Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের প্রাণের তিন দাবি

মো. রাকিব
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:২৩

দেশ স্বাধীন হয়েছে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় হয়ে গেলো। বদলেছে দেশ হয়েছে অনেক উন্নয়ন। তবে এই উন্নয়নের ধারায় যেন ভোলা জেলা একপাশেই থেকে গিয়েছে। যার উত্তম উদাহরণ হলো দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছরে এসেও এই জেলার বিচ্ছিন্ন থাকা । বাংলাদেশের কুইন আইল্যান্ড ও একমাত্র দ্বীপ জেলা হিসেবে রয়েছে ভোলা জেলার দারুন ঐতিহ্য। এই জেলার আয়তন প্রায় ৩,৪০৩.৪৮ বর্গকিলোমিটার এবং এটি বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় জেলা। এছাড়াও এই জেলার ৭ টি উপজেলা এবং ১০ টি থানায় বসবাস করে প্রায় ১৯.৩২ লক্ষ মানুষ । এই জেলায় শিক্ষিতের হার শতকরা ৬৭.১২ ভাগ। তারপরেও যেন এই জেলাকে রীতিমতো সারা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জেলা হচ্ছে ভোলা। এই জেলা সারা দেশের অর্থনীতিতে এতো অবদান রাখার পরেও এখনো থেকে গেছে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ভোগ্য শস্য উৎপাদন করে এমন জেলা গুলোর মধ্যে ভোলা জেলা অন্যতম। উৎপাদিত শস্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুপারি, তরমুজ, আলু,বাদাম, মরিচ, কলা মৌসুমী শাক-সবজি সহ বিভিন্ন ধরনের ডাল ইত্যাদি। এই জেলার উৎপাদিত শস্য সারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরিন চাহিদা মিটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে । এছাড়া এই জেলার খাল- বিলের কৈ, শোল, টাকি, শিং ও বোয়াল মাছ এবং আবদ্ধ পুকুরের রুই , কাতলা, তেলাপিয়া সহ বিভিন্ন মাছ সারা দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। আর ইলিশ মাছের আঁতুড়ঘর হিসেবে তো ভোলা জেলার খ্যাতি সারা বিশ্বে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ইলিশ মাছের সিংহভাগ উৎপাদন হয় ভোলা জেলা থেকে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে ভোলা জেলা দারুন ভূমিকা রাখছে।

বিজ্ঞাপন

তবে আজকে আমি এই জেলার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে আসিনি। এসেছি এই জেলার প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের কষ্ট সবার সামনে তুলে ধরতে। ভোলা জেলা থেকে ঢাকা, বরিশাল , চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে যেতে হলে একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নদী পথ। ভোলা থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব প্রায় ২৫৫ কি.মি. লঞ্চ যোগে যেতে সময় লাগে প্রায় ৯ -১২ঘন্টা। একই ভাবে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগে ১০-১২ ঘন্টা আর দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিলোমিটার। আবার এই জেলা থেকে বরিশালের দূরত্ব প্রায় ৪৮ কি.মি লঞ্চ যোগে যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। অর্থাৎ দেশের দুই বৃহৎ শহরে যেতেই আমাদের একদিনের প্রায় অর্ধেক সময় লেগে যায়। আর বর্ষা মৌসুমে রীতিমতো আমাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চ চলাচল করতে হয়।

একটা দুঃখের ঘটনা আপনাদের কাছে তুলে ধরি, গতবছর মে মাসের ৩০ তারিখ মধ্য রাতে আমার বাবার হঠাৎ করে প্রচুর পেট ব্যথা শুরু হয় এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও এতো রাতে চিকিৎসা করানোর মতো কোন মেডিকেল নেই চরফ্যাশন সদরে। থাকলেও সেগুলোর উপর আমাদের ততটুকু আস্থা নেই যতটুকু হলে নিয়ে যেতাম। পরের দিন সকালে বাবাকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানো হলে ডাক্তার অনেক টেস্ট করেও কিছু নির্ণয় করতে পারেনি। এদিকে বাবাকে অতি সত্তর উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল ,ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভোরে বের হওয়া ছাড়া চট্টগ্রাম যাওয়ার ব্যবস্থা নেই আর বিকেল ছাড়া ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তো পরের দিন সকালে আব্বুকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসার ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতে রাত ৮ বেজে যায়। এরপর বাবাকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ভর্তি করানো হয় এবং বাবার পিত্তথলিতে পাথর পাওয়া যায়। অথচ আমরা যদি বাবাকে অসুস্থ হওয়ার দিনই ভোলায় কোনো মেডিকেলে অথবা বরিশাল নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে আমার বাবা আরো কম কষ্ট পেতেন।

এরকম শত শত ঘটনা ভোলাবাসীর নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। এরকমও হয়েছে কেউ অসুস্থ উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেতে যেতেই রোগী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। এরকম একজন ভুক্তভোগী হচ্ছেন জনাব মাওলানা আব্দুল কাদের। আমাদের বাড়ির পাশেই উনার বাড়ি। উনার একমাত্র মেয়ে জান্নাতের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রচুর ব্যথা শুরু হলে অবস্থা গুরুতর দেখে ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার জানান উনার এক্লাম্পশিয়া হয়েছে বাংলায় যাকে খিঁচুনি রোগ বলা হয়। তখন উনাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল নিয়ে যাওয়ার পথেই বাচ্চা ও মা দুজনেই মারা যান। পরিসংখ্যান বলছে ভোলা জেলায় আধুনিক হাসপাতালের সংখ্যা মাত্র একটি। তবে সেটি ঠিক কতটা আধুনিক বলা মুশকিল। এছাড়া এই জেলায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে মাত্র ৬ টি সেগুলো মান নিয়েও আমার প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তাহলে এই মৃত্যুর দায় কার? একটি স্বাধীন দেশের চিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার পিছনে দায় কার ? এই ঘটনা গুলো তুলে ধরছে ভোলা জেলার যাতায়াত ব্যবস্থার ঘাটতি এবং উন্নত চিকিৎসার ঘাটতি। যাতায়াত ব্যবস্থার ঘাটতি বলতে এখানে অতি শীঘ্রই বরিশাল বা ঢাকা না নিয়ে যেতে পারা কে বোঝাচ্ছি।

আপনারা জানেন ভোলা জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। তাই এই জেলার অধিকাংশ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের। তবে ইতিমধ্যেই এই জেলার মানুষ শিক্ষা সচেতন হয়ে উঠছেন । কিন্তু শিক্ষা সচেতন হয়ে লাভ কী? এই জেলায় নেই কোন ভালো মানের কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বপ্নের মতো। এই জেলায় রয়েছে মাত্র ৩ টি স্নাতক কলেজ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই জেলা থেকে শহরে গিয়ে যারা পড়ালেখা করছে তাদের কি পরিমান কষ্ট করতে হয় তা আমি নিজেই ভালো করে জানি। পড়ালেখা এবং থাকার ব্যবস্থা করতে টিউশনির বিকল্প কোন পথ শিক্ষার্থীদের সামনে খোলা নেই। সেদিক থেকে ভোলা জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়।

সবকিছু মিলিয়ে ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে তিনটি বিষয়। প্রথমটি ভোলা থেকে বরিশাল সেতু তৈরি করে জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করা। যদিও ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ( পিপিপি) এর ভিত্তিতে তেঁতুলিয়া ও কালাবাদোর
নদীর উপর দিয়ে ভোলা বরিশাল সেতু নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন। সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ১০ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ সেতু নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি এটিকে পদ্মা সেতুর সাথে তুলনা করি তাহলে পদ্মা সেতুর তিন ভাগের এক ভাগ খরচ দিয়েই এই সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। আশার কথা হচ্ছে ভোলা পাওয়া ৯ টি গ্যাস কেন্দ্র উত্তোলন যোগ্য ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাসের বাজার মূল্য প্রায় ২ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

তাহলে কথা হচ্ছে এই জেলা থেকে এতো পরিমাণ গ্যাস যদি দেশের স্বার্থে ব্যবহার করা হয় বিনিময়ে কি এই জেলার মানুষ ভোলা- বরিশাল সেতু পেতে পারেনা ? এই সেতুর অভাবে কতো মানুষের প্রাণ যাচ্ছে চিকিৎসা না পেয়ে তা হিসাবের বাহিরে। এই সেতুর অভাবে ভোলা জেলা সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে যার ফল স্বরূপ এই জেলার বিশাল পর্যটন খাত,শিল্প খাত এবং মৎস খাতকে ভালো ভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ভোলা বরিশাল সেতু হলে এই জেলা হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সহ সকল ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। এই জেলার মানুষের দ্বিতীয় চাওয়া একটি আধুনিক হাসপাতাল। এখানে যে হাসপাতাল গুলো রয়েছে সেগুলোর গুণগত মান, চিকিৎসা সামগ্রী, হাসপাতালের অবকাঠামো ও ডাক্তারদের মান নিয়ে সাধারণ মানুষের আক্ষেপ সেই পুরোনো। তাই এই মুহূর্তে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা সহ একটি মেডিকেল অতীব জরুরী। এই জেলা থেকে উৎপাদিত ইলিশ মাছ রপ্তানি করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি যে সমৃদ্ধ হচ্ছে তার বিনিময়ে কি ভোলা জেলা একটি আধুনিক হাসপাতালের আশা করতে পারেনা?

এই জেলার মানুষের তৃতীয় দাবি হচ্ছে এখানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ভোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিলেও বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে না কোন পদক্ষেপ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে এই জেলার হাজার তরুণের উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা অতিসত্বর এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বাস্তব কর্মকাণ্ড দেখতে চাচ্ছি। ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা আপনার কাছে ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের কষ্ট লাঘবে তাদের প্রাণের দাবি বাস্তবায়নের অনুরোধ করছি। যদি এই তিনটি দাবি বাস্তবায়ন হয় ভোলা জেলা হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক এবং পর্যটন শিল্প নগরী হিসেবে।

লেখক: শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম

সারাবাংলা/এজেডএস

ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের প্রাণের তিন দাবি মো. রাকিব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর