Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আর কত প্রাণ গেলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে

মাহ্তাব মুহাম্মদ
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:১৩

ফেলানীর কথা মনে আছে সবার? সেই যে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানী! যে ফেলানীকে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি করে হত্যা করেছিল। সে সময় ছোট্ট ফেলানীর রক্তে ভেজা শরীরখানি কাঁটাতারে ঝুলে ছিল দীর্ঘ সময়। কী নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল বিএসএফ! আজও সেই নৃশংসতার দৃশ্য মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। এখনো সেই ফেলানী হত্যার বিচার হয়নি। বিএসএফের কোর্ট ফেলানীকে গুলি করা বিএসএফ সদস্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। ফেলানীর অসহায় মা বারবার বিচার চেয়েছে, কিন্তু বিচারের দাবি বারবারই ডুকরে কেঁদেছে।

বিজ্ঞাপন

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফেলানী যেনো আবার ফিরে এলো স্বর্ণা দাস হয়ে। গত ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালে স্বর্ণা দাস নামের ১৪ বছর বয়সী স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে রাত ৯ টার দিকে ভারতের বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। বিএসএফের হাতে খুন হওয়া স্বর্ণা দাস পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনিগড় গ্রামের পরেন্দ্র দাসের মেয়ে। সে নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ালেখা করতো। (কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী নিহত, আহত ২, দ্য ডেইলি স্টার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)

বিজ্ঞাপন

স্বর্ণা দাসের অপরাধ কী ছিলো? অপরাধ ছিলো- দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়া ভারতের ত্রিপুরায় বসবাসকারী ভাইটিকে এক নজর দেখতে মায়ের সাথে লালারচক সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যেতে চেষ্টা করেছিল। সে সময় বিএসএফ তাদের গুলি করে। নিহত হয় স্বর্ণা দাস। আহত হয় আরো দুজন।
প্রশ্ন ওঠে: সীমান্তে এতটুকু ঘটনায় গুলি চালানোর কোন নিয়ম আছে কি?

উত্তর হলো- নেই। আন্তর্জাতিক কোনো আইনে কিংবা ভারতের পেনাল কোডেও এ রকম কোনো ঘটনায় নিরীহ, নিরস্ত্র নাগরিককে বিচারবহির্ভূতভাবে গুলি করে হত্যা করার কোনো অবকাশ নেই। কেউ যদি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে তবে তাকে আটক করে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি গুলি চালানো কোনোমতেই আইনসিদ্ধ নয়। এটা অন্যায়। এটি আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত দুটি প্রটোকল উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রটোকল দুটি হলো: দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান-২০১১ এবং জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ-১৯৭৫।

জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ প্রটোকলের ধারা ৮(আই)-এ বলা আছে, “এক দেশের নাগরিক যদি অন্য দেশে বেআইনিভাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করে বা কোনো অপরাধে জড়িত হয়ে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার নিমিত্তে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারবে, তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাটাই কাম্য।”

আবার, আর্টিকেল ৮(এম)-এ উল্লেখ আছে, যদি সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার করা হয়, তাহলে গরু ও গরু পাচারকারীদের সম্পর্কে তথ্য অপর পক্ষের সীমান্তরক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং নিকটস্থ থানার পুলিশের নিকট মামলা দায়ের করে গরু উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

কিন্তু বিএসএফ এই দুটি প্রটোকলের কোনোটিরই তোয়াক্কা করছে না। তারা প্রতিনিয়ত বেআইনিভাবে দ্বি-পক্ষীয় প্রটোকল লঙ্ঘন করে ফেলানী খাতুন, স্বর্ণা দাসের মত শত শত বাংলাদেশিকে নানা অজুহাতে সীমান্তে হত্যা করেই চলেছে। হত্যা করার পর দায়মুক্তির জন্য বিএসএফ নানা নাটক সাজাচ্ছে। কখনো আত্মরক্ষার নাটক, কখনো আবার গরু চোরাচালানের নাটক। সীমান্তে যে সব লোক বিএসএফের দ্বারা খুন হয়েছে, তাদের সাথে এমন কোনো ভারি অস্ত্র ছিল না এবং তারা বিএসএফকে আক্রমণও করেনি যে, আত্মরক্ষার্থে বিএসএফকে গুলি চালাতে বাধ্য হতে হবে। বরং সীমান্তে নিহত হওয়া বেশিরভাগ মানুষই নিরীহ কৃষক কিংবা খেটে-খাওয়া মানুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে থাকা অবস্থায় গরুর জন্য ক্ষেতে ঘাস কাটতে গিয়েও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। এর মধ্যে আছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের বারীনগর গ্রামের ১৬ বছরের কিশোর সামিরুল ইসলাম ওরফে সামিউল। ঘটনাটি ঘটে ৯ নভেম্বর, ২০২৩ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্তে। দুপুর ১২টার দিকে সামিউলসহ কয়েকজন দিয়াড় মানিকচক সীমান্তের ৫ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকার জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজ বাংলাদেশের ভেতরে ঘাস কাটছিল। এ সময় ভারতের চর আষাড়িয়াদহ বিএসএফের একটি টহল দল তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।(সীমান্তে ঘাস কাটতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে কিশোর নিহত, ৯ নভেম্বর, ২০২৩, বাংলা ট্রিবিউন)

অথচ সে সময় সামিউল বাংলাদেশের সীমানার ভেতরেই ছিল। বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে কোনো কিশোর ঘাস কাটলে ভারতের বিএসএফের সমস্যা কী? নিজের দেশের ভেতরে থেকে কাজ করলেও বিএসএফের চুলকানি ওঠে কেনো? এখানে কিসের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বিএসএফ গুলি ছুড়লো? আসলে আত্মরক্ষার অজুহাতে গুলি ছোড়া ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর একটা হাস্যকর নাটক ছাড়া কিছু নয়। একইভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরু চোরাচালানের নাটকও অগ্রহণযোগ্য। কিছু কিছু গরু চোরাকারবারির উৎপাত থাকলেও বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক ও তাদের পরিবারগুলো।

এ ব্যাপারে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটি রায় বলেন, “এই সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালানিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এইসব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাটোয়ারায় মেলেনা তখন বিএসএফ হত্যা করে।” (বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা?, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ডয়চে ভেলে)

এভাবেই বিএসএফ দুর্বল অজুহাত তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে সীমান্ত হত্যার বৈধতা দিতে চায়। অজুহাত তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে বিএসএফ এ পর্যন্ত শত শত বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে ৩১ জন বাংলাদেশিকে সীমান্তে বিএসএফ গুলি কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। ২০২২ সালে হত্যার সংখ্যা ছিল ২৩ জন, ২০২১ সালে ১৮ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন এবং ২০১৭ সালে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়।

তাছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ এই ১১ বছর সময়ে ৫২২ জন বাংলাদেশিকে বিএসএফ গুলি কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। (সীমান্ত হত্যা কমেনি করোনাকালেও, প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)

সীমান্তে বাংলাদেশিদের যেভাবে হত্যা করা হয়, চীন, পাকিস্তান কিংবা নেপাল সীমান্তে কিন্তু এত হত্যা নেই। সেখানে এতো আগ্রাসী থাকে না বিএসএফ। বাংলাদেশের সাথে থাকা সীমান্তে বিএসএফ যতটা গরম, অন্যদেশের সাথে থাকা সীমান্তগুলোতে ততটাই নরম। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী?

বিশ্লেষণে ওঠে আসে, এর প্রধান কারণ হলো হাসিনা সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। সেইসাথে অতি ভারত তোষণই সীমান্তে বিএসএফকে এতটা বেপরোয়া করেছে। বিএসএফ বারবার নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যার পরও স্বৈরশাসক হাসিনা ভারতের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করেনি। উল্টো ভারতকে ট্রানজিট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বন্দরের মত বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য স্বৈরশাসক হাসিনা ভারতকে নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে; বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে সীমান্তে একের পর এক লাশ উপহার দিয়েছে।

এ ব্যাপারে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটি রায়ের ভাষ্য, “বাংলাদেশও এটা নিয়ে কিছু বলে না। কোনো জোরালো প্রতিবাদ করে না। তারা জো হুজুর, জি হুজুর করে। এভাবে করলে তো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। আর ভারত সরকার তো হিন্দুত্ববাদী মনোভাব থেকে মুসলিমদের টাইট দেয়ার কাজে ব্যস্ত।” (বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা?, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ডয়চে ভেঁমলে)

এজন্য বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারকে সোচ্চার হতে হবে। ভারতকে কড়া বার্তা দিয়ে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করতে হবে। শক্তিশালী, আপোসহীন পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। সীমান্ত হত্যা প্রশ্নে ভারতকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। প্রতিটি হত্যাকান্ডের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে হবে। সকল হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার জন্য এভাবে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলে নিঃসন্দেহে তার সুফল মিলবে। এ যাত্রা অন্তবর্তীকালীন সরকারকে দিয়েই শুরু হোক, সেই প্রত্যাশা রাখি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

আর কত প্রাণ গেলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে মাহ্তাব মুহাম্মদ

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর