বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের শিক্ষক নিয়োগ: নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:২৭
১.
হেডলাইন দেখেই পাঠক বুঝে যাবেন এই লেখা কোন দিকে গড়াতে যাচ্ছে। মূল আলোচনায় শুরুর আগে পাঠকদের দু-একটা ঘটনার বর্ণণা না দিলে আসলে পাঠকরা এই লেখার গুরুত্ব পুরোপুরি উপলব্দি করতে পারবেন না। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক নেতা গোছের মানুষকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হলো তদবিরের মাধ্যমে এবং তা অনেক যোগ্যপ্রার্থীদের উপেক্ষা করে। তার পরের দশ বছরের চিত্রটা এবার বলি। সেই শিক্ষক নিজে তার ছাত্রজীবনে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মিছিল মিটিং করেছেন, চার বছরের কোর্স শেষ করতে তিনি নিলেন অতিরিক্ত সময়, ফলাফলও হলো নিম্নমানের। ফলে যে জ্ঞান তার অর্জন করার কথা ছিলো সেটা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। অনেকটা ছোটবাচ্চাদের যেমন পুষ্টিকর খাবার ঠিকঠাক না দেয়া হলে বড়বেলায় তার দেহগঠন বা বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু সমস্যা থেকে যায় তেমন এই শিক্ষকদের বেলায়ও এমনটা হয়। তিনি ক্লাসে ভালো পড়াতে ব্যর্থ হন। অনেকটা ভুলিয়ে ভালিয়ে পুরো সেমিস্টার শেষ করেন। এতে করে ওই ছাত্রছাত্রীরা শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হন তা না, সেটা পুরো দেশের উপরই প্রভাব পড়ে। ওই শিক্ষক শুধু যে ক্লাসে পড়াতে ব্যর্থ হন তা না, সাথে তার আন্ডারে যারা থিসিস বা ডিজার্টেশন করেন তাদের গবেষণায় প্রভাব পড়ে। শিক্ষার্থীরা ভালোকিছু শিখতে পারেন না। এভাবে ওই একজন শিক্ষক যদি প্রতিবছর এমন পাঁচজন শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার হন, তাহলে দশ বছরে পঞ্চাশজন শিক্ষার্থীকে তিনি বিনা পড়িয়ে, ফাঁকি দিয়ে দেশের চাকরি্র বাজারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ওই গ্রাজুয়েটরা দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে গড়ে উঠতে পারছেন না। সমাজের বোঝা হচ্ছেন এবং বেকারত্বের চাপ বৃদ্ধি করছেন। এই সামাজিক সমস্যাটা কিন্তু শুরু হলো ওই অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের মধ্য দিয়ে। এমন শুধু একজন দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি গত পনেরো বছরে। এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাহলে পাঠক এবার হিসেব করতে পারেন এমন শিক্ষক কত শিক্ষার্থীদের জীবন ধ্বংস করেছেন এবং করছেন।
২.
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কোটা আন্দোলনে যখন শতশত শিক্ষার্থীকে পুলিশ এবং সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি করছিলেন তখন এর প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষক প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেননি পর্যন্ত। যেন দেখে না দেখার ভান করে রয়েছেন। অথচ শিক্ষক, ছাত্রের জন্য এবং ছাত্র, শিক্ষকের জন্য। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র থাকলে শিক্ষক থাকবে এবং শিক্ষক থাকলে তবেই ছাত্ররা থাকবে। তাদের এই নিরবতা ছাত্রছাত্রীদের মনে বিরুপ প্রভাব ফেলে। এর প্রতিফলন তাদের বিভিন্ন স্ট্যাটাস চোখে পড়েছিলো। প্রশ্ন হচ্ছে তারা কেউ কোনো কথা বলেননি কেনো? এখানেও আছে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দেয়া। গত দুই দশকে বেশ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় নেতা এবং রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এমন প্রার্থীদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাতে তারা ওই রাজনৈতিক দলের পক্ষে সবসময় কথা বলেন, তাদের আদেশ মেনে চলেন এবং চলতে সাহায্য করেন। এতে করে সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হলো, যেহেতু তারা সরকার দলীয় শিক্ষক এবং আন্দোলনটা সরকারের বিরুদ্ধে এই কারণে একটা টু-শব্দও করতে দেখা যায়নি বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে। অনেকে আবার লিস্ট করতেও উদ্যত হয়েছেন কারা কারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
৩.
বিসিএস তথা সকল গ্রেডের চাকুরির ক্ষেত্রে বেশ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে চাকুরিতে যোগদান করতে হয়। এই চাকুরির নানা কোটার জন্যেই তো কোটা আন্দোলন হলো এবং এতে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় এবং তা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী সরকার পতনে রুপ নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কিভাবে হয় পাঠকরা হয়তো অনেকেই জানেন না। এখানে বড় একটা দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি লক্ষ করা যায়। এখানে সিভি এবং একাডেমিক সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করা হয় এবং উপর মহলের অনেক লবিংকৃত প্রার্থীদেরকে পরে ভাইভার জন্য ডাকা হয়। বড় রাজনৈতিক কারো হস্তক্ষেপ বা কখনো বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবেই অনেক অযোগ্য প্রার্থী হয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর মতে গুরুদায়িত্ব পড়ে একজন অযোগ্য শিক্ষকের হাতে। কিন্তু এই শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বদলানো প্রয়োজন। বিশ্বে অন্যান্য দেশে যেখানে শুধুমাত্র পিএইডডি ডিগ্রি থাকলেই আবেদন করা যায় সেখানে বাংলাদেশে সদ্য মাস্টার্স পাশ করলেই আবদন করা যায়। এই যোগ্যতা পরিবর্তন করে নূন্যতম পিএইচডি করা উচিত। শুধুমাত্র ভাইভা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ নেয়া অনুচিত। ডেমো ক্লাস কিংবা শিক্ষার্থী কর্তৃক মূল্যায়ন হওয়া উচিত। গবেষণায় ভালোমানের জার্নালে গবেষণাপত্র ছাড়াও অন্যান্য শর্ত জুড়ে দেয়া যেতে পারে। এতে করে যোগ্যশিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে এবং এক্ষেত্রে উন্নত দেশকে অনুসরণ করা যেতে পারে।
৪.
তরুণরা স্বৈরাচার সরকারকে হঠিয়ে আবার নতুন করে স্বাধীনতা এনে দিলো। এরই মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেছেন একটা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে। তারা বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর এবং একটা সাংবিধানিক সরকার গঠনে সাহায্য করবেন। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগেও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। শিক্ষকদেরকে যদি জাতির বিবেক করা না যায় তাহলে আরেকবার এই আন্দোলনের ফসল হাতছাড়া হতে পারে। অন্য কোনো সরকার আবার তাদের দলীয় লোকদের নিয়োগ দিয়ে অযোগ্য শিক্ষক এবং ব্যর্থ সমাজ তৈরি করবেন। এতে সমাজ তথা দেশ পিছিয়ে পড়বে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে তাই নিয়োগ দিতে হবে যোগ্য এবং বিশ্বমানের শিক্ষক।
লেখক: কলামিস্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের শিক্ষক নিয়োগ: নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ মাহমুদুল হাসান মিল্টন মুক্তমত