Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই

আহসান হাবিব
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০০

আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসন আমলে দফায় দফায় বেড়েছে বাস ভাড়া। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। দেশে একবার একটা জিনিসের দাম বাড়লে সেটা আর কখনও কমে না। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান অসহনীয় অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। পরিবহন ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ওপর। ফলে ক্রয় ক্ষমতা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে।

আমাদের দেশে তেলের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ভাড়া। পণ্য পরিবহন ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয় ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিকরা। বাসের ক্ষেত্রে সরকার ও বাসের মালিক-শ্রমিক নেতারা মিলেমিশে একচেটিয়াভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে। নির্ধারিত ভাড়ারও কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাসের শ্রমিকরা। সরকার বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে কখনোই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে বাসের মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে আজ সাধারণ মানুষ জিম্মি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আমলের যুগ হয়েছে। এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের যুগ। আওয়ামী লীগের পট-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হাত বদল হয়েছে। বাস ভাড়াতেও হয়েছে হাত বদল। আগে বেশি ভাড়া নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সাঙ্গপাঙ্গরা। বর্তমানে বিএনপি নামধারী শ্রমিকরা নিচ্ছে বেশি ভাড়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত থেকে দেশ স্বাধীন হলো। মানুষ ভেবেছিল হয়তো এখন একটু স্বস্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটা আর হলো কই। অন্তর্বর্তী সরকারের বেলায়ও তো একই অবস্থা। গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই।

২০২১ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল। তখন বাস ভাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ ও লঞ্চ ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময়ে তেলের দামের চেয়ে বেশি হারে বাস ও লঞ্চের ভাড়া বেড়েছিল। বিআরটিএ থেকে সর্বনিমন্ন বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা এবং কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ছিল ২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু বাসের সুপারভাইজাররা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করত কিলোমিটার প্রতি ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা। এতে করে বাসের মালিক এবং শ্রমিক সিন্ডিকেট গত কয়েক বছরে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এক বছর না হতেই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। তেলের দাম বাড়াতে লাভবান হচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু বাস মালিক এবং শ্রমিক সিন্ডিকেট। যার প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিমন্নধ্যবিত্তদের ওপর। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হয়নি। সবকিছু মিলে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় কতদিন টিকে থাকা যাবে তা বলা অনিশ্চিত। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কমছে, তখন দেশে ৫০ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে করে লাভোবান হয়েছেন বাস মালিক ও শ্রমিক সিন্ডিকেট।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেমলর দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু বাস ভাড়া কমেনি। ভাড়া আগেরটাই নেওয়া হচ্ছে। এটি অন্যায় এবং অযৌক্তিক। দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিককে যাতায়াত ভাতা দেয়া হয় না। তারা শুধু বেতন পায়। বেতনের টাকা থেকেই যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকায় প্রতিজনের যাতায়াত খরচ ৭০ থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি মাসে বেড়েছে ২ হাজার ১শ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া খুবই কঠিন হবে।

জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। কিন্তু বাস ভাড়া কমেনি। এতে করে জনমনে তীব্র হয়েছে। বাস মালিক ও শ্রমিকরা তাদেও স্বার্থের হানি হলেই রাস্তায় ধর্মঘট শুরু করে দেয়। ফলে দেশের খেটে খাওয়া মানুষরা পড়ে চড়ম বিপদে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দফায় দফায় তেমল মূল্যবৃদ্ধির ফলে তেলের জন্য পাম্পে পাম্পে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এর প্রভাব দেখা যায় তার পরদিনও। এদিন ঢাকাসহ দেশজুড়ে গণপরিবহন সংকট ছিল চরমে। তেলের দামের সঙ্গে ভাড়া সমন্বয়ের অভাবে গণপরিবহনে অঘোষিত ধর্মঘট পালিত হয়েছে। সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিল প্রায় ফাঁকা। বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে বিক্ষুব্ধ মানুষ। অনেক সময় পরপর দু-একটা বাস এলেও তাদের বেশির ভাগেই উঠতে পারেননি নারী, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীরা। যারা উঠেছেন, তাদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বেশি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডাও হয় অনেক স্থানে। দেশের অনেক এলাকায় বাস রাস্তায় নামানোর জন্য পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ, এসব ঘটনা নতুন নয়। বাসের মালিকদের স্বার্থের হানি হলেই রাস্তায় নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। এটা নতুন নয়। আগেও হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। বাজার সরকারের কোন রকম নিয়ন্ত্রণে নেই। সেখানে সরকার এক লাফে তেলের দাম যে পরিমাণ বাড়িয়েছে এটা একদম অপরিণামদর্শিতা। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে জ্বালানি তেলে চলে না এমন পরিবহনেও চলাচলের সুযোগ ছিল না। কারণ সংকট টের পেয়ে তারাও কয়েক গুণ ভাড়া বাড়িয়েছে। শুধু রাজধানীর ঢাকা শহরে বাসে ১০ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা, ২৫ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা, ৩৫ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ৫০ টাকা। দূরপাল্লার বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। ৪৫০ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ঢাকা-কুমিল্লা-লাকসাম, ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরব, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-ভাঙ্গা, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন রুটে বাস ভাড়া আগের চেয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়েছে। দূরপাল্লার রুটগুলোতে বাসভাড়া যাত্রীপ্রতি এক লাফে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। কিন্তু বাস শ্রমিকদের জ্বালানি তেলের দাম কমার কথা বলেই যাত্রীদের বাস শ্রমিকদের কাছে উপমানিত হতে হচ্ছে।

গণপরিবহনে চলছে এখন লুটপাটের মতো অবস্থা। যে যার মতো করে ভাড়া আদায় করছে। কোনো নিয়ম কানুনের বালাই মানছে না বাস শ্রমিকরা। তাহলে সাধারণ মানুষের কি হবে এটা ভাবার দায়িত্ব কার? সবমিলিয়ে এক হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর দায়ভার কে নেবে? কে শুনবে সাধারণ যাত্রীদের দুর্দশার কথা। কে করবে এর সমাধান? অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি বিষয়টা নিয়ে একটু ভাববেন?

লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক

সারাবাংলা/এজেডএস

আহসান হাবিব গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর