সংখ্যালঘু কমিশন কেন জরুরি?
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৪০
নবগঠিত অন্তর্বতী সরকার গত ৮ আগস্ট একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এই সময়ে একের পর এক হামলায় পর্যুদস্ত হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু জনগণ। ভয় আতংকে তটস্ত ছিল দিনের পর দিন। মাস পেরিয়ে গেলেও খুলনা, যশোর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় সহ অনেক স্থানে আতংক কাটেনি। গ্রাম পাড়া মহল্লায় হামলাকে প্রতিরোধ করতে নির্ঘুম পাহারা বসিয়ে রাত পার করেছে নারী পুরুষ। যেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি বিদ্যমান, গ্রাম থেকে নগর সেসব এলাকায় এই নিদারুণ চিত্র চোখে পড়েছে। আমি নিজেও অনেকের সাথে পাহারাদারে শরিক হয়েছি। যদিও বা মেট্রোপলিটন এলাকায় আমার আবাস হলেও থাকতে হয়েছে সতর্ক অবস্থানে। অনেককে আবার ডেকেও গলিতে নামাতে পারিনি; তারা প্রবল ঘোরে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। প্রতিবেশি চা বাগানের মালিক জয়নাল আবেদীন ভাইও ছিল ভয়ার্ত ঘটনার সহযাত্রী। এরপরও অনেক জায়গায় ডাকাতি হামলা লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ বাঁচাতে অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর এই পর্যন্ত হাজার হাজার ঘটনা ঘটলেও কোনোটির বিচার বা শাস্তি হয়নি। মামলা হলেও তা ক’দিন পর নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। একদল দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠি প্রতিবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষয়ক্ষতি, হামলা লুটপাটের মতো ঘটিয়ে চলে। আইন আছে আইনের কোনো কার্যকারীতা দেখা যায় না। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠির করণীয় কি কেউ জানেনা!
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, পূজামন্ডপ, উপসনালয়, ব্যবসা বাণিজ্য ও বাড়িঘরে হামলা করা হয়। পুলিশ প্রশাসনের ওপরেও নির্বিচারে হামলা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম বাহিনী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ প্রশাসন এখনো পুরোদমে সক্রিয় হয়নি। তাদের ওপরযে বর্বরতা চালানো হয়েছে কোনো সভ্য দেশে এরকম নজির নেই! পুলিশদের মনোবল ভেঙেগেছে। দেশের জনগন এখন অনেকটা নিজের নিরাপত্তার মালিক নিজেই। পরিবার পরিজন নিয়ে কোথাও একটু ভ্রমনে বেরোবে ভয় আতংকে তাও হয়ে উঠছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নাই বললেই চলে। এই ক’দিনে দেশে এমন এমন রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে তা খুবই নিন্দনীয়। সাধারণ মানুষদের পিঠিয়ে মেরে ফেলা, পুলিশ, শিক্ষক, চিকিৎসকদের ওপর কথায় কথায় হামলা ছিল নজিরবিহীন। বিভিন্ন স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়; যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আইন শৃঙ্খলার অভাবে ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দাভাব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এক গুমোটবাঁধা জীবন অতিবাহিত করছে দেশের জনগণ। প্রথম আলো’র ৫ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ১৬ দিনের এক প্রতিবেদনে দেশে ১০৬৮ টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্থাপনায় হামলার সংবাদ তুলে ধরেছে। এসময় দুইজনকে কুপিয়ে ও নির্যাতন করে হত্যা করে। ২০ আগষ্টের পর থেকে গত ৭ সেপ্টেম্বর গণেশ পূজার দিন পর্যন্ত দেশের বহুস্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে সব মিলে দেড় হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ, হত্যা, ধর্ষণ, খুন, হামলা, মামলা, লুটপাট রোধ ও সঠিক বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখার স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ে একটি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি হলে আগামীতে যেকোনো রাজনৈতিক সরকার দেশ পরিচালনায় আসলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণকে বিচারহীনতায় ভুগতে হবে না। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে একটি মাইনরিটি ডিক্লারেশন দেন। ঘোষণা পত্রে বলা হয়, দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্রকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে বহুবার ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের ব্যপারে বিগত সরকারগুলোদেরকে বার বার তাগাদা দেওয়া স্বত্বেও কোনো সরকারই তাদের কথা আমলে নেননি। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইশতেহার ঘোষণায় ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের অঙ্গিকার করেছিলেন কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সেই প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়ন করেনি।
প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ৫ দিন পর অর্থাৎ ১৩ আগস্ট সকালে সনাতন সম্প্রদায়ের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ^রী পরিদর্শনকালে তিনি বলেছিলেন, ‘এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার, এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করা প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ , বাংলাদেশি।’ বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ৫০ বছর ধরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নানা পটভূমিতে সংখ্যালঘুদের টার্গেট (লক্ষ্যবস্তু) করে হামলার ঘটনা ঘটে আসছে। এসব হামলার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু শূন্য করা। ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন ‘নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে কোনো ভেদাভেদ করা হবে না।’
সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু প্রত্যেকেই এদেশেরই ভূমিজসন্তান। একজন আরেকজনের প্রতিবেশি, সকলের একটিই পরিচয় মানুষ এবং প্রত্যেকের প্রিয় আবাসভূমি বাংলাদেশ। এর বাইরে অন্যকিছু চিন্তা করা মোটেই কাম্য নয়। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ বা কে খ্রীষ্টান হিসেবে চিহ্নিত করার আগে দেখতে হবে সকলে এই দেশের মানুষ কিনা। সকলের মনে রাখা উচিত জবর দখল, হত্যা, লুন্ঠন করে কেউ কোনদিন স্থায়ী হতে পারেনি। এগুলো কোনো মানুষের বৈশিষ্ঠ্য নয়। বৈশিষ্ঠ্য হওয়া উচিত ভালো মানুষ কিনা, সৎ মানুষ কিনা, জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান কিনা। কেউ ভিন্ন রাজনীতির অনুসারী বলেই তাকে খেসারত দিতে হবে বা হুমকির সম্মূখীন হতে হবে তা খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশের জনগণের আস্থার প্রতীক বিশ^নন্দিত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মাননীয় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দলমতের উর্ধ্বে ওঠে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনি এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় দেশের সংখ্যালঘু জনগণ আপনার শাসনকার্যের ওপর আস্থাশীল। একমাত্র আপনিই পারেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনমান রক্ষা করতে। সংখ্যালঘু শূন্য হওয়ার আগে তাদেরকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করুন। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে সংখ্যালঘুদেরকে হতাশা ও বিচারহীনতা সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করুন।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এজেডএস