পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি সংগঠন ও সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেও কখনো বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা-আওয়ামী লীগের অনুসারী থেকে নিজেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করেননি, বরঞ্চ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিদের কাছে তিনি উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে সাংবাদিকতার মূল অন্ধরে প্রবেশ করেছিলাম। তাঁর সাথে পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই আমি সংবাদপত্রে কাজ করি; তবে তার সাথে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে সক্ষম হই, এই জগতটা কত সুদূুরপ্রসারী, কত বিস্তৃতি। তাঁর ব্যতিক্রমী শব্দচাষ আমার মতো অনেককে প্রেরণা যুগিয়েছে।

আজকে সত্যকথা বলার লোক সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী নেই। এই আওয়ামী লীগকে শোধরানোর পথ বাতলিয়ে দেবে কে? সত্য কথা বলবে কে? এই সংকটকালে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান স্যারের কথা বেশ মনে পড়ছে। যাঁকে শেখ হাসিনা পিতৃতুল্য মর্যাদা দিতেন। তাঁর উপদেশ পরামর্শ গ্রহণ করতেন, মেনে চলতেন। তিনিও ইহাকাল ছেড়ে চলেগেছেন। প্রফেসর ড. অনুপম সেন স্যার এখনো বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন, তাকে এখন অন্যের ওপর ভর করে চলাফেরা করতে হয়। আগের মতো আর লিখতে পারেন না। যাকে বাংলাদেশের মানুষ জ্ঞানের ভান্ডার বলে শ্রদ্ধা সম্মান করেন তিনি আজ আওয়ামী লীগের লেজেগোবরে পরিস্থিতি দেখে বাকরুদ্ধ! আওয়ামী লীগকে তিনি কী পরামর্শ দেবেন জানিনা-। যে সব গুণীজন এখনো সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক কথামালা তুলে ধরে অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছেন- প্রফেসর এমিরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা), সাবেক সচিব মো: তৌহিদ হোসেন (অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা), কথাসাহিত্যিক প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ড. বিরুপাক্ষ পাল, কলামিষ্ট মহিউদ্দীন আহমদ, সাংবাদিক কামাল আহমেদ, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, লেখক সুলতানা কামাল, ইত্যাদীর হানিফ সংকেত, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, প্রফেসর মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, সাংবাদিক-বীরমুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী, প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, গবেষক জামাল উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক সামশুল হক, কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, সাংবাদিক রাশেদ রউফ এর মতো বিশিষ্টজনরা বর্তমান সময়ের বাস্তবতার নিগূঢ় চিত্র তুলে ধরতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

এই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন নিঃসঙ্গ, পুড়ে ছারখার ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সেদিন এক সাংবাদিক বন্ধু ফোনে জানালেন পোড়ার খটখটে গন্ধ শুকে ৩২ নম্বর বাড়ি পাড় করতে হচ্ছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এ অবস্থা দেখে তার মনে কষ্ট লাগছে। পোড়া ক্ষতের দগ্ধ চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতিমাখা বাড়িটি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর)। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন আগুনের পোড়া দগ্ধ গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কিলবিল করে! যেন বাঙালির হৃদয় আগুনের দগ্ধ শিখায় জ্বলছে অনবরত! বঙ্গবন্ধুর ভক্তহৃদয়ে এ আগুন কখন নিভবে কেউ জানে না। কিছুদিন আগেও যে বাড়িটি ছিল হাজার হাজার দর্শনার্থিদের ভীরে পরিপূর্ণ, সেই বাড়িটি এখন আলোহীন, নীরব, সিঃসঙ্গ।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট

অনিশ্চিত অমানিশার ঘোরে আওয়ামী লীগ বিপ্লব বড়ুয়া মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর