দলীয় সেই ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসেডররা এখন লাপাত্তা
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৩৩
অনুকরণে আমরা বড়ই পারঙ্গম। নকলে সিদ্ধহস্ত। অথচ মৌলিক সৃষ্টিতে আমাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। বিশ্বায়নের এ যুগে আমরা দেশীয় আচার, কৃষ্টি-কালচারকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যেমন চিন্তা করিনি তেমনি বিদেশের সব কিছুই ভাল ভেবে তা অন্ধ অনুকরণে রীতিমত অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছি। আগে আমাদের দেশে কোম্পানীর পণ্য বিপণন কাজে বিক্রয় প্রতিনিধি বা ভদ্র পরিভাষায় সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ নিয়োগ করা হত। তাদের কাজই ছিল কম্পিটিটিভ মার্কেটে নিজেদের পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি ও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তারা যা পেত তা তাদের ব্যক্তিগত জীবন যাপনের জন্য আহামরি এমন কিছু যে ছিল না তা সবাই জানেন। কোম্পানির জৌলুস ও মার্কেট দখলের ক্ষমতার সাথে এসব সেলস রিপ্রেজেনটেটিভদের সুযোগ সুবিধাও বৃদ্ধি পেত। বিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে সব ক্ষেত্রে যেমন রংয়ের আস্তরণ আকর্ষণীয় করা হয়েছে তেমনি পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানেও এর ঢেউ লেগেছে। তারা সেকেলে ছা পোষা কেরাণীর গন্ধযুক্ত সেলস রিপ্রেজেনটেটিভের বাইরেও তাদের পণ্যকে প্রমোট করতে বেছে বেছে কিছু বিশিষ্ট জনকে ব্র্যাণ্ড এম্বাসেডরের পদবী দিয়ে তাদের বিক্রয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের কাজটি করিয়ে নিচ্ছে। বিনিময়ে এসব বরপুত্র অ্যাম্বাসেডরদেরকে থোক হিসেবে যা দেওয়া হয় ক্ষেত্র বিশেষে কমবেশি তার মূল্যমান হতদরিদ্র দিনমান মাঠেঘাটে প্রানান্তকর পরিশ্রম করে বেড়ানো সেলসম্যানদের চেয়ে কয়েক শ’ গুণ বেশি। তার উপর রয়েছে জামাই আদর ও সুহাসিনী প্রিয়ভাষিণীর জন্য বাড়তি কিছু লেনাদেনা।
কালের বিবর্তনে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে; অনেক কিছুই নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে। বিদেশে আছে কিনা জানিনা, আমাদের দেশে দলীয় কাজে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে এক ঝাঁক ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের কাজই হলো দলের ঢেঁড়া পেটানো। যার ঢেঁড়ার আওয়াজ যত বেশি আকারে প্রকারে দলদাসের উচ্চস্তরে গিয়ে পৌছবে তার আনুতোষিক, পারিতোষিক তত বেশি উঁচু হবে। দলে তার কদর তত বেশি। তার জন্য থাকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিশেষ প্যাকেজ, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে জাতীয় পুরষ্কার, সরকারি ও স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ, কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি হওয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যত, বিদেশি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার, বিদেশি মিশনে উচ্চপদে চাকরির সুযোগ। তাই, আমাদের দেশে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গণের এক ঝাঁক তারকা দলদাস হওয়ার জন্য প্রকাশ্যে লাইনে দাঁড়াতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করে না। একবার সেই ক্লাবে ঢোকার চান্স পেলেই কেল্লা ফতেহ। গাড়ী-বাড়ী-নারী, ধন-দৌলত পদ-পদবী সব আপসে আপ আসতে থাকবে। এরা দলের জন্য আপদ না বিপদ নাকি সম্পদ তা নিয়োগকারী দলের কর্তাব্যাক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন।
এরা সুখের পায়রা, দুঃখের সাথী কিনা বলা কঠিন। সময় এসেছে এদের ভূমিকা মূল্যায়নের। এদের দেখলেই চিনে নিতে কারো কষ্ট হয় না। এরা সেক্যুলার নামধারী, প্রগতির ধ্বজাধারী, উন্নয়নের ক্যানভাসার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাইকার। ধর্ম এদের কাছে অপসারণযোগ্য গ্যাংরিন। নীতি-নৈতিকতা, তাদের কাছে, নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য বাধ্যতামূলক। রুচির ফেরিওয়ালা দলীয় এসব ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসেডরদের কাজ হলো মোটা দাগে নিজেদের বিকৃত রুচির চর্চাকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে অভিহিত করে পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যারোপ, বিষোদগার করা ও টার্গেট করে সমাজের মধ্যে ঘৃণার উদগীরণ করা এবং দলীয় গোয়েবলসের ভূমিকা পালন করা। বিদেশি প্রভুদের হয়ে কাজ করা আর তাদের কেয়ার গিভার হিসেবে ইনাম ধন্য হওয়া।
এদের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো এরা খুবই প্রভুভক্ত হয়ে থাকে। কোন এক কালে নিজ সৃজনশীলতার গুণে মিডিয়ার আইকন তকমা পাওয়া এসব ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসেডররা পারিতোষিক, আনুতোষিকের লোভে নিজ কর্ম ফেলে দলীয় আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রভুর ইশারায় এরা শীত নিদ্রা যায়, প্রভুর আদেশে নিদ্রা থেকে জেগে দলবাজিতে লেগে পড়ে। পত্রিকায় এক শ’ এক বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ইঁদুর দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশিষ্ট শিল্পী, বিদগ্ধ সাহিত্যিক পদবাচ্যের এসব দলবাজদের কাছ থেকে জনগণ এখন আর সৃজনশীলতা আশা করে না। বরং চামচামিতে বিশেষত্ব, নতুনত্ব প্রত্যাশা করে। কিন্তু তাও পায় না। তারা সাদামাটা দলদাসের উর্ধে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারে না। প্রভুর তুষ্টিতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা এসব দলদাসরা তাই জনগণের বিপক্ষে লাঠিয়ালের সহায়ক শক্তি হিসেবে, মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, ক্ষেত্র বিশেষে নিজেরাই প্রদর্শনীর বস্তু হয়ে কোমর কেঁচে নেমে পড়ে। মিথ্যাচার, বেলেল্লাপনা এদের ভূষণ। এরা দেশের, দশের জন্য কোন ভ্যালু এড করতে পারে না, বোধকরি দলদাস হিসেবে দলের জন্যও না। তবে দল তাদেরকে উচ্চমূল্যে গৃহপালিত দ্বি-পদ হিসেবে, গø্যামারাস ক্রীতদাস হিসেবে লালন পালন করে থাকে । এরা সামাজিক মাধ্যমে প্রায়শই মারফতি ঢংয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকে। অধুনা তারা গোপনে লিমিটেড কোম্পানির মত সামাজিক মাধ্যমে প্রাইভেট গ্রুপ খুলেছে। দলীয় আণ্ডাার ওয়ার্ল্ডের পেটোয়া বাহিনীর মত জনগণের বিপক্ষে জব্দকরণ মন্ত্র আঁটে, গরম জলের ফোড়ন কাটে। ধরা পড়লে হাসি দিয়ে বেক্কলের মত খোঁড়া যুক্তি দেয়। কেউ অবস্থা বেগতিক আঁচ করে, সাবধানী অতিশয় হয়ে সটকে পড়ে এই বলে যে, আমি ঐ গ্রুপে এডেড ছিলাম কিন্তু কোন কিছু লিখিনি, বলিও নি। হরবোলাদের কত কারিশমা!
তারা হয়ত এখন সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ছুঁতানাতা কোন কারণ পেলেই হুক্কা হুয়া ক্যায়া হুয়া ডাকে সবাই মাঠে নেমে পড়বে এক সাথে। মানবতার বুলি তাদের মুখে। আর আত্মা বন্ধক দেওয়া আছে অন্যত্র। তাই, প্রভুর ইশারা ছাড়া তাদের মানবতা উপচে উঠে না। বরং অমানবিক হয়ে উঠে। তাদের জন্য লাগাতার ধিক্কার ও ভর্ৎসনা। হাওয়া বদলের সাথে সাথে এরা এখন গায়েব হয়ে গেছে। কেউ কেউ গুহাবাসী। নিভৃত গুহা থেকে সাফাইমূলক স্ট্যাটাস দিচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেকে তথাকথিত দলবাজদের থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টাও করছে। শুধু কাংখিত আলো আর আসছে না ভেবে যারপরনাই মর্মাহত ও দারুণ শংকিত। অথচ স্ব স্ব ক্ষেত্রে তারা ছিলো আমাদের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গণের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আগামীতেও তারা আলো ছড়াতে অনেক বড় ভূমিকা নিতে পারত। অতীতের মত দেশ, জাতি, আপামর জনতাও তাদের গুণের, সৃষ্টির অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন করত। এখন তাদের জন্য রয়েছে প্রবল ঘৃণা আর মুখ ভর্তি প্রক্ষেপণযোগ্য অপরিশোধিত এক দলা থুতু।
আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতের এক ঝাঁক নক্ষত্রের এরূপ গুহাবাসী জীবন জাতিকে অনাগতকাল অনেক বিনোদন থেকে বঞ্চিত করবে এটা নিশ্চিত। তারা কবে ভোল পাল্টে আবার কবে কার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে হাসি মুখে ফিরে আসবে তা সময়ের ব্যাপার, কিন্তু মোটেই কাম্য নয়। সমাজে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এসব কুশীলবদের এখন স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় গুহাবাসী জীবনই তাদের জন্য যথোপযুক্ত। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এজেডএস