লাঞ্ছিত শিক্ষক: নৈতিকতার চরম অধঃপতন
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:১৬
শিক্ষক হচ্ছেন গুরুজন। গুরুজনের আনুকূল্য ব্যতীত ব্যক্তি জীবনে সফল হয়েছে এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। পিতা-মাতার পরে যার স্থান তিনি হচ্ছেন শিক্ষাগুরু। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে আদর, ¯েœহ, ভালোবাসা, শাসন, নীতি-নৈতিকতা শেখানোর প্রথম ধাপ শুরু হয় মা-বাবার কাছ থেকেই। এরপর দ্বীতিয়ধাপে যার স্থান তিনি হচ্ছেন শিক্ষক। স্কুলের বাইরেও প্রতিনিয়ত যেসব শিক্ষকদের সংস্পর্শে গিয়ে শিক্ষার সাথে সাথে নীতিবোধ সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন সে সব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের কথা স্মরণ করা প্রত্যেক ছাত্রেরই কর্তব্য। নিজেকে একজন সতিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে শিক্ষকদের অবদানের শেষ নেই। এতবছর পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকম-লীদেরকে আমরা সেভাবেই সম্মান জানিয়ে আসছি। হঠাৎ বর্তমান সময়ের নবপ্রজন্মের শিক্ষার্থিদের হাতে শিক্ষাগুরু, শিক্ষকসমাজ নিগৃহীত হতে দেখে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, অশ্রু সংবরণ করতে পারছি না। গভীর হতাশা আর মনোবেদনা নিয়ে এক কঠিন অস্থির সময় পার করছি। আধুনিক বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার সময়ে এরকম ঘটনার সাক্ষী হতে হবে তা কখনো ভাবিনি। আমাদের দেশের মানুষ যত না পিতা-মাতা কিংবা শিক্ষাগুরুর আদেশ মানেন তার চেয়ে বেশি ধারণ করেন ধর্মগুরুদের কথা। প্রত্যেক ধর্মেই বর্তমানে এই অবস্থা বিরাজমান। তাই স্বভাবতই ধর্মগুরুদের কদর বেশিই বলা যায়। তারা বুঝতে চেষ্টা করে না যে ধর্ম ব্যাপারটি ‘আপেক্ষিক’ একটি দিক নির্দেশনা মাত্র। যেটি আচরণ তথা ধর্মীয় বিধিবদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয় আজকাল প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় আচরণের শিক্ষা দিতে গিয়ে ধর্মীয় বিভেদকে উসকে দিতে দেখা যায়। মুখের কথা আর অন্তরের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদের বিস্তার ঢুকিয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থিদের মনন চেতনায়। প্রত্যেক ধর্মের একশ্রেণির জনগোষ্ঠির কাছে ধর্ম হয়ে ওঠেছে প্রধান অবলম্ভন। ধর্মীয় জীবনযাপন ছাড়া বড়ো হওয়া যেনো সম্ভব নয়, এরকম একটি রেওয়াজে পরিণত হওয়ার কারণে আমরা বর্তমানে প্রকৃত মূল বাঙালি জাতীয়তাবোধের সংস্কৃতি, নীতিবোধের শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ, মতবিরোধ শিক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার ফলে আজ দেশ চরম দৈন্যদশায় পরিণত হয়েছে। এর থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজতে হবে। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘উন্নতি হচ্ছে তবে বৈষম্য বাড়ছে’ বিষয়ের এক প্রবন্ধে লিখেছেন- দেশে তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিন ধারার মধ্যে দুই ধারা- ইংরেজি ও মাদ্রাসা। দুটি কৃত্রিম, অসম্পূর্ন এবং দুটির মধ্যেই মাতৃভাষার চর্চার অভাব। দুটিই আমাদের স্থানীয় ইতিহাস, পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার মূল মিল হলো উভয়েই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে।
দেশের মূল সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছন্ন হওয়া মানে বিপথে পরিচালিত হওয়া। এতে করে তাদের মন থেকে দেশাত্ববোধ চেতনা ক্রমশঃ হারিয়ে যায়। ফলে একসময় সেই সব তরুণদের একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অপর আরেকটি অংশের ধর্ম হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র। তারা মনে করে ধর্মই তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে। পারিবারও মনে করেন তাই। সেকারণে তাদের মা-বাবারা অতি উৎসাহে সন্তানদের ঠেলে দেয় ধর্মীয় জীবনযাপনে। এভাবে একসময় সন্তানগণ বাঙালিত্ত্বের মূল শেখড় থেকে হারিয়ে গিয়ে বৈষম্যের বেড়াজালে বেড়ে ওঠে। আমি শিক্ষক নই কিন্তু একসময় অসংখ্য শিক্ষকের ছাত্র ছিলাম। বড় হওয়ার পর পেশাগত জীবনে আমি যাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখা বা জানার জন্য সংস্পর্শ লাভ করেছি প্রত্যেককে একইভাবে আমি শিক্ষগুরু হিসেবে সম্মান করি। এই সম্মানের অর্থ হচ্ছে কৃতজ্ঞতা পরায়ন হওয়া। কৃতজ্ঞতা পরায়ন না হলে একজন মানুষ কখনো উদার মনের মানুষ হতে পারে না। মানুষ হয়ে মানুষের উপকার করতে পারে না, মানবিকতাবোধ জন্ম নেয় না। একজন সহজ সরল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হতে হলে তাদের মধ্যে এই গুণাবলীগুলো অবশ্যই থাকতে হবে। আজ একশ্রেণির লোক মানুষ হয়ে পশুর মতো আচরণ করছে, কথায় কথায় অপদস্থ, হেনস্থা করছে, যেটি একজন সত্যিকারের মানুষের কখনো কাম্য নয়। সকল ধর্মের পবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থে প্রাণীর চেয়ে মানব জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ত্ববোধ জাগ্রত আছে বলেই। এই মনুষ্যত্ত্ব বা বিবেক যাদের মধ্যে লোপ পায় তারা হিং¯্র হয়ে ওঠে। পশুর মতো আচরণ করে।
বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের পর থেকে দেশব্যাপী মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজ একশ্রেণির উশৃঙ্খল শিক্ষার্থির নিকট যেভাবে লাঞ্চিত হয়েছে সে ধারাবাহিকতা এখনো পর্যন্ত চলমান রয়েছে তা এক নজরে দেখে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভীষণ লজ্জাবোধ করছি। জোর করে পদত্যাগ করিয়ে মারধর করার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শোভা পাচ্ছে। যারা এই অঘটনগুলো করে চলেছে তারা স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্টানের ইউনিফর্মধারী শিক্ষার্থি। যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার্থিদের চাপে পদত্যাগ করতে অপরাগতা জানিয়েছে তাদের ওপর চালানো হয়েছে মানসিক নির্যাতন। ভিডিওতে একজন পুরুষ শিক্ষককে দৌঁড়ায়ে দৌঁড়ায়ে উল্লাস করে করে আঘাত করতে দেখা যায়। এক শিক্ষার্থিকে বলতে শোনা যায় আজ দীপক স্যারকে মারতে পেরে খুব ভালো লাগছে। ছিঃ কী লজ্জাকর কথা। এই দীর্ঘজীবনে শিক্ষাগুরুদের নিয়ে এ জাতিয় কথা কোনদিন শুনিনি। দীপক চৌধুরী সিলেটের একটি স্কুলের শিক্ষক। কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রুখসানা পারভীনকে প্রথমে অন্যস্কুলে বদলি করা হলেও পরবর্তিতে ওএসডি করা হয়। বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুক্লা রাণী হালদার ‘পদত্যাগ করলাম’ এই দুটি শব্দ লিখে শিক্ষার্থিদের চাপের মুখে সড়ে পড়েন। একই কায়দায় সড়ানো হয়েছে ঢাকার আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়য়াকে। এরকম দেশের বহুস্থানে দেখা গেছে শিক্ষর্থিদের পাশাপাশি অতি উৎসাহী অভিভাবক ও বহিরাগতদের যোগদিতে। শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে মারধর করে শিক্ষার্থিদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। বিকৃতরুচির পরিচয় দিয়েছে। সুশিক্ষা যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এরকম কর্মকাণ্ড পুরো জাতির জন্য অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। উশৃঙ্খল বেপরোয়া শিক্ষার্থিদের হাত থেকে শিক্ষক সমাজের সম্মান রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত ২৭ আগষ্ট সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ জারি করে। নির্দেশ জারির পরও থেমে নেই। যা চরম ধৃষ্টতার সামিল!
দোষে গুণেই মানুষ। কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। শিক্ষকদেরও ভুল থাকতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে শিক্ষার্থীরা আইনকে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে! আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিবে! তারা সুনির্দিষ্ট শিক্ষকের ব্যাপরে যদি অভিযোগ থাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারে। তারা পারে না কোনো অবস্থাতে শিক্ষকগণদের গায়ে হাত তুলতে, টেনে হেঁচড়ে চেয়ার থেকে তুলে, ভুয়া ভুয়া ধুয়া তুলে দস্তখত নিয়ে পদত্যাগ করাতে। এটি গোটা আইনি ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল! শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির মেরুদন্ড। এই মেরুদন্ডের একটি অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে সম্মানিত শিক্ষক সমাজ। এই ক’দিনে শত শত শিক্ষক চরমভাবে লাঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষকগণ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। সরকারের উচিত শিক্ষক সমাজের প্রতি সদয় হয়ে এর একটি সুন্দর সম্মানজনক বিহিত করা। শিক্ষকগণ হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সেখানে যদি কোনো তৃতীয় পক্ষ এসে হয়রানী, নাজেহাল, নির্যাতন করে সেটির কালিমা সরকারের ওপরেই বর্তায়। শিক্ষকগণ দেশের আলোর পথের যাত্রী, এরা কারো মা, কারো বাবা, কারো ভাই, কারো বোন একটি পরিবারের অভিভাবক, সমাজের মর্যাদাশীল ব্যক্তি। শিক্ষকসমাজের ওপর থেকে পশু বৃত্তি আচরণ বন্ধ হোক।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক