সাংবাদিকতার পেশাদারী ও নৈতিক মানদণ্ড
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৩৮
১৫৫৬ সালে ভেনিস সরকার প্রথম মাসিক নটিজি স্ক্রিট (লিখিত নোটিশ) প্রকাশ করেছিল যার দাম ছিল এক গ্যাজেটা, তৎকালীন একটি ভেনিসীয় মুদ্রা, যার নাম শেষে ‘সংবাদপত্র’ হয়েছিল। এটি একটি হস্তলিখিত নিউজলেটার ছিল এবং পুরো ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সংবাদ দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে প্রচার করত, বিশেষত ইতালিতে, আধুনিক যুগের (১৫০০-১৮০০) – খবরের কাগজের কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে – যদিও সাধারণত সত্যিকারের সংবাদপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয় না।
এই প্রকাশনাগুলির কোনওটিই যথাযথ সংবাদপত্রের আধুনিক মানদণ্ড পুরোপুরি পূরণ করে না, কারণ এগুলি সাধারণত সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে নয় এবং নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৬০১ সালের কাছাকাছি সময়ে আবির্ভূত প্রাথমিক প্রকাশনাগুলি আজকের সংবাদপত্র উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিল। ১৫ ও ১৬ শতকের দিকে, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে, “রিলেশন” নামক দীর্ঘ সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল; স্পেনে একে “রিলেসিওনস” বলা হত। একক ইভেন্টের সংবাদ প্রকাশনাগুলি ব্রডশিট ফর্ম্যাটে ছাপা হত, যা প্রায়শই ডাকযোগে পাঠানো হতো। এই প্রকাশনাগুলি পামফলেট এবং ছোট পুস্তিকা হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল, প্রায়শই কাঠের খোদাই থাকতো। শিক্ষার হার আজকের তুলনায় কম ছিল এবং এই সংবাদ প্রকাশগুলি প্রায়শই উচ্চস্বরে পড়া হত।
১৪০০ সাল নাগাদ, ইতালীয় এবং জার্মান ব্যবসায়ীরা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের সাথে তাদের ব্যবসার প্রচারে হস্তলিখিত ক্রনিকল সংকলন বের করেছিল। এই কাজের জন্য একটি প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করার ধারণাটি জার্মানিতে ১৬০০ সালের দিকে চালু হয়েছিল।
ইয়োহান কারোলাসের ১৬০৫ সালে জার্মানীর স্ট্রাসবুর্গ থেকে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন উন্ড গেডেনকভুর্ডিগেন হিস্টরিয়েনকে প্রথম সংবাদপত্র বলে অভিহিত করা হয়। এই খবর ১৭ শতাব্দীতে ইউরোপে সুপ্রতিষ্ঠিত দুইটি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। একটি চ্যানেলের সাথে যুক্ত ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডস, অন্যটির সাথে সংযুক্ত ছিল ইতালি, স্পেন এবং পর্তুগাল। প্রিয় বিষয়গুলির মধ্যে ছিল যুদ্ধ, সামরিক বিষয়, কূটনীতি এবং আদালতের ব্যবসা এবং গল্পগুজব।
এর পরে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের সরকার অফিসিয়াল নিউজলেটারগুলি ছাপানো শুরু করে। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইংরাজী ভাষার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন, “এ কারেন্ট অব জেনারেল নিউজ” প্রকাশিত হয়েছিল এবং ইংল্যান্ডে বিতরণ করা হয়েছিল, একটি ৮-২৪ পাতার কোয়ার্টো ফর্ম্যাটের ছিল।
প্রথম সফল ইংরেজি দৈনিক হল ১৭০২ থেকে ১৭৩৫ সালে প্রকাশিত ডেইলি ক্যুরান্ট।
উনিশ শতকে সমস্ত বড় বড় দেশের সংবাদপত্রগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, একাধিক প্রযুক্তিগত, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে। উচ্চ-গতির প্রেস এবং সস্তা কাঠের নিউজপ্রিন্ট কাগজের কারনে এসময় বড় প্রচলন সম্ভব হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য সম্ভাব্য পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলিকে স্পন্সর করে। শতাব্দীর শেষের দিকে, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন সু-প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সংবাদপত্রের মালিকদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠে। এটি সর্ববৃহৎ সম্ভাব্য সঞ্চালন অর্জনের জন্য একটি প্রতিযোগিতাকে নেতৃত্ব দেয়। ১৮৬০ এবং ১৮৭০এর দশকে ইউরোপে সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬,০০০; তারপর ১৯০০ সালে এটি দ্বিগুণ হয়ে ১২,০০০ এ দাঁড়িয়েছিল।
প্রতি দশকে প্রেসগুলি দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং ১৮৮০এর দশকে স্বয়ংক্রিয় টাইপসেটিং আবিষ্কার একটি বিশাল সকালের সংবাদপত্র রাতারাতি মুদ্রণ করা সম্ভব করে তোলে। সস্তা কাঠের সজ্জা ব্যয়বহুল কাগজকে প্রতিস্থাপন করেছিল। একটি প্রধান সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন হলো সংবাদ সংগ্রহের পেশাদারিত্ব, যা বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকরা পরিচালনা করে। উদারপন্থা সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করে এবং সরকারী সেন্সরশিপ হ্রাস করার সাথে সাথে সংবাদপত্রের করের সমাপ্তি ঘটে। মুনাফায় আগ্রহী উদ্যোক্তারা ক্রমবর্ধমান দলের আগ্রহী রাজনীতিবিদদের প্রতিস্থাপন করে, এতে বৃহত্তর ভিত্তির নাটকীয় প্রচার সম্ভব হয়। দাম কমে হয় এক পেনি। মহিলাদের পূর্বে উপেক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু এখন তাদের জন্য পরিবার ও গৃহস্থালী এবং ফ্যাশন সম্পর্কিত একাধিক কলাম বরাদ্দ দেওয়া হয়, এবং বিজ্ঞাপনে ক্রমশ তাদের ব্যবহার প্রসারিত হয়েছে।
১৯০০ সাল নাগাদ ব্রিটেনে জনপ্রিয় সাংবাদিকতা শ্রমজীবী শ্রেণিসহ সম্ভাব্য বৃহত্তম পাঠকদের লক্ষ্য করে সাফল্য লাভ করেছিল এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করেছিল। আলফ্রেড হার্মসওয়ার্থ, ১ম ভিসকাউন্ট নর্থ ক্লিফ (১৮৬৫–১৯২২) -এর ডেইলি মেইল তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৈনিক সঞ্চালনের বিশ্ব রেকর্ড ধারণ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী লর্ড স্যালসবারি বলেন, “অফিসের ছেলেদের জন্য অফিস ছেলেরা লিখেছে”।
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের শ্রম পত্রিকাও প্রসারিত হয়েছিল এবং ১৯১২ সালে ডেইলি হেরাল্ড ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম দৈনিক পত্রিকা হিসাবে চালু হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সংবাদপত্রগুলি গুরুত্বের শিখরে পৌঁছেছিল, এর কারণ যুদ্ধকালীন বিষয়গুলি জরুরি এবং সংবাদযোগ্য ছিল এবং সংসদ সদস্যরা সর্বদলীয় জোট সরকারকে সরকারি আক্রমণ থেকে বিরত করেছিল। ১৯১৪ সাল নাগাদ নর্থ ক্লিফ ব্রিটেনে সকালের সংবাদপত্রের প্রচারের ৪০ শতাংশ, সন্ধ্যার ৪৫ শতাংশ এবং রবিবারের সংস্করণের ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি একে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষত ১৯১৫ সালের শেল সঙ্কটে সরকারকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে। লর্ড বিভারব্রুক বলেছেন যে, তিনি ছিলেন, “সবচেয়ে বড় ব্যক্তি যিনি ফ্লিট স্ট্রিটকে নামিয়ে দিয়েছিলেন।” এজেপি টেইলর অবশ্য বলেছেন, “নর্থক্লিফ সংবাদের সঠিক ব্যবহার করে ধ্বংসাত্মক করতে পারেন। তিনি শূন্য জায়গায় পা রাখেন নি। তিনি প্রভাবের পরিবর্তে ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং ফলস্বরূপ তিনি কোনটাই পান নি।”
অন্যান্য শক্তিশালী সম্পাদকদের মধ্যে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানের সিপি স্কট, দ্য অবজার্ভারের জেমস লুই গারভিন এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দ্য নেশন- এর হেনরি উইলিয়াম ম্যাসিংহাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বেঙ্গল গেজেট নামে জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদকের অধীনে ভারতের প্রথম পত্রিকা ১৭৮০ সালে প্রচারিত হয়েছিল। ৩০ মে, ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে কেলকাট্টা (বর্তমানে কলকাতা) থেকে প্রতি মঙ্গলবার পণ্ডিত যুগল কিশোর শুক্লা কর্তৃক প্রকাশিত ভারতের প্রথম হিন্দি ভাষার সংবাদপত্র হল উদন্ত মার্টান্ড (দ্য রাইজিং সান)। মাওলালী মুহাম্মদ বাকির ১৮৩৬ সালে প্রথম উর্দু ভাষার সংবাদপত্র উর্দু আখবর প্রতিষ্ঠা করেন। ইংলিশ রবার্ট নাইট (১৮২৫-১৮৯০) দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা বিস্তৃত ভারতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল, টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং দ্য স্টেটসম্যান । উভয়ই ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রচার করত, নাইট জনগণকে সংবাদমাধ্যমের ক্ষমতার সাথে এবং রাজনৈতিক বিষয় এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
১৯২০ এর দশকে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা রূপ ধারণ করতে শুরু করে লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান এবং মার্কিন দার্শনিক জন ডিউয়ি গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। তাদের এই ভিন্ন ভিন্ন দর্শন এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়।
১৯৫০ এর দশকে দিয়ারিও কারিওকা সংবাদপত্রের সংস্কার রূপকে ব্রাজিলে আধুনিক সাংবাদিকতার জন্ম বলে চিহ্নিত করা হয়।
সাংবাদিকতা হল আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশলসহ বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে বোঝায়।
সংবাদপত্রে যা কিছু ছাপা হয় তার মধ্যে প্রধান উপাদান সংবাদ। যে পত্রিকা যতো বেশি ভাল সংবাদ প্রকাশ করতে পারে সাধারণত তার কদর বেশি, এর প্রচার সংখ্যাও বেশি। ভালো সংবাদ ছাপার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পত্রিকার নীতি-কৌশল-দর্শন ও প্রতিদিনের বিষয় নির্বাচন। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংবাদ যিনি তৈরি করছেন বা লিখছেন তার প্রস্তুতি, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব।
সাংবাদিকতার ধরন
বিভিন্ন ধরনের পাঠকের জন্য সাংবাদিকতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। একটি একক প্রকাশনায় (যেমন সংবাদপত্র) বিভিন্ন ধরনের সাংবাদিকতা উপাদান থাকে এবং প্রত্যেক উপাদান বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটের প্রত্যেকটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের জন্য সংবাদ সরবরাহ করে থাকে। সাংবাদিকতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধরন হল:
রাজনৈতিক সাংবাদিকতা
কোন নির্দিষ্ট শ্রেণি মতাদর্শ বা পাঠকের মতামতের প্রভাব সমর্থন করে লেখা হয়।
সম্প্রচার সাংবাদিকতা
বেতার বা টেলিভিশনের জন্য লিখিত সাংবাদিকতা।
নাগরিক সাংবাদিকতা
নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা।
উপাত্ত সাংবাদিকতা
ঘটনাবলী সংখ্যায় খুঁজে বের করার এবং তা সংখ্যায় প্রকাশ করার রীতি।
ড্রোন সাংবাদিকতা
ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করা।
গঞ্জো সাংবাদিকতা
হান্টার এস থম্পসন কর্তৃক উদ্ভাবিত গঞ্জো সাংবাদিকতা হল প্রতিবেদন প্রণয়নের নিজস্ব উপায়।
পারস্পারিক ক্রিয়াশীল সাংবাদিকতা
অনলাইন সাংবাদিকতার একটি ধরন যা ওয়েবে উপস্থাপন করা হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা
আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ উদ্ঘাটন করে এমন প্রতিবেদন।
আলোকচিত্র সাংবাদিকতা
চিত্রের সাহায্যে সত্য ঘটনাসমূহ উপস্থাপনের রীতি।
সেন্সর সাংবাদিকতা
অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সেন্সর ব্যবহার করা।
টেবলয়েড সাংবাদিকতানোদনমূলক সংবাদ প্রণয়ন, যা মূলধারার সাংবাদিকতা থেকে কম বৈধ।
হলুদ সাংবাদিকতা
অতিরঞ্জিত অভিযোগ বা গুজব বিষয়ক প্রতিবেদন।
ক্রীড়া সাংবাদিকতা
ক্রীড়া সাংবাদিকতা অপেশাদার এবং পেশাদার ক্রীড়া খবর এবং ঘটনা রিপোর্ট উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ক্রীড়া সাংবাদিক সকল প্রিন্ট, টেলিভিশন সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট সহ মিডিয়াতে কাজ করে।
সংবাদ-এর দুটো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। এর একটি হলো, ছয়টি প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া বা সংগ্রহ করা, যার শুরু ‘ক’ দিয়ে। যেমন কী, কে, কখন, কোথায়, কেন এবং কীভাবে। ঘটনা বা দুর্ঘটনা কী, কে বা কারা তার সাথে জড়িত বা ক্ষতিগ্রস্ত, কোনদিন এবং কোন সময়ে ঘটেছে, কোথায় ঘটেছে তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা, কেন ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
সংবাদ-এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য কাঠামো সংক্রান্ত। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে লিখতে হবে সংবাদ-সূচনা। তথ্য সাজাতে হবে যৌক্তিক বিবেচনায়, ক্রমানুসারে নয়। ঘটনার মধ্যে যে বিষয়টি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তা থাকবে সংবাদ-সূচনায়।
একটি সংবাদ করার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্টারকে অনুসরণ করতে হয় ঘটনা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় ও পরবর্তী ঘটনা। ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ও পর্যাপ্ত তথ্য সম্বলিত সংবাদ অত্যন্ত জরুরি।
যদি একজন রিপোর্টার তার পরিশ্রম ও মেধা কাজে লাগায় তবে তার পত্রিকার সম্পাদকও খুশি হন। সাংবাদিকতার সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য একজন রির্পোর্টার বড় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। একটি সংবাদ করার পর ফলো আপ হওয়া জরুরী। এতে সংবাদ-এর লক্ষ্য মানুষকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য-বিশ্লেষণ দেয়া এবং মানুষের কল্যাণ অর্জিত হবে।
যে কোন সংবাদ তৈরি করতে গিয়েই অনুসন্ধান করতে হয় এবং একজন রির্পোটারকে যতœবান ও কৌশলী হতে হয়। অনুসন্ধানী সংবাদ-এর জন্য একজন রির্পোটারকে অনেক বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। অনুসন্ধান ছাড়া ডেপথ রিপোর্ট সম্ভব নয়। কোনো ঘটনার উপর সাধারণ সংবাদ হবার পর তার থেকে অনেক সময় একটি ডেপথ রিপোর্টের সূচনা হয়। ডেপথ রিপোর্টের মধ্যেও অনুসন্ধানী রিপোর্টের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। অনুসন্ধানী সংবাদ মানেই সেই রিপোর্ট যা অন্যায় ও অনৈতিকতা উন্মোচন করে। ডেপথ রিপোর্টও অনৈতিকতা ও বেআইনী কাজ উন্মোচন করতে পারে, তবে অনুসন্ধানী সংবাদ সব সময়ই অনৈতিকতা উন্মোচন করবে। অনুসন্ধানী সংবাদ করার জন্য চাই সুচিন্তিত পদক্ষেপ, সময়, অঙ্গীকার ও প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান।
অনুসন্ধান বা Investigation শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ investigare থেকে যার অর্থ কোনো কিছুর অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা। অনুসন্ধানের সমার্থক শব্দ ‘তদন্ত’ (প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি), ‘পরীক্ষা নিরীক্ষা’ (তথ্য সংগ্রহ), ‘গবেষণা (বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি) ইত্যাদি। অনুসন্ধান শব্দের অর্থ থেকেই বুঝা যায় সম্ভাব্য সব ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে লুকানো তথ্য উদঘাটনই অনুসন্ধানী সংবাদ। আমাদের চারপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, উপাত্ত, অবস্থা ও উদ্বেগ আছে যা কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে লুকানো হচ্ছে না, কিন্তু অনুসন্ধান না করলে এবং পরিশ্রম না করলে সে সব মানুষ জানবে না।
নিয়মিত সাধারণ সংবাদ-এর বিষয় যেমন প্রচুর, অনুসন্ধানী রিপোর্টের বিষয়বস্তুও তেমন অভাব নেই। অনুসন্ধানী রিপোর্টের উদ্দেশ্য নি: সন্দেহে জনকল্যাণ, দুর্বলের পক্ষ নেয়া এবং মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়া। অনুসন্ধানী রিপোর্ট অন্যায়কারীকে চিনিয়ে দেয়, অতীতকে টেনে আনে বর্তমানে, বর্তমান সময়কে ব্যাখ্যা করে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। ক্ষমতাবানের বিবেককে নাড়া দেয়া এবং দুর্বলকে সচেতন করে তোলাও অনুসন্ধানী রিপোর্টের একটি কাজ। অনুসন্ধানী রিপোর্ট মানেই মৌলিক রিপোর্ট যা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা সমস্যার ব্যাখ্যা দেয়, জটিল সমস্যার ধারা (প্রবণতা) দেখায়, অন্যায় প্রতিহত করে, দুর্নীতি সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করে তোলে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে।
পেশাদারী ও নৈতিক মানদণ্ড
বিদ্যমান নৈতিক মানদণ্ডে ভিন্নতা রয়েছে, বেশিরভাগই রীতিতে সত্যতা, সূক্ষ্মতা, বিষয়বস্তুর উদ্দেশ্য, পক্ষপাতহীনতা এবং কৈফিয়ত – এই বিষয়গুলো সাধারণ উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই উপাদানসমূহ সংবাদ করার মত তথ্য সংগ্রহ করতে এবং জনগণের কাছে প্রচার করতে ব্যবহৃত হয়।
কিছু সাংবাদকিতার নৈতিকতার বিধিতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় বিধিতে, সংবাদে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বিষয়ক, এবং শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা নিয়ে বৈষম্যমূলক সূত্র বিষয়েরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। আবার কিছু ইউরোপীয় নৈতিকতার বিধিতে, সকল সংবাদপত্র ইনডিপেন্ডেন্ট প্রেস স্ট্যান্ডার্টস অর্গানাইজেশনের বিধি মেনে চলতে বাধ্য এবং তা যুক্তরাজ্যেও প্রচলিত। এই বিধিতে জনগণের গোপনীয়তাকে সম্মান দেওয়া এবং নিখুঁতভাবে কাজ নিশ্চিত করা অন্তর্ভুক্ত।
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অপর তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে, আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। বোঝাই যাচ্ছে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও অবস্থান কোথায়! জনস্বার্থ অভিমুখী মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পূর্ণতা পায় না। সরকার ও প্রশাসনের অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়াসহ জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে গণমাধ্যমকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হয়।
আসলে গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা, নীতি-আদর্শের যৌথ প্রচারক ও যৌথ আন্দোলনকারী, জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের পাহারাদার। গণমাধ্যমই সঠিক পথ বাতলে দেয় যাতে সরকার, প্রশাসন ও জনগণ সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। গণমাধ্যম সরকার, প্রশাসন ও জনগণের প্রতিপক্ষ নয়; তবে জনস্বার্থে নজরদারী করবে। কাজেই বলিষ্ট ও শক্তিশালী গণমাধ্যম ছাড়া জনস্বার্থের রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।
রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেলেও চতুর্থ স্তম্ভ শক্ত থাকলে রাষ্ট্রকে গণমুখী রাখা যায়। আর চতুর্থ স্তম্ভ নড়বড়ে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী মানুষ। আঁধার কেটে নিশ্চয়ই আলো আসবে। কিন্তু সেটা কি প্রকৃতির নিয়মে হবে? কাউকে না কাউকে ভূমিকা পালন করতে হয়।
সাংবাদিকতায় ঝুঁকি থাকবেই। সজাগ ও সচেতন থাকলে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা হারিয়ে যাবেনা। সাংবাদিকতার ডিকশনারি থেকে সততা ও পেশাদারিত্ব শব্দ দুটি কখনই বিলীন হবে না। সেখানে অসৎ আর হলুদ সাংবাদিকতার স্থান নেই।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হলুদ সাংবাদিকতার ভয়ে মানুষ তটস্থ।
হলুদ সাংবাদিকদের কারণে এখন প্রবাদটির নতুন সংস্করণ হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, হলুদ সাংবাদিকরা ছুঁলে ৭২ ঘা। কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়িয়েছে।
অনেকে বলেন, হলুদ সাংবাদিকদের দাপট অনেক বেশি। যদিও পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ও আদর্শিক।
পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই টিকে থাকবেন। যারা টিকে আছেন তাদের অভিবাদন জানাই। তারা সত্যি সত্যিই এই পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।
আমার মনে হয়, সৎ ও পেশাদার সাংবাদিকরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকবে।
যারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান তারাই টিকে থাকবেন। সবাইকে দিয়ে এই কাজ হবে না।
এ কথা এ কারণে বলছি যে, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব ছাড়া সুসাংবাদিকতা হয় না। আগে মনেপ্রাণে এই তিনটি বিষয় ধারণ করতে হবে। সাংবাদিকতা পেশার সামগ্রিক স্বার্থেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলেই লিখে দিতে হবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। একজন রিপোর্টারের কলমের খোঁচায় অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেক বড় উপকারও হতে পারে। মানুষের উপকারের বিষয়টিই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল সাধনই তো সাংবাদিকদের কাজ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে ৫২ বছর আগে একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই বিজয়ের ৫২ বছর পূর্তিতে আমরা নতুন ভাবনা, নতুন পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ। হৃদয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শ ও ‘৭২-এর সংবিধান।
আমরা বিশ্বাস করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে উন্নয়নের অভিযাত্রায় এগিয়ে নিতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা অবহেলিত, শোষিত-বঞ্চিত আর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই। আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে কিংবা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করতে চাই না।
আমাদের স্লোগান হচ্ছে, সততাই শক্তি, পেশাদারী সুসাংবাদিকতায় মুক্তি। এটিই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আদর্শ। এর বাইরে আমাদের অন্য কোনো নীতি-আদর্শ নেই।
আমরা জানি, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা ভাঙবো কিন্তু মচকাব না। আমরা হোঁচট খাব কিন্তু আমরা থেমে যাব না। আমাদের এই অভিযাত্রায় সংগ্রামী মানুষের সহযোগিতা চাই। আমার বিশ্বাস, এই দেশকে যারা ভালোবাসেন, এই দেশের যারা মঙ্গল চান, তারা নিশ্চয় আমাদের পাশে থাকবেন।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস